আব্দুর রাজ্জাক : নদী আর নৌকা বাইচের সাথে মানিকগঞ্জের মানুষের আশৈশব মিতালি। নদী এখানকার মানুষের প্রাণোচ্ছল ক্রীড়াসঙ্গী। পদ্মা, যমুনা, কালীগঙ্গা, ধলেশ্বরী, ইছামতি, কান্তাবতী বিধৌত মানিকগঞ্জের ইতিহাস, ঐতিহ্য, উৎসব সবকিছুতেই নদী ও নৌকার সরব ঐতিহ্য। নৌকা বাইচ এ অঞ্চলের প্রাচীন সংস্কৃতির একটি অংশ। কিন্তু বর্তমানে বাঙ্গালির প্রাচীন এই ঐতিহ্য ম্লাণ হতে বসেছে। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে প্রাচীন এ সংষ্কৃতির অনুসঙ্গ টিকে থাকবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বিপুল উৎসাহ উদ্দিপনায় মানিকগঞ্জের কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের রাজিবপুরে ধলেশ্বরী নদীতে শত বছরের ঐতিহ্য নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিযোগিতায় মানিকগঞ্জ ও আশে পাশের জেলা থেকে কমপক্ষে অর্ধশত নৌকা অংশ নেয়। স্থানীয় সরদার সমিতির আয়োজনে অনুষ্ঠিত নৌকা বাইচে হাজার
হাজার দর্শক উপভোগ করেন। নদীতীরের কমপক্ষে ৫/৬ কিলোমিটার পরিণত হয় মানুষের মিলন মেলায়। নৌকার ওপর ভাসমান দোকানপাটে বাহারী পণ্যের বেচাকেনার ধুম পরে।
সরেজমিন দেখা যায়, নৌকার মধ্যে ঢোল, তবলা, টিকারা নিয়ে গায়েনরা রয়েছে। তাদের গানগুলো মাঝিদের উৎসাহ আর শক্তি জোগায়। বাজনার সাথে নৌকা বাইচে মাঝি-মাল্লারা তালে তালে একসুরে গান গেয়ে ছুটে চলেন। যার ফলে কোনো বৈঠা ঠোকাঠুকি না লেগে একসঙ্গে পানিতে অভিঘাত সৃষ্টি করতে থাকে। গায়েন বা পরিচালক কাঁসির শব্দে এই বৈঠার এবং গানের গতি বজায় রাখতে সাহায্য করে। অন্য সব নৌকাকে পেছনে ফেলে নিজেদের নৌকাকে সবার আগে যাওয়ার চেষ্টায় প্রয়োজনবোধে কাঁসির শব্দে বৈঠার গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয় এবং সেই সঙ্গে গানের গতিও বেড়ে চলে।
এছাড়াও বর্ষা মৌসুমের আষাঢ় থেকে আশ্বিণ মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে মানিকগঞ্জ শহরের বেউথা ও ঘোস্তা এলাকায় কালিগঙ্গা নদীতে, ঘিওরের কান্তাবতী নদী, কালীগঙ্গা, দৌলতপুরে যমুনা নদী, ঝিটকায় ইছামতি নদীতে, আরুয়া ইউনিয়নের দড়িকান্দি-নয়াকান্দি ইছামতি নদীতে, হরিরামপুর উপজেলার সাপাই দিয়াবাড়ী বিল, দৌলতপুর উপজেলায় সমেদপুর গ্রামে ইছামতি নদীতে, সিংগাইর উপজেলায় চান্দহরে ধলেশ্বরী, বলধারা রামকান্তপুর এবং ঘিওর উপজেলায় পেঁচারকান্দা-কুশুন্ডা-জাবরা এলাকায় ও বালিরটেক কালিগঙ্গা নদীতে নৌকা বাইচের আয়োজন চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় অনুষ্ঠিত হয় এসব নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা।
নৌকা বাইচ সমন্ধে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মাঝে জনশ্রুতি আছে, জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রার সময় থেকে কালক্রমে নৌকা বাইচের শুরু। অন্য একটি জনশ্রুতি হলো, পীরগাজীকে কেন্দ্র করে। আঠার শতকের শুরুর দিকে কোনো এক গাজী পীরের ভক্তরা নৌকা বাইচের গোড়াপত্তন করেন। আবার অনেকের মতেই, মুসলিম যুগের নবাব-বাদশাহদের আমলে নৌকাবাইচ বেশ জনপ্রিয় ছিল। দাদা নাতী নামক নৌকার মাঝি প্রবীণ আলেক শেখ বলেন, বাইচের নৌকা হয় সরু ও লম্বাটে যাতে নৌকা নদীর পানি কেটে দ্রুতগতিতে চলতে সক্ষম।
নৌকা বাইচ আয়োজকদের একজন মো: মজিবর রহামন মিয়া বলেন, ছিপ, বজরা, ময়ূরপঙ্খী, গয়না, পানসি, কোষা, ডিঙ্গি, পাতাম, বাচারি, ঘাসি ইত্যাদি নৌকা বাইচে অংশ নেয়। একেকটি লম্বায় প্রায় ১০০ থেকে ২০০ ফুট হয়। নৌকার সামনে সুন্দর করে সাজানো হয় এবং ময়ুরের মুখ, রাজহাঁসের মুখ বা অন্য পাখির মুখের অবয়ব তৈরি করা হয়। দর্শকদের সামনে দৃষ্টিগোচর করতে নৌকা উজ্জ্বল রঙের কারুকাজ করা হয়। গায়না তরী, সোনার চান, মায়ের দোয়া, হারানো মানিক, দুই ভাই, সোনার বাংলা, রিয়াদ এন্টারপ্রাইজ, হাজারী তরী, আল্লাহর দান, শোকচাঁন তরী, অগ্রদূত, ঝড়ের পাখি, পঙ্খীরাজ, ময়ূরপঙ্খী, সাইমুন, তুফানমেইল, জয়নগর, চিলেকাটা, সোনার তরী, দীপরাজ ইত্যাদি নামকরন করা হয়।
বাইচের নৌকার মাল্লা মুন্নাফ মোল্লা বলেন, নৌকায় ওঠার ক্ষেত্রে রয়েছে নানান আনুষ্ঠানিকতা। সকলে পাক-পবিত্র হয়ে গেঞ্জি গায়ে মাথায় একই রঙের রুমাল বেঁধে নেয়। সবার মধ্যখানে থাকেন নৌকার নির্দেশক। প্রতিটি নৌকায় ৫০ থেকে ১০০ জন মাঝি থাকে।
মানিকগঞ্জের অন্যতম সাংষ্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দীপক কুমার ঘোষ বলেন, আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য নৌকা বাইচ নানা প্রতিকূলতার পথ পাড়ি দিয়ে আজ ক্লান্ত। মেহনতী মানুষের আনন্দ আর উত্তেজনার খেলা নৌকাবাইচ। তবে আগের মতো সেই আনন্দ-উদ্দীপনা আর আবেদন নেই। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই শিল্প বেঁচে থাকবে বহুদিন।
কড়চা/ এ আর
Facebook Comments Box