দুইশ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঘিওর হাট : আব্দুর রাজ্জাক

দুইশ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঘিওর হাট

আব্দুর রাজ্জাক

দুইশ বছরের বেশি পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী ঘিওর হাট। মানিকগঞ্জের ঘিওর হাট বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও বিখ্যাত হাট। ধলেশ্বরী ও ইছামতি নদী তীরের এই হাটের জন্ম ব্রিটিশ শাসনামলে আঠারো শতকের প্রথম দিকে। গরু, পাট ও ধান বিক্রির জন্য বিখ্যাত ছিল ঘিওর হাট। গজারী কাঠ, পুরনো টিনের মত অনেক দুষ্প্রাপ্য বস্তু এখানে পাওয়া যেতো। হাটটি ৩ কিলোমিটার বিস্তৃত। টাংগাইল, ঢাকা, ফরিদপুর, পাবনা, চট্টগ্রামসহ আশেপাশের জেলাগুলো থেকে এখানে ব্যবসা করতে আসতো। বড় চালের কল, আটার কল, তেলের ঘানী ছিলো এখানে।

সারা দেশে এই হাটের বহুল পরিচিতির কারণে এই উপজেলাকেই দূর-দূরান্তের মানুষজন ‘হাট ঘিওর’ নামেই চিনে। সূচনালগ্ন থেকেই ঘিওর হাট সপ্তাহে বুধবারে বসে, তবে এক সময় এই হাটে মানুষ বুধবারের একদিন আগে অর্থাৎ মঙ্গলবার থেকে আসা শুরু করত। মঙ্গলবার বিকেল থেকে বেচা কেনা শুরু হতো। নৌকা কেন্দ্রিক এই হাটের নদীর পাড় নৌকায় নৌকায় ভরে যেত। নৌকা রাখার জায়গা পাওয়া কষ্ট হতো। হাটের মানুষের কোলাহল ছড়িয়ে যেত দূর-দূরান্তে। হাটে মানুষের ভীরে চলাচল করা ছিল কষ্ট সাধ্য। বিশাল হাটের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। মঙ্গলবার থেকে দূর-দূরান্তের মানুষের নৌকায় রান্না চলত। বুধবার হাট চলত গভীর রাত পর্যন্ত।

এটিকে ছোটখাট নদীবন্দরও বলা হতো। হাট সংলগ্ন কুস্তা বন্দরে স্টিমার, বড় বড় নৌকা এসে ভীড়তো। ধান, পাটসহ নানা দ্রব্য নেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীরা বড় বড় ছান্দি নৌকা নিয়ে আসতো। তৎকালীন সময় রাজস্ব আদায়ের অন্যতম খাত ছিলো ঘিওর হাট।

 

এলাকার প্রবীণ লোকজনের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, ১৮৭০ সালে ভারতের ঘি-আগরওয়ালা নামে এক মারোয়ারী ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য ঘিওরে আসেন। ব্যবসার ফাঁকে-ফাঁকে তিনি বিভিন্ন লোকজনের সাথে কথা বলেন হাটের ব্যপারে। বহু কষ্ট করে তিনি এলাকার তৎসময়ে মুরুব্বিসহ গন্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে বহু আলোচনা করেন। এক পর্যায়ে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পুরাতন ধলেশ্বরী নদীর পাশে হাটের স্থান নির্ধারন করেন। তবে তিনিই মূলতঃ ঘিওর হাটের নামকরন করেন। ১৮৭২ সাল থেকে হাট শুরু হয়। সে সময়ে বাজারে মাত্র ৬/৭ টি দোকান ছিল।

পরবর্তীতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান প্রয়াত কফিল উদ্দিন দরজী, ইউপি চেয়ারম্যান ইয়াকুব মোল্লা, ইউপি চেয়ারম্যান খোরশেদ মিয়া ও হরনাথ সরদার হাটটি পরিচালনা করতেন। তবে ৮০/৯০ দশকের দিকে ঘিওর হাট ব্যাপক জমজমাট ছিল।

ঘিওর প্রশাসনিক থানা হিসেবে ঘোষিত হয় ১৯১৯ সনে। তখন থেকে ঘিওর হাটের প্রশাসনিক রেকর্ড শুরু হয়। ঘিওর হাট তারও ১০০ বছরের বেশি আগের পুরনো। ঘিওর এবং আশেপাশের মানুষ বুধবার ঘিওর হাটের দিনের জন্য অপেক্ষা করতো। সারা সপ্তাহের প্রয়োাজনীয় জিনিস হাটের দিন কিনে রাখতো। আর যারা কোন কিছু বিক্রি করবে তারা হাটে বিক্রি করতো। বুধবার ঘিওর হাটের দিন উৎসবের আমেজ বইতো। দূর-দূরান্তের মানুষ যাদের ঘিওর এবং আশেপাশের গ্রামে আত্মীয় ছিলো, তারা ঘিওর হাটের দিন আত্মীয় বাড়িতে বেড়ায়ে যেতেন। কথিত আছে, এই হাটে কেনা বেচার সুবিধার্থে ঘিওর এলাকায় অন্য এলাকার মানুষজন আত্মীয় করতে আগ্রহী ছিলেন।

কোলকাতার মহাজনরা এই হাট থেকে হরেক রকমের ডাল পাইকারি কিনে নিয়ে কোলকাতায় ব্যবসা করতো। বুধবার হাটের দিন এত পরিমাণ মিষ্টি আর রুটি বানানো হতো, তা দেখে সকলের চোখ কপালে উঠে যেত, আর হাটের দিনই সব মিষ্টি আর রুটি শেষ হয়ে যেত, যা ছিল অবিশ্বাস্য। ঘিওরের প্রাচীন বাসিন্দাদের মধ্যে প্রচলিত ছিলো, এত পরিমাণ মিষ্টি খাওয়ার জন্য হাটে মানুষের বেশে জিন পরী নামতো। তা ছাড়া এই হাটে নানা রকমের আঞ্চলিক মুখোরোচক খাবার পাওয়া যায় চানাচুর, নিমকি মিষ্টি জাতীয় খাবার ইত্যাদি। তা ছাড়া সবচেয়ে মজার খাবার বাদাম।

শত শত পরিবারের আয় উপার্জনের ক্ষেত্র ছিল এ হাট। কেউ কিনতে আসতেন আর কেউ বিক্রি করতেন। এ বেচাকেনার ওপর নির্ভর করে সংসার চালাতেন। এ হাটের বিশেষত হলো প্রতিটি জিনিসের জন্য আলাদা আলাদা করে জায়গা নির্ধারিত। যেমন, ধানের জন্য ধান হাটা, গরুর জন্য গরু হাটা, ছাগলের জন্য ছাগল হাটা। এ রকম এমন কোন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস নেই যা ঘিওর হাটে পাওয়া যেতো না।

দুপুর বেলা খাবারের জন্য ঘিওরে হোটেলে থাকে দেশীয় মাছ, সবজি। এলাকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং সুস্বাদু মজার খাবার নিজামের মিষ্টি। যার স্বাদ এক কথায় অতুলনীয়। নিজামের মিষ্টির মধ্যে সবচেয়ে চাহিদা হচ্ছে মাওয়া মিষ্টি। এছাড়া মিনিকেট, শাহী চমচম, মালাই চপ, আফলাতুন ছানা, সন্দেশ চকলেটসহ নানা ধরনের মিষ্টি রয়েছে। যার দাম প্রকারভেদে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি এবং প্রতি পিচ ৩০ টাকা করে। আরো পাবেন নইমুদ্দিনের বিখ্যাত শাহী মিষ্টি পান, যার স্বাদ হৃদয় কেড়ে নেয়। এ ছাড়া এই এলাকার গরুর খাঁটি দুধের চায়ের রয়েছে বেশ সুনাম, সন্ধ্যায় পাবেন ঘিওর বাসস্ট্যান্ডে চটপটি, যা এক ধরনের বিশেষ সালাদ দিয়ে পরিবেশন করা হয় এবং আরো পাবেন মাংস দিয়ে তৈরি তেলে ভাজা মচমচা গরম চপ। যার স্বাদ জিভে লেগে থাকবে বহুদিন।

ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীনতার পর নব্বই এর দশক পর্যন্ত এ হাটের খ্যাতি ছিল দেশ জোড়া। নব্বই দশকের পর থেকে অতিরিক্ত খাজনা আর গ্রামে গঞ্জের পথের মোড়ে বাজার ও দোকানের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে কালের স্রোতে ঐতিহ্যবাহী ও গর্বের ঘিওর হাট জৌলুস হারাতে শুরু করে। তবে এখন বর্ষা মৌসুম আর ঈদের সময় হাট কিছুটা হলেও জমে উঠে। এখনও ঘিওরের নৌকার হাট তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। বর্ষার সময় শত শত নৌকা হাটের সারিবদ্ধ নৌকা সাজিয়ে রাখার দৃশ্য দেখার মতো।

বিপর্যয়ের মুখে মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ঘিওর উপজেলার হাট বাজারের পরিবেশ। ব্রিটিশ আমলে সৃষ্টি প্রাচীন গৌরব গাঁথা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক ঘিওর হাটের সঙ্গে শত বছরের ইতিহাস জড়িত। পরিতাপের বিষয় গরু হাটের জন্য সারা দেশে যে হাটের নাম থাকলেও এখন সে হাটে কুরবানি ঈদ ছাড়া তেমন একটা গরুও উঠে না। দু শত বছরের প্রাচীন হাটটির তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি বললেই চলে। এখনও পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা না থাকায়, একটু বৃষ্টিতে হাটে পানি জমে চলাচলের অযোগ্য হয়ে যায়, কাঁদায় হাঁটা যায় না, হাটে নেই টয়লেট ও পর্যাপ্ত সংখ্যক নলকূপ। এছাড়া এত বড় হাটে নেই সিসি ক্যামেরা। ময়লা পচা দুর্গন্ধের জন্য বাজারে চলাচল করা কঠিন হয়ে পড়েছে। হাট বাজার থেকে প্রতিবছর লক্ষাধিক টাকার রাজস্ব আদায় হলেও দীর্ঘদিন উন্নয়ন না হওয়ায় ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীসহ জনসাধারণ।

ঘিওর পুরাতন গরু হাট, কাঠপট্টি, মাছবাজার, গুড় হাট, মিষ্টিপট্টি, বাসস্ট্যান্ড, ধানহাট, ভুসিপট্টি ও মুক্তিযোদ্ধা ভবনের সামনের সড়কগুলো অল্প বৃষ্টিতেই ভাসতে থাকে। ১৯৯৫ সালে ঘিওর ভুসিপট্টি, মেইনরোড, ধানহাট এবং ২০০২ সালে ঘিওর পুরাতন গরু হাট, বাসস্ট্যান্ডে পানি নিস্কাশনের জন্য কয়েকটি ড্রেন নির্মিত হয়। কিন্তু অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ড্রেনগুলো ভরাট হয়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। একাধিকবার সংস্কার করলেও বাজারের ব্যবসায়ীদের কোন উপকারে আসেনি।

হাটের কাপড় ব্যবসায়ী মোসলেম মিয়া বলেন, আমার দাদার আমল থেকে ঘিওর হাটে আমরা কাপড় ব্যবসা করে থাকি। এক সময় এই হাটে প্রচুর বেচাকেনা হতো। একদিন হাটের বেচাকেনায় পুরো পরিবারের চলে যেত সারা সপ্তাহ। এখন টিকে থাকাই কষ্টকর। সামান্য বৃষ্টিতে হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায় এই গলির পথ। যার ফলে এই পথে ক্রেতা অসেন না।

হাটের পুরাতন বণেদী ব্যবসায়ী মেসার্স অটল সাহা এন্ড সন্সের স্বত্তাধিকারী বিপ্লব কুমার সাহা তুফান বলেন, আমরা বংশ পরম্পরায় ঘিওরে ব্যবসা করে আসছি। আমাদের ঐতিহ্যের ধারক এই ঘিওর হাট। কিছু সঙ্কট আর জনদুর্ভোগ সমাধান করতে পারলে এই হাটের ঐতিহ্য কিছুটা হলেও অব্যাহত থাকবে।
ঘিওর বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন মুসা বলেন, বাজারে ড্রেন, টিউবওয়েল, প্রস্রাবখানা, রাস্তাঘাটের উন্নয়নের জন্য প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ করা হয়েছে। তবে বাজারের ময়লা আবর্জনা অপসারণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ঘিওর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান বলেন, দুইশ বছরের অধিক সময়ের ঐতিহ্য এই ঘিওর হাট। তবে জৌলুস কমে গেছে। বর্ষাকালে নৌকার হাট বেশ জনপ্রিয়। এতবড় নৌকার হাট আমার নজরে আর কোথাও পড়েনি। তিন পুরুষের কাছে গল্প শুনেছি এই হাটের ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা। এই হাটের অবকাঠামো ও জনদুর্ভোগ লাঘবে কয়েকটি উন্নয়নমূলক প্রকল্প উর্ধ্বতন দফতরে প্রেরণ করা হয়েছে।
ঘিওর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হামিদুর রহমান বলেন, বৃহত্তম ঘিওর হাট-বাজারের সমস্যার কথা জানার পর একধিকবার সরজমিন পরিদর্শন করে কিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। আশা করি অতি দ্রুত এই কাজগুলো করলে হাটের সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। তখন কেনা বেচা করতে আসা মানুষজনের ভোগান্তি পোহাতে হবে না।

কড়চা/ এ আর

Facebook Comments Box
ভাগ