আমার কথা
স্বাধীনতার ঘোষক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অমর সৃষ্টি “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” গ্রন্থটি একজন খাঁটি বাঙালির অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, দ্রোহ, বিদ্রোহ এবং স্বাধীনতা লাভের জন্য নিরন্তর সংগ্রামের এক হৃদয়স্পর্শী দলিল। একশত সাইত্রিশ জন চরিত্রের আন্ত:সর্ম্পকের বুননে দুইশত আটাশি পৃষ্ঠার ধারাভাষ্য বঙ্গবন্ধু রচনা করেছিলেন ১৯৬৬-১৯৬৯ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দী থাকাকালে একান্ত নিরিবিলি পরিবেশে। মূলত এটি জন্ম হতে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আত্বজীবনী। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী ও দেশরত্ন শেখ হাসিনা বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন ২০০৭ সালে ঢাকার শেরে বাংলা নগরের সাব জেলে থাকাকালে। পিতা-কন্যার নিয়তির অদ্ভুত মিল! বইটির জমিনে রয়েছে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান, ভারতবর্ষ, রেঙ্গুন, হংকং, থাইল্যান্ড ও নতুন চীনের সুবিশাল প্রান্তর। একাধিকবার এ মহামূল্যবান গ্রন্থটি পাঠ করতে গিয়ে মনে হয়েছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এর একটি সহজপাঠ করাটা জরুরী। কারণ, এত বিস্তৃত জনপদ, চরিত্র ও ঘটনার পরম্পরা নবীনদের ধারণ করা মোটেও সহজ হবে না। অথচ এই নবীনদেরই বইটি পড়া অতি প্রয়োজন। বর্তমান ও ভবিষ্যতে সঠিক নেতৃত্ব দিতে সঠিক ইতিহাস অধ্যয়নের তথা বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন পাঠের কোনো বিকল্প নেই। আর সে বোধ হতেই চলমান করোনার (কোভিড-১৯) সীমিত অবকাশে আমার এ প্রয়াস। এতে পরিপূর্ণ ধারণা না পেলেও শিক্ষার্থীরা অনেকটা সহজেই বঙ্গবন্ধুর জীবনী ও সমকালীন রাজনীতি সম্পর্কে মাধ্যমিক ধারণা পাবে। অধিক উৎসাহীরা তখন মূল বইয়ের পাতা উল্টাতে আগ্রহী হবে। ব্যস্ত কর্মজীবী ও সাধারণ পাঠকরাও এ থেকে কিছুটা উপকৃত হতে পারেন। তবে যে কোনো মূল্যেই এটি মূল বইয়ের বিকল্প নয়। কাজটি করতে গিয়ে আমি দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর ‘‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী ” বইটির চতুর্থ মুদ্রণ: ফেব্রুয়ারি ২০১৮ এর সহযোগিতা নিয়েছি। সে জন্য আমি বইটির মহান লেখক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, লেখকের সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা ও স্বনামধন্য প্রকাশক জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ (প্রয়াত) এর প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কখনও কখনও বঙ্গবন্ধুর ও অন্যান্য নেতাদের বক্তব্য হুবহু তুলে ধরেছি আবার কখনও তা নিজের ভাষায় প্রকাশ করেছি। পাঠকের সুবিধার্থে প্রতিটি বক্তব্যের জন্য মূল বইয়ের পৃষ্ঠা নম্বর নির্দেশ করেছি। আর একেকটি ধারণা/বক্তব্য কে ভূক্তি নম্বর দিয়ে চিহিৃত করেছি। সহজ পাঠটিতে ভূক্তি আছে ৮০৪ টি।
ভূক্তি নির্বাচনে আমি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছি বঙ্গবন্ধুর জীবনকে। ঠিক এর পরেই রেখেছি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ও ভাসানীকে। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে চীন সফরের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। শত চেষ্টার পরেও কিছু বিচ্যুতি থেকেই যেতে পারে। আমার লক্ষ্যদলের সামান্য কাজে লাগলেও নিজের শ্রমকে সার্থক মনে করবো। বইটি প্রকাশের ব্যাপারে নিরন্তর উৎসাহ প্রদান ও সহযোগিতা করার জন্য আমি কৃতজ্ঞ মানিকগঞ্জের কৃতি সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সুযোগ্য সাধারণ সম্পাদক ও মানিকগঞ্জ জজ কোর্টের বিজ্ঞ পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোঃ আব্দুস সালাম ও হবিগঞ্জের কৃতি সন্তান, বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী) জনাব মাহমুদ হাসান দীপু এর কাছে। পুরো পান্ডুলিপিটি কষ্ট করে পড়ে গঠনমূলক মতামত প্রদানের জন্য আমি কৃতজ্ঞ দৈনিক ইত্তেফাকের স্বনামধন্য সাংবাদিক মোঃ আক্তারুজ্জামান ভাইয়ের কাছে। পান্ডুলিপিটি প্রকাশের ক্ষেত্রে মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করে আমাকে চিরকৃতজ্ঞ করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের সম্মানিত কিউরেটর মোঃ নজরুল ইসলাম খান (এন আই খান) স্যার। পান্ডুলিপিটি প্রকাশে এগিয়ে আসায় পাঠকনন্দিত সাপ্তাহিক কড়চা’র জনপ্রিয় সম্পাদক জনাব সুরুয খান এর প্রতি আমি বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ। আমার বহু প্রত্যাশিত প্রকাশনাটির মান উন্নয়নে গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ পেলে বাধিত হব। দেশ ও বিদেশেরবঙ্গবন্ধু-প্রেমিকদেরসহযোগিতাকামনাকরছি।
বিনীত-
শ্যামল কুমার সরকার, সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ঝিটকা খাজা রহমত আলী কলেজ, হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ এবং লেখক ও কলামিষ্ট।
তারিখ : ১৫/০১/২০২২
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী :সহজ পাঠ
শ্যামল কুমার সরকার
ভূক্তি- ১ শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রীর ডাক নাম রেণু। তিনি কয়েকটি খাতা কিনে মুজিবুর
রহমানকে জেল গেটে দিয়েছিলেন (পৃ-১)।
ভূক্তি-২ রেনু দুইদিন শেখ মুজিবকে জেলে বসে লিখতে অনুরোধ করেছিলেন (পৃ- ১)।
ভূক্তি-৩ মধুমতি নদী (যা খুলনা ও ফরিদপুর জেলাকে ভাগ করেছে। (পৃ-১) ।
ভূক্তি-৪ শেখ বংশের গোড়াপত্তন করেন শেখ বোরহান উদ্দিন নামের এক ধার্মিক পুরুষ (পৃ-৩) ।
ভূক্তি- ৫ মোঘল আমলের ছোট ছোট ইট দ্বারা শেখ মুজিবের বাড়ির দালানগুলি তৈরী (পৃ-৩) ।
ভূক্তি- ৬ শেখ মুজিব টিনের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন (পৃ-৩)।
ভূক্তি- ৭শেখ মুজিবের বাড়ির দালানগুলির বয়স প্রায় দুইশত বছরের বেশি (পৃ-৩)।
ভূক্তি- ৮ শেখ কুদরত উল্লাহ ও শেখ একরাম উল্লাহ এরা শেখ বোরহান উদ্দিনের ছেলের ছেলে অথবা দু’এক পুরুষ পরের দুই ভাই (পৃ-৩)।
ভূক্তি-৯ শেখ মুজিবুর রহমান শেখ কুদরত উল্লাহ ও শেখ একরাম উল্লাহর বংশধর (পৃ-৩)।
ভূক্তি- ১০ শেখ কুদরত উল্লাহ ছিলেন ব্যবসায়ী এবং সংসারী আর শেখ একরাম উল্লাহ ছিলেন সরদার যিনি বিচার-আচার করতেন (পৃ-৩)।
ভূক্তি-১১ শেখ কুদরতউল্লাহ বড় ভাই (পৃ-৩)।
ভূক্তি-১২ খুলনা জেলার আলাইপুরে মিঃ রাইন নামে এক ইংরেজ কুঠিয়াল ছিলেন (পৃ-৩)।
ভূক্তি-১৩ শেখ কুদরত উল্লাহ রাইনকে ‘‘আধা পয়সা’’ জরিমানা করলো (পৃ-৫)।
ভূক্তি-১৪ কুদরত উল্লাহ শেখকে লোকে কদু শেখ বলে ডাকতো (পৃ-৫)।
ভূক্তি-১৫ বাগেরহাটে ট্রেনের মধ্যে (এডভোকেট জিল্লুর রহমানও ছিল) শেখ মুজিব এক বৃদ্ধের কাছ হতে গল্পটি শুনেছিলেন (পৃ-৫)।
ভূক্তি-১৬ শেখ কুদরত উল্লাহ ও শেখ একরাম উল্লাহর মৃত্যুর দুই এক পুরুষ পর হতেই শেখ বাড়ির পতন শুরু হয় (পৃ-৫)।
ভূক্তি-১৭ রানী রাসমনি হঠাৎ জমিদার হয়ে শেখদের সাথে লড়তে লাগলেন (ইংরেজদের সহযোগীতায়) (পৃ-৫)।
ভূক্তি-১৮ কলকাতার একটি সম্পত্তি এবং উল্টোডাঙ্গার আড়ত ছিল শেখদের। শেখ অছিমুদ্দিন এসব সম্পত্তি দেখাশুনা করতেন (পৃ-৫)।
ভূক্তি-১৯ শেখ বাড়ি হতে দুই/তিন মাইল দূরে তজিজুুদ্দিন নামের এক দুর্ধর্ষ লোক বাস করতো (শ্রীরামকান্দি গ্রামে)। তিনি রানীরাসমনি স্টেটের পক্ষ নিয়েছিলেন। সে ভালো যোদ্ধা ছিল। রাসমনি ও শেখদের লোকদের মাঝে মারামরিতে সে আহত হয় এবং পরে মারা যায়। এতে মামলা হয়। শেখদের সকলেই গেফতার হয় এবং বহু অর্থ খরচ করে হাইকোর্ট হতে মুক্তি পায় (পৃ-৫)।।
ভূক্তি-২০ কাজী বংশ (টুঙ্গিপাড়া শেখ বাড়ির পাশেই) এদের সাথে শেখদের আত্মীয়তাও আছে। আছে রেষারেষি। (এরা শেখদের তুলনায় দুর্বল-অর্থ-সম্পদ ও জনসম্পদে) কাজীদের একটি অংশ রানী রাসমনির সাথে যোগদান করে (এরা কোন ভাবেই শেখদের সহ্য করতে পারতো না (পৃষ্ঠা-৫)।
ভূক্তি-২১ সেরাজতুল্লা কাজী (বৃদ্ধ) এর তিন ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেরা অর্থের লোভে তাকে গলাটিপে হত্যা করে শেখ বাড়ির গরুর ঘরের চালের উপর রেখে যায়। এরপর এরাই থানায় খবর দিয়ে শেখ বাড়ীর সকলকে গ্রেফতার করায় (পৃ-৬)।
ভূক্তি-২২ শেখ মুজিবের দাদার চাচা ও রেনুর দাদার বাবা কলকাতা হতে দেউলিয়া হয়ে বাড়ীতে আসেন (পৃ-৬)।
ভূক্তি-২৩ বড় বড় ব্যবসায়ী, মালিক ও ব্যাপারীরা এই সুযোগে নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে উধাও হতে শুরু করলেন (পৃ-৬)।
ভূক্তি-২৪ তজিমুদ্দিনের খুনের মামলা ও জমিদারী নিলাম হয়ে সবই চলে গেল (পৃ-৬)।
ভূক্তি-২৫ নিচের কোর্টে সবার জেল হয়ে গেল (শেখ পরিবারের-তমিজুদ্দিন হত্যা মামলায়) (পৃ-৬)।
ভূক্তি-২৬ কলকাতা হাইকোর্টে মামলা শুরু হলো। শেখদের এডভোকেট সিআইডি দ্বারা মামলা ইনকোয়ারী করাতে হাইকোর্টে আবেদন করলেন (পৃ-৬)।
ভূক্তি-২৭ একজন অফিসার পাগল সেজে শেখ মুজিবের গ্রামে আসে আর যায় (তমিজুদ্দিন হত্যা মামলার তদন্তে সিআইডি অফিসার) (পৃ-৬)।
ভূক্তি- ২৮ তিন ভাই ও বোনকে (তমিজুদ্দিনের সন্তান) সিআইডি গ্রেফতার করেন। ওদের যাবজ্জীবন জেল হলো আর শেখরা মুক্তি পেল। কিন্তু শেখরা মামলা করে বাঁচলেও সর্বশান্ত হয়ে বাঁচলো (পৃ-৬)।
ভূক্তি-২৯ শেখ বংশে ব্যবসা নাই। জমিদারী নাই। সামান্য তালুক ও খাসজমি নিয়ে শেখ বংশ বেঁচে রইলো (পৃ-৬)।
ভূক্তি- ৩০ খাবার-পরার কষ্ট ছিল না বলে শেখ মুজিবের দাদার বাবা চাচারা পাশা খেলে দিন কাটাতেন (বাড়িতে)। তারা দিনভর দাবা ও পাশা খেলতেন (পৃ-৬)।
ভূক্তি-৩১ শেখ মুজিবের দাদার বাবা চাচারা ফার্সী ভাষা জানতেন এবং বাংলা ভাষার উপরও দখল ছিল (পৃ-৬)।
ভূক্তি-৩২ রেণুর দাদা শেখ মুজিবের দাদার চাচাতো ভাই। তিনি বাংলা ভাষায় তাঁর জীবনী লিখে রেখে গিয়েছিলেন(পৃ-৬)।
ভূক্তি-৩৩ রেণুও তাঁর দাদার লিখিত জীবনীর কয়েকটি পাতা হাতে পেয়েছিলেন (পৃ-৬)।
ভূক্তি-৩৪ রেণুর দাদা তাঁর সমস্ত সম্পত্তি রেনু ও তার বোনকে লিখে দিয়ে যান (পৃ-৬)।
ভূক্তি-৩৫ রেণুর বাবা মানে শেখ মুজিবের শ্বশুর ও চাচা তার বাবার সামনেই মারা যান (বাবার আগে ছেলের মৃত্যু) (পৃ-৬)।
ভূক্তি-৩৬ মুসলিম আইন অনুযায়ী রেনু তার বাবার সম্পত্তি পায় না। রেণুর কোনো চাচা না থাকাতে তাঁর দাদা রেণুর নামে সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান (পৃ-৬)।
ভূক্তি-৩৭ ইংরেজকে গ্রহণ করতে না পারায় এবং ইংরেজি না পড়ায় শেখরা অনেক পেছনে পড়ে গেল (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৩৮ শেখ মুজিবের দাদাদের আমল হতে শেখ পরিবার ইংরেজি লেখা-পড়া শুরু করেন (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৩৯ শেখ মুজিবের দাদার বড় ভাই খুব বিচক্ষন ছিলেন। তিনি বিচার-আচার করতেন (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৪০ শেখ মুজিবের দাদা হঠাৎ মারা যান। (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৪১ শেখ মুজিবের বড় চাচা এন্ট্রান্স পাস করে মারা যান (শেখ মুজিবের আব্বা তখন এন্ট্রান্স পড়েন) (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৪২ শেখ মুজিবের দাদার বড় ভাইয়ের কোনো ছেলের ছিল না। তার চার মেয়ে ছিল (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৪৩ শেখ মুজিবের বাবার সাথে তিনি (শেখ মুজিবের দাদার বড় ভাই) তার ছোট মেয়ের বিয়ে দেন এবং সমস্ত সম্পত্তি শেখ মুজিবের মাকে লিখে দেন (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৪৪ শেখ মুজিবের নানার নাম শেখ আবদুল মজিদ (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৪৫ শেখ মুজিবের দাদার নাম শেখ আবদুল হামিদ (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৪৬ শেখ মুজিবের ছোট দাদার নাম শেখ আব্দুর রশিদ। তিনি ইংরেজদের দেয়া ‘খান সাহেব’ উপাধি পান। জনগন তাকে ‘খান সাহেব’ বলেই জানতেন। (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৪৭ শেখ মুজিবের দুই চাচার লেখা-পড়া ফুফুদের বিবাহ সংক্রান্ত দায়িত্ব নিয়ে শেখ মুজিবের বাবা লেখা-পড়া ছেড়ে চাকুরির খোজে বের হন (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৪৮ শেখ মুজিবের বাবা দেওয়ানি আদালতে একটি চাকরি পান। পরে তিনি সেরেস্তাদার হয়েছিলেন (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৪৯ যেদিন ম্যাট্রিক পাস করে শেখ মুজিব কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যান সেদিন তাঁর বাবাও পেনশন নিয়ে বাড়ি চলে যান (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৫০ যখন শেখ মুজিবুরের বিয়ে তখন তাঁর বয়স বার/তের বছর। রেণুর বাবা মারা যাওয়ার পরে ওর দাদা শেখ মুজিবের বাবাকে ডেকে বললেন, ‘‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব” (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৫১ রেণুর দাদা শেখ মুজিবের বাবার চাচা (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৫২ মুরুব্বির হুকুম মানতেই রেনুর সাথে শেখ মুজিবের বিবাহ রেজিষ্ট্রী হয়ে গেল (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৫৩ বিবাহের সময় রেণুর বয়স তিন বছর হবে (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৫৪ পাঁচ বছর বয়সে রেণুর মা মারা যান (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৫৫ রেণুর একমাত্র ভরসা রইলো দাদা (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৫৬ রেণুর সাত বছর বয়সে ওর দাদাও মারা যান (পৃ-৭)।
ভূক্তি-৫৭ দাদা মারা যাওয়ার পরে রেণু শেখ মুজিবের মার কাছে চলে আসে (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৫৮ শেখ মুজিবুরের ভাই বোনদের সাথে রেণু বড় হয় (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৫৯ রেণুর বড় বোনেরবিয়ে হয় শেখ মুজিবের আরেক চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয় (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৬০ রেণুদের বাড়ি আর শেখ মুজিবুরের বাড়ি ছিল পাশাপাশি মাত্র দুই হাত ব্যবধান (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৬১ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। তার বাবার নাম শেখ লুৎফর রহমান (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৬২ শেখ মুজিবের ছোট দাদা খান সাহেব শেখ আবদুর রশিদ একটি এম ই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই সে এলাকার প্রথম ইংরেজি স্কুল। পরে সেটি হাই স্কুল হয়েছিল (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৬৩ শেখ মুজিব তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত এম ই স্কুলে পড়েন। চতুর্থ শ্রেনীতে ভর্তি হন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে (তার বাবার সাথে গিয়ে) (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৬৪ শেখ মুজিবের মায়ের নাম সায়েরা খাতুন (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৬৫ শেখ মুজিবের মা কোনদিন তাঁর বাবার সাথে শহরে থাকতেন না (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৬৬ বাবার কাছে থেকে শেখ মুজিব লেখাপড়া করেছেন। বাবার গলা ধরে রাতে ঘুমাতেন। গলা না ধরলে শেখ মুজিবের ঘুম আসতো না (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৬৭ শেখ মুজিব ছিলেন বংশের বড় ছেলে (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৬৮ শেখ মুজিবের মেজো চাচারও কোনো ছেলে মেয়ে ছিল না (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৬৯ শেখ মুজিবের ছোট দাদার একমাত্র ছেলে (খান সাহেব) আইয়ুব সাহেবের আমলে প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য ছিলেন। ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডেরও সদস্য ছিলেন তিনি। তার নাম শেখ মোশাররফ হোসেন (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৭০ ১৯৩৪ সালে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় শেখ মুজিব খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তিনি খুব দুষ্টু প্রকৃতির ছিলেন। তিনি খেলাধুলা করতেন, গান গাইতেন। হঠাৎ তিনি বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। এতে শেখ মুজিবের হার্ট দুর্বল হয়ে পড়ে (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৭১ চিকিৎসার জন্য শেখ মুজিবের বাবা তাকে কলকাতায় নিয়ে যান (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৭২ ডা. শিবপদ ভট্টাচার্য, এ কে রায় চৌধুরী সহ অনেক ডাক্তারই শেখ মুজিবকে দেখেন এবং চিকিৎসা করেন। এভাবে প্রায় দুই বছর কেটে যায় (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৭৩ ১৯৩৬ সালে শেখ মুজিবের বাবা শেখ লুৎফর রহমান মাদারীপুর মহকুমায় সেরেস্তাদার হয়ে বদলি হয়ে যান। ছেলের অসুস্থতার জন্য শেখ মুজিবের মা-ও সেখানে যান (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৭৪ ১৯৩৬ সালে পুনরায় শেখ মুজিবের চোখ খারাপ হয়ে যায়। গ্লুকোমা নামে একটি রোগ হয়। শেখ লুৎফর রহমান ডাক্তারদের পরামর্শে ছেলেকে নিয়ে আবার কলকাতায় চলে যান। তখন শেখ মুজিব মাদারীপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন (পৃ-৮)।
ভূক্তি-৭৫ কলকাতার ডা. টি আহমদ শেখ মুজিবকে দেখেন (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৭৬ শেখ মুজিবের মেজো বোন কলকাতায় থাকতেন (তিনি শেখ ফজলুল হক মনির মা)। মনির বাবাও শেখ বংশের লোক। শেখ মুজিব তখন বোনের কাছেই থাকতেন (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৭৭ কলকাতা মেডিক্যালে শেখ মুজিবকে ভর্তি করা হল। চোখের অপারেশন হবে। তিনি ভয়ে পালাতে চেষ্টা করে পালাতে পারলেন না। দশ দিনের মধ্যে দুইটা চক্ষুই অপারেশন হলো (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৭৮ ১৯৩৬ সাল হতে (চোখের অপারেশনের পরে) শেখ মুজিব চশমা ব্যবহার করেন (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৭৯ চোখের চিকিৎসার পরে শেখ মুজিব মাদারীপুরে ফিরে আসেন (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৮০ তখন শেখ মুজিবের কোন কাজ নেই, লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই। একটাই কাজ বিকালে সভায় যাওয়া (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৮১ তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৮২ মাদারীপুরের পূর্ণদাস তখন ইংরেজদের আতঙ্ক (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৮৩ স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৮৪ শেখ মুজিবের মতে তখন মাদারীপুরে সুভাষ বোসের দলই শক্তিশালী ছিল (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৮৫ পনের-ষোল বছরের ছেলেদের স্বদেশীরা দলে বেড়াতো (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৮৬ শেখ মুজিব সভায় যেতে যেতে সুভাষ বাবুর ভক্ত হয়ে গেলেন (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৮৭ শেখ মুজিব স্বদেশী আন্দোলনের সভায় যোগ দিতে গোপালগঞ্জ-মাদারীপুরে যাতায়াত করতে লাগলেন এবং স্বদেশী আন্দোলনের লোকদের সাথে মেলামেশা করতে লাগলেন (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৮৮ গোপালগঞ্জের সেই সময়ের এসডিও শেখ মুজিবের দাদা খান সাহেবকে একদিন হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন (শেখ মুজিবের ব্যাপারে) (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৮৯ ১৯৩৭ সালে শেখ মুজিব আবার লেখাপড়া শুরু করেন (পৃ-৯)
ভূক্তি-৯০ এবার শেখ মুজিবের বাবা তাকে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি করে দেন (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৯১ এ সময় কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি মাস্টার শেখ মুজিবকে বাসায় পড়াতেন (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৯২ মাস্টার সাহেব ( শেখ মুজিবের) গোপালগঞ্জে মুসলিম সেবা সমিতি গঠন করেন যার দ্বারা তিনি গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৯৩ মাস্টার সাহেব মুসলমানদের বাড়ি হতে মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৯৪ প্রতি রবিবার শেখ মুজিব অন্যদের সাথে থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি হতে চাল উঠাতেন এবং সেই চাল বিক্রি করে গরীব ছেলেদের বই ও পরীক্ষার খরচের ব্যবস্থা করতেন (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৯৫ মাস্টার সাহেব ঘুরে ঘুরে ছাত্রদের জায়গিরও ঠিক করে দিতেন। শেখ মুজিব মাস্টারের সাথে থাকতেন (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৯৬ হঠাৎ যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে মাষ্টার সাহেব মারা যান (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৯৭ তখন শেখ মুজিব সেবা সমিতি’র ভার নেন এবং অনেকদিন পরিচালনা করেন। এ সময় অন্য একজন মুসলমান মাষ্টার ছিলেন সভাপতি আর শেখ মুজিব ছিলেন সম্পাদক (পৃ-৯)।
ভূক্তি-৯৮ কোনো মুসলমান চাল না দিলে তার বাড়িতে রাতে ইট মারা হতো। এ কারনে শেখ মুজিবের বাবা অনক সময় শেখ মুুজিবকে শাস্তি দিতেন। তবে শেখ লুৎফর রহমান ছেলেকে বাধা দিতেন না (পৃ-১০)।
ভূক্তি-৯৯ শেখ মুজিব খেলায় ভালো না হলেও ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতেন (পৃ-১০)।
ভূক্তি-১০০ শেখ মুজিবের বাবা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সহগাত পত্রিকা আসতো (পৃ-১০)।
ভূক্তি-১০১ ছোটবেলা হতে শেখ মুজিব সকল কাগজই পড়তেন (পৃ-১০)।
ভূক্তি-১০২ রোগের কারণে চার বছর শেখ মুজিব পড়াশোনা করতে না পারায় সহপাঠীদের চেয়ে তার বয়স একটু বেশিই ছিল (পৃ-১০)।
ভূক্তি-১০৩ শেখ মুজিবের একটি দল ছিল এবং তিনি ভীষণ একগুয়ে ছিলেন। তিনি মারপিট করতেন (পৃ-১০)।
ভূক্তি-১০৪ শেখ মুজিবের নামে নালিশ হতো (পৃ-১০)।
ভূক্তি-১০৫ বাবাকে শেখ মুজিব খুব ভয় পেতেন (পৃ-১০)।
ভূক্তি-১০৬ আবদুল হাকিম মিয়াকে-ও শেখ মুজিব ভয় করতেন। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবের বাবার অন্তরঙ্গ বন্ধু ও সহকর্মী (পৃ-১০)।
ভূক্তি-১০৭ তখন গোপালগঞ্জের এম এল এ ছিলেন খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদ সাহেব। তিনি নামকরা উকিল ছিলেন। তিনি শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টির সদস্য ছিলেন (পৃ-১০)।
ভূক্তি-১০৮ হক সাহেব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং মুসলিম লীগে যোদদান করলেন। খন্দকার সাহেবও মুসলিম লীগে যোগ দিলেন। মুসলিম লীগ তখন কাগজে কলমে ছিল (পৃ-১০)।
ভূক্তি-১০৯ ১৯৩৮ সালের কথা। শেরে বাংলা তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী আর সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। উনারা গোপালগঞ্জে আসবেন। শেখ মুজিব তখন স্কুলের ছাত্র (পৃ-১০) ।
ভূক্তি-১১০ শেরে বাংলা এবং সোহরাওয়াদীর আসা উপলক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবক গঠনের ভার পড়ল শেখ মুজিবের উপর (পৃ-১১)।
ভূক্তি-১১১ মুকন্দবিহারী মল্লিক তখন মন্ত্রী ছিলেন এবং তিনিও হক সাহেবের সাথে আসবেন (পৃ-১১)।
ভূক্তি-১১২ হক সাহেব পাবলিক হল দেখতে গেলেন। আর শহীদ সাহেব গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। শেখ মুজিব তখন মিশন স্কুলের ছাত্র (পৃ-১১)।
ভূক্তি-১১৩ মিশন স্কুল পরিদর্শন শেষ শহীদ সাহেব নোট বুকে শেখ মুজিবের নাম ও ঠিকানা লিখে নিলেন (পৃ-১১) ।
ভূক্তি-১১৪ কিছুদিন পরে শেখ মুজিব শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চিঠি পেলেন। শহীদ সাহেব পত্রে শেখ মুজিবকে ধন্যবাদ জনিয়ে কোলকাতা গেলে তার সাথে দেখা করতে বলেছেন (পৃ-১১)।
ভূক্তি-১১৫ শেখ মুজিব শহীদ সাহেবের চিঠির উত্তর দিলেন। এরপর মাঝে মাঝে মহীদ সাহেবকে চিঠি লিখতেন (পৃ-১১)।
ভূক্তি-১১৬ মালেককে (শেখ মুজিবের সহপাঠী) হিন্দু মহাসভার সভাপতি সুরেন ব্যনাজির বাড়িতে ধরে নিয়ে মারপিট করে। শেখ মুজিব তার বন্ধুদের নিয়ে মালেককে উদ্ধার করতে যান (পৃ-১২)।
ভূক্তি-১১৭ শেখ মুজিব মালেককে ছেড়ে দিতে বললে রমাকান্ত দত্ত তাকে গালি দিয়ে বসেন। এক পর্যায়ে মারামারি শুরু হয় (দু’পক্ষে)। অবশেষ দরজা ভেঙ্গে শেখ মুজিবের দল মালেককে উদ্ধার করে নিয়ে আসে (পৃ-১২)।
ভূক্তি-১১৮ শেখ মুজিবের বাড়ি গোপালগঞ্জ হতে চৌদ্দ মাইল দূরে (পৃ-১২)।
ভূক্তি-১১৯ শেখ মুজিবের নামে খুন করার চেষ্টা ও লুটপাট-দাঙ্গাহাঙ্গামা লাগানোর মামলা হলো (পৃ-১২)।
ভূক্তি-১২০ শেখ মুজিবের ফুফাতো ভাই তাকে পালানোর পরামর্শ দিলে তিনি বললেন ‘‘যাব না’’ আমি পালাব না। লোকে বলবে, আমি ভয় পেয়েছি’’ (পৃ-১২)।
ভূক্তি-১২১ দারোগা সাহেব গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখালে শেখ মুজিবের বাবা বললেন, ‘‘নিয়ে যান’’ (পৃ-১২)।
ভূক্তি-১২২ সাত দিন পরে (জেলে থাকার) শেখ মুজিব জামিন পেলেন (পৃ-১৩)।
ভূক্তি-১২৩ হক সাহেব এবং সোহরাওয়াদী সাহেবের কাছে টেলিগ্রাম করা হলো। লোকও চলে গেল। গোপালগঞ্জে ভীষন উত্তেজনা চলছিল (পৃ-১৩)।
ভূক্তি-১২৪ পনের মশ টাকা ক্ষতিপূরণ মামলা আপোশ করা হলো। শেখ মুজিবের বাবাকেই বেশী টাকা দিতে হয়েছিল। এটিই শেখ মুজিবুর রহমান এর জীবনে প্রথম জেল। ঘটনাটি ১৯৩৮ সালের (পৃ-১৩)।
ভূক্তি-১২৪ ১৯৩৯ সালে শেখ মুজিব কলকাতা বেড়াতে যান (পৃ-১৩)।
ভূক্তি-১২৬ তিনি শহীদ সহেবের সাথে দেখা করেন। দেখা করেন ছাত্রদের নেতা আবদুল ওয়াসেফ সাহেবের সাথেও (পৃ-১৩)।
ভূক্তি-১২৭ মুসলিম ছাত্রীগ গঠিত হল। খন্দকার শামসুদ্দিন সাহেব এমএলএ হলেন সভাপতি। শেখ মুজিব হলেন মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক। এছাড়া মুসলিম লীগ ডিফেন্স কমিটিও গঠিত হল। শেখ মুজিব হলেন এর সেক্রেটারী (পৃ-১৪)।
ভূক্তি-১২৮ স্কুলে শেখ মুজিব ক্যাপ্টেন ছিলেন (পৃ-১৪)।
ভূক্তি-১২৯ স্কুলে থাকতে শেখ মুজিবের হার্টের ব্যারাম হয়েছিল (পৃ-১৪)।
ভূক্তি-১৩০ শেখ মুজিবের বাবা ভাল খেলোয়ার ছিলেন। তিনি অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারী ছিলেন (পৃ-১৪)।
ভূক্তি-১৩১ শেখ মুজিব মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলেন (পৃ-১৪)।
ভূক্তি-১৩২ মহকুমার ভাল খেলোয়ারদের শেখ মুজিব তার স্কুলে এনে ভর্তি করে বেতন ফ্রি করে দিতেন (পৃ-১৪)।
ভূক্তি-১৩৩ ১৯৪০ সালে শেখ লুৎফর রহমানের (শেখ মুজিবের বাবা) টিমকে শেখ মুজিবের টিম প্রায় সকল খেলায় পরাজিত করল (পৃ-১৪)।
ভূক্তি-১৩৪ তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন বাবু রসরঞ্জন সেনগুপ্ত। তিনি শেখ মুজিবকে প্রাইভেটও পড়াতেন (পৃ-১৪)।
ভূক্তি-১৩৫ এ জেড খান শিল্ডের (এসডিও) ফাইনাল খেলায় শেখ লুৎফর রহমানের টিমের কাছে শেখ মুজিবের টিম এক গোলে হেরে গেল (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৩৬ ১৯৪১ সালে শেখ মুজিবের ম্যাট্রিক পরীক্ষা (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৩৭ রসরঞ্জন বাবু শেখ মুজিবের ইংরেজি শিক্ষক আর মনোরঞ্জন বাবু অঙ্কের শিক্ষক (ম্যাট্রিকের সময়) (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৩৮ অঙ্ককে শেখ মুজিবের ভয় ছিল। তিনি ভুল করে ফেলতেন (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৩৯ ম্যাট্রিক পরীক্ষার একদিন আগে শেখ মুজিবের জ্বর হলো (১০৪ ডিগ্রী) এবং মামস হয়ে গলা ফুলে গেল (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৪০ প্রথম দিনের বাংলা পরীক্ষায় শেখ মুজিব মাথাই তুলতে পারলেন না (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৪১ শেখ মুজিব বাংলায় কম নম্বর পেলেও অন্যান্য বিষয়ে দ্বিতীয় বিভাগের মার্কস পেয়েছিলেন। এতে তার মন ভেঙ্গে যায় (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৪২ তখন শেখ মুজিব ভীষণ ভাবে রাজনীতি শুরু করেছেন। সভা করেন, বক্তৃতা দেন (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৪৩ খেলার দিকে আর শেখ মুজিবের নজর নেই (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৪৪ শেখ মুজিব তখন মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগ নিয়েই ব্যস্ত। তার ভাবনা পাকিস্তান আনতেই হবে; নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৪৫ খবরের কাগজ ‘‘আজাদ’’ যা লেখে তাই শেখ মুজিবের কাছে সত্য বলে মনে হয় (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৪৬ ১৯৪১ সালে ম্যাট্টিক পরীক্ষা দিয়ে শেখ মুজিব কলকাতায় যান। সভা-সমাবেশে যোগদান করেন (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৪৭ মাদারীপুর গিয়ে তিনি মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৪৮ তখন শহীদ সাবেবের কাছে প্রায়ই যান তিনি (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৪৯ শহীদ সাহেবও শেখ মুজিবকে ¯েœহ করেন (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৫০ তখন মুসলিম লীগ বললেই গোপালগঞ্জে শেখ মুজিবকে বোঝাতো (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৫১ তখন যুদ্ধের সময়। দেশের অবস্থা ভয়াবহ (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৫২ সে সময় ফজলুল হক সাহেবের সাথে জিন্নাহ সাহেবের মনোমালিন্য হয় (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৫৩ হক সাহেব জিন্নাহ সাহেবের হুকুম মানতে রাজী না হওয়ায় তিনি মুসলিম লীগ ত্যাগ করে নয়া মন্ত্রিসভা গঠন করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৫৪ মুসলিম লীগ ও ছাত্রকর্মীরা হক সাহেবের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলো (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৫৫ শেখ মুজিবও সে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৫৬ ১৯৪১ সালে শেখ মুজিব দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্টিক পাস করে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হলেন। থাকতেন বেকার হোটেলে (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৫৭ নাটোর ও বালুরঘাটে হক সাহেবের দলের সাথে মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থীদের দুটি উপ-নির্বাচন হয়। শহীদ সাহেবের হুকুম মত শেখ মুজিব তার দলবল নিয়ে সেখানে হাজির হলেন এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করলেন (পৃ-১৫)।
ভূক্তি-১৫৮ ফরিদপুরে ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স (১৯৪১ সালের মধ্যেই হবে)। এতে শিক্ষাবিদদের অমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এরা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ূন কবীর এবং ইব্রাহিম খাঁ সাহেব (পৃ-১৬)।
ভূক্তি-১৫৯ ১৪৪ ধারা জারি করে সে সভা করতে দেয়া না হলে সভাটি হলো হুমায়ূন কবির সাহেবের বাড়িতে। এতে কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন (পৃ-১৬)।
ভূক্তি-১৬০ ১৯৪২ সালে শেখ মুজিব ফরিদপুরে গিয়ে ছাত্রদের দুটি দলের ভেদাভেদ মিটিয়ে দিলেন (পৃ-১৬)।
ভূক্তি-১৬১ তখন মোহন মিয়া সাহেব ও সালাম খান জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন (পৃ-১৬)।
ভূক্তি-১৬২ ১৯৪২ সালে মিস্টার জিন্নাহ’র বাংলাদেশে আসার কথা (প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কনফারেন্সে যোগদান করতে) (পৃ-১৬)।
ভূক্তি-১৬৩ সে সম্মেলন হলো পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমায় (পৃ-১৬)।
ভূক্তি-১৬৪ শেখ মুজিব অধিকাংশ সময় শহীদ সাহেবের কাছে কাছে থাকার চেষ্টা করতেন (পৃ-১৬)।
ভূক্তি-১৬৫ আনোয়ার সাহেব তখন ছাত্রদের অন্যতম নেতা। তাঁর সাথে শেখ মুজিবের কলকাতায় পরিচয় হয়। শহীদ সাহেব আনোয়ার সাহেবকে খুব ভালোবাসতেন। (পৃ-১৬)।
ভূক্তি-১৬৬ চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরীও তখন ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতা ছিলেন। ওয়াসেফ সাহেব এবং ফজলুল কাদের চৌধুরীর সাথে গোলমাল লেগেই থাকতো (পৃ-১৬)।
ভূক্তি-১৬৭ ওয়াসেফ সাহেব বহুদিন ‘অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগ’ এর সভাপতি ছিলেন (পৃ-১৬)।
ভূক্তি-১৬৮ তিনি (ওয়াসেফসাহেব) ছাত্রজীবন শেষ করেছিলেন সম্ভবত পনের বছর আগে (পৃ-১৬)।
ভূক্তি-১৬৯ ১৯৪১ বা ১৯৪২ সালে চুঁচুঁড়া সম্মেলনে ওয়াসেফ সাহেবের সভাপতি পদে থাকা নিয়ে গোলমাল হয়। ফজলুল কাদের চৌধুরী ও শেখ মুজিব ওয়াসেফ সাহেবের সভাপতি থাকার বিষয়টি সমর্থন করলেন না। শেষ পর্যন্ত শহীদ সাহেবের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয় (পৃ-১৬)।
ভূক্তি-১৭০ শেখ মুজিব ও তার সহকর্মীরা ফজলুল কাদের চৌধুরীর দলকে সমর্থন করে চুঁচুঁড়ার সম্মেলন থেকে বেরিয়ে এলেন (পৃ-১৬)।
ভূক্তি-১৭১ অল ইন্ডিয়া মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন মাহমুদাবাদের রাজা সাহেব (পৃ-১৬)।
ভূক্তি-১৭২ সে সময় শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজে খুই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন (পৃ-১৬)।
ভূক্তি-১৭৩ ইসলামিয়া কলেজই তখন ছিল বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র (পৃ-১৬)।
ভূক্তি-১৭৪ বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় কলেজ ছাত্র ইউনিয়ন ইলেকশন হতো। শেখ মুজিব ছাত্রনেতাদের সাথে আলোচনা করে যাঁদের ঠিক করে দিতেন তারাই নমিনেশন দাখিল করতো (পৃ-১৭)।
ভূক্তি-১৭৫ শেখ মুজিবের মতের বিরুদ্ধে কারো জিতার স¤া¢বনা থাকতো না (পৃ-১৭)।
ভূক্তি-১৭৬ কলকাতার বাসিন্দা ও ছাত্রদের উপর প্রভাব থাকা জহিরুদ্দিন শেখ মুজিবকে সাহায্য করতো। নিঃস্বার্থ কর্মী জহিরুদ্দিনকে সবাই শ্রদ্ধা করতো (পৃ-১৭)।
ভূক্তি-১৭৭জহিরুদ্দিন ইংরেজি, বাংলা ও উর্দুতে চমৎকার বর্ক্তৃতা করতে পারত। জহির পরবর্তীতে ইসলামিয়া কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিল। কিছুকাল জহির ঢাকায় রেডিও তে চাকুরিও করে (পৃ-১৭)।
ভূক্তি-১৭৮ ১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। তাতে লক্ষ লক্ষ লোক মারা যায়। সে সময় শেখ মুজিব প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য হন (পৃ-১৭)।
ভূক্তি-১৭৯ এ সময় মুসলিম লীগের মধ্যে দুটি দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। একটি প্রগতিশীল দল অন্যটি প্রতিক্রিয়াশীল (পৃ-১৭)।
ভূক্তি-১৮০ শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে শেখ মুজিব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেনীর লোকদের নিয়ে মুসলিম লীগকে জনগনের লীগে পরিণত করতে চান (পৃ-১৭)।
ভূক্তি-১৮১ মুসলিম লীগ তখন ছিল জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুর নবাবদের প্রতিষ্ঠান (পৃ-১৭)।
ভূক্তি-১৮২ জেলায় জেলায় খান বাহাদুরের দলেরাই মুসলিম লীগকে পকেটে করে রেখেছিল (পৃ-১৭)।
ভূক্তি-১৮৩ খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেবের নেতৃত্বে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ঢাকার এক খাজা বংশের এগারজন এম এল এ হয়েছিলেন (পৃ-১৭)।
ভূক্তি-১৮৪ ১৯৪৩ সালে খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব প্রধানমন্ত্রী হয়ে তাঁর ছোট ভাই খাজা শাহাবুদ্দীন সাহেবকে শিল্পমন্ত্রী করেছিলেন (পৃ-১৭)।
ভূক্তি-১৮৫ শেখ মুজিব সহ অন্যরা বাধা দিলেন। তিনি শুনলেন না (পৃ-১৭)।
ভূক্তি-১৮৬ শহীদ সাহেবের কাছে শেখ মুজিব সহ অন্যরা খাজা শাহাবুদ্দীন এর ব্যাপারে প্রতিবাদ করলেও তিনি কিছু বললেন না (পৃ-১৭)।
ভূক্তি-১৮৭ সোহরাওয়ার্দী সাহেব তখন হলেন সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী (পৃ-১৭)।
ভূক্তি-১৮৮ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। গ্রাম থেকে লাখ লাখ মানুষ শহরের দিকে ছুটছে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে। খাবার নাই। কাপড় নাই। ইংরেজরা যুদ্ধের জন্য সমস্ত নৌকা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে। ধান, চাল সৈন্যদের খাওয়ার জন্য গুদাম জব্দ করেছে। যা কিছু ছিল ব্যবসায়ীরা গুদামজাত করেছে। ফলে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়ীরা দশ টাকা মনের চাল চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করছে। এমন দিন নাই রাস্তায় লোকদের মরে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। শেখ মুজিব অন্যদের নিয়ে শহীদ সাহেবকে বললেন, ‘‘কিছুতেই জনসাধারণকে বাঁচাতে পারবেন না, মিছিমিছি বদনাম নেবেন”। তিনি বললেন ‘‘দেখি চেষ্টা করে কিছু করায় যায় কি না, কিছু লোক তো বাঁচাতে চেষ্টা করব” (পৃ-১৭)।
ভূক্তি-১৮৯ মা মরে পড়ে আছে, ছোট বাচ্চা সেই মরা মায়ের দুধ চাটছে। কুকুর ও মানুষ একসাথে ডাস্টবিন থেকে কিছু খাবার জন্য কাড়াকাড়ি করছে। ছেলে-মেয়েদের রাস্তায় ফেলে দিয়ে মা কোথায় পালিয়ে যাচ্ছে। পেটের দায়ে নিজের ছেলেমেয়ে কে বিক্রির চেষ্টা করছে। কেউ কিনতেও রাজী হতো না। বাড়ির দুয়ারে এসে চিৎকার করেছে, ‘‘মা বাঁচাও, কিছু খেতে দাও, মরে তো গেলাম; আর পারিনা, একটু ফেন দাও”। এ কথা বলতে বলতেই পড়ে মরে গেছে (পৃ-১৮)।
ভূক্তি-১৯০ এমন অবস্থায় শেখ মুজিব ও তার দল হোস্টেলে যা বাঁচে তা দুপুরে ও রাতে বুডুক্ষদের বসিয়ে ভাগকরে দেন (পৃ-১৮)।
ভূক্তি-১৯১ এ সময় শহীদ সাহেব লঙ্গরখানা খোলায় হুকুম দিলেন। শেখ মুজিব লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন (পৃ-১৮)।
ভূক্তি-১৯২ শেখ মুজিব অনেকগুলি নাঙ্গরেখানা খুললেন। তিনি দিনে একবার করে খাবার দিতেন (পৃ-১৮)।
ভূক্তি-১৯৩ মুসলিম লীগ অফিসে, কলকাতা মাদ্রাসায় এবং আরও অনেক জায়গায় শেখ মুজিব লাঙ্গরখানা খুললেন। তিনি দিন রাত কাজ করতেন। কোনদিন তিনি রাতে বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতেন আবার কোনোদিন লীগ অফিসের টেবিলেই শুয়ে থাকতেন (পৃ-১৮)।
ভূক্তি-১৯৪ বেকার হোস্টেলে সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন প্রফেসর সাইদুর রহমান সাহেব (বহু পরে ঢাকার জগন্নাথ কলেজের প্রিন্সিপাল হন)। তিনি শেখ মুজিবকে খুব ¯েœহ করতেন। হোস্টেল রাজনীতি ও ইলেকশনে যোগদান করার সময় শেখ মুজিবের ছিলনা। তবুও প্রফেসর সাইদুর রহমান শেখ মুজিবের সাথে পরামর্শ করতেন (পৃ-১৮)।
ভূক্তি-১৯৫ ইসলামিয়া কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন ড. আই. এইচ. জুবেয়ী। তিনিও শেখ মুজিবকে অত্যন্ত ¯েœহ করতেন (পৃ-১৮)।
ভূক্তি-১৯৬ যে কোনো ব্যাপারে শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ড. জুবেয়ী ও হোস্টেল সুপার প্রফেসর সাইদুর রহমানের সাথে সোজাসুজি আলাপ করতেন এবং সত্য কথা বলতেন (পৃ-১৮)।
ভূক্তি-১৯৭ ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষকরা শেখ মুজিবকে স্নেহ করতেন ((পৃ-১৮)।
ভূক্তি-১৯৮ দরকার হলে কলেজের এ্যাসেম্বন্সি হলের দরজা খুলে শেখ মুজিব সভা শুরু করতেন। প্রিন্সিপাল সাহেব তা দেখেও দেখতেন না (পৃ-১৮)।
ভূক্তি-১৯৯ মুসলমান প্রফেসররা পাকিস্তান আন্দোলকে সমর্থন করতেন। হিন্দু ও ইউরোপিয়ান টিচাররা চুপ করে থাকতেন। কারণ, সমস্ত ছাত্রই মুসলমান (পৃ-১৮)।
ভূক্তি-২০০ সামান্য কিছু ছাত্র পাকিস্তান বিরোধী ছিল। কিন্তু সাহস করে তারা কথা বলতো না (পৃ-১৮)।
ভূক্তি-২০১ এ সময় রিলিফের কাজ করার জন্য গোলাপগঞ্জে ফিরে আসি (পৃ-১৯)।
ভূক্তি-২০২ ‘‘দক্ষিন বাংলা পাকিস্তান কনফারেন্স”। শেখ মুজিব হলেন অভ্যার্থনা কমিটির চেয়ারম্যান ও যশোর জেলার মোলভী আফসার উদ্দিন মোল্লাকে (বড় ব্যবসায়ী) সম্পাদক করা হল (পৃ-১৯)।
ভূক্তি-২০৩ শেখ মুজিব নেতৃবৃন্দকে নিমন্ত্রণ করতে কলকাতায় গেলেন (পৃ-১৯)।
ভূক্তি-২০৪ শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে এবং তার কথামতো খাজা শাহাবুদ্দীন সাহেবকেও (নিজের অনিচ্ছায়) নিমন্ত্রণ করলেন (পৃ-১৯)।
ভূক্তি-২০৫ তমিজুদ্দিন খান তখন শিক্ষামন্ত্রী। তার বাড়ি ফরিদপুরে। তাঁকেও শেখ মুজিব নিমন্ত্রণ করলেন এবং তিনি রাজী হলেন। মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ও হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী সাহেবকে শেখ মুজিব নিমন্ত্রণ করলেন (পৃ-১৯)।
ভূক্তি-২০৬ মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী (লাল মিয়া) তখন কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছেন। শেখ মুজিব তাঁর সাথেই রিলিফের কাজ করতেন। লাল মিয়া যথেষ্ট টাকা, ঔষধ ও কাপড় জোগাড় করেছিলেন (পৃ-১৯)।
ভূক্তি-২০৭ শেখ মুজিব নিজের কাছে কাপড়ের গাঁটও রাখতেন। তিনি কোনো কাজে ‘‘না” বলতেন না (পৃ-১৯)।
ভূক্তি-২০৮ কনফারেন্সের অতিথিদের খাবারের ভার শেখ মুজিবের বাবা নিলেন (পৃ-২০)।
ভূক্তি-২০৯ নৌকার বাদাম দিয়ে প্যান্ডেল করা হলো। পাঁচ হাজার লোকের বসার মতো প্যান্ডেল করা হলো শেখ মুজিবের নেতৃত্বে (পৃ-২০)।
ভূক্তি-২১০ তিনদিন আগে তমিজুদ্দিন সাহেব ও শাহবুদ্দীন সাহেব টেলিগ্রাম করে কনফারেন্স বন্ধ করা যায় কিনা বললেন। শেখ মুজিব বললেন, অসম্ভব (পৃ-২০)।
ভূক্তি-২১১ ওয়াহিদুজ্জামান (সদ্য মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন) হক সাহেবের লোক ছিলেন। তিনি শেখ মুজিবকে সম্মেলনের চেয়ারম্যান ও গোপালগঞ্জে সম্মেলন হওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলেন না। আবার সালাম খানও (জেলার লীগের সম্পাদক) গোপালগঞ্জের মানুষ। তিনিও তার সাথে পরামর্শ না করায় চটে গিয়ে সম্মেলনে নেতাদের না আসতে খবর দিয়েছেন (পৃ-২০)।
ভূক্তি-২১২ সকলকে নিয়ে শেখ মুজিব গোপালগঞ্জে উপস্থিত হলেন। নেতারা বিরাট সংবর্ধনা পেলেন। ‘‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ” ধ্বনিতে গোপালগঞ্জ শহর মুখরিত হলো (পৃ-২০)।
ভূক্তি-২১৩ সম্মেলনের অতিথিদের খাবার বন্দোবস্ত করার জন্য শেখ মুজিবের স্ত্রী ও মা গ্রামের বাড়ি হতে গোপালগঞ্জের বাড়িতে এসেছিলেন তিন দিন আগে (পৃ-২১)।
ভূক্তি-২১৪ শেখ মুজিবের ভয়ানক জ্বর এলো (কনফারেন্সের পরে)। শেখ মুজিবের বাবা আগেও বহু টাকা খরচ করেছেন এই কনফারেন্স উপলক্ষে (পৃ-২১)।
ভূক্তি-২১৫ কনফারেন্স বাদাম ছেড়ার কারণে (ঝড়ে) জনৈক মালিক (৮/১০ টি বাদামের) উকিল নোটিশ পাঠালেও সাহস করে মামলা করতে পারেননি। তিনি যদিও মামলা করতে চেয়েছিলেন (পৃ-২১)।
ভূক্তি-২১৬ শেখ মুজিবের স্ত্রী রেণু কয়েকদিন তাকে খুব সেবা করল (পৃ-২১)।
ভূক্তি-২১৭ ছোটবেলায় শেখ মুজিব ও রেণু বিয়ে হলেও ১৯৪২ সালে উনারা একত্রে বসবাস শুরু করেন (পৃ-২১)।
ভূক্তি-২১৮ এসময় শেখ মুজিবের বাবা তাকে বললেন, ‘‘বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, Ôsincerity of purpose and honesty of purpose’ থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না”। (পৃ-২১)
ভূক্তি-২১৯ শেখ মুজিব বাবার এ পরামর্শ জীবনে ভুলেননি (পৃ-২১)।
ভূক্তি-২২০ গোপালগঞ্জ শহরের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তির পরামর্শের প্রেক্ষিতে শেখ মুজিবের বাবা বলেছিলেন, “দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো অন্যায় করছে না;যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতেও আমি দুঃখ পাব না। জীবনটা নষ্ট নাও তো হতে পারে, আমি ওর কাজে বাধা দিব না। আমার মনে হয়, পাকিস্তান না আনতে পারলে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না” (পৃ-২১)।
ভূক্তি-২২১ শেখ মুজিবের বাবা তাকে হক সাহেবের বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তিগত আক্রমন করতে নিষেধ করেছিলেন। শেখ মুজিবের মা-ও তাকে বলেছিলেন, ‘‘বাবা যাহাই কর, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলিও না” (পৃ-২২)।
ভূক্তি-২২২ হক সাহেবের বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখাতে গেলেই জনগন শেখ মুজিব সহ তার বাহিনীকে মারপিট করেছে। অনেক সময় তিনি ছাত্রদের নিয়ে পালিয়ে এসেছেন মারের ভয় থেকে (পৃ-২২)।
ভূক্তি-২২৩ শেখ মুজিব জনসভায় বলতেন- পিাকিস্তান হবে দুইটা। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে (পৃ-২২)।
ভূক্তি-২২৪ বাংলা ও আসাম নিয়ে হবে ‘পূর্ব পাকিস্তান’। পাঞ্চাব, বেলুচিস্তান, সীমান্ত ও সিন্ধু প্রদেশ নিয়ে হবে পশ্চিম পাকিস্তান। অন্যটা হবে হিন্দুস্তান। হিন্দস্থানে হিন্দুরা সংখ্যাগুরু হলেও সেখানকারমুসলমানরা সমান অধিকার ভোগ করবেন। এসব কথা মুজিব জনগণকে বোঝাতেন (পৃ-২২)।
ভূক্তি-২২৫ শেখ মুজিবের কাছে ভারত বর্ষের একটি ম্যাপ থাকত।এছাড়া হবীবুল্লা বাহার সাহেবের “পাকিস্তান”এবং মুজিবুর রহমান খাঁ সাহেবের “পাকিস্তান” বই দুটি শেখ মুজিবের প্রায় মুখস্তের মত ছিল।এছাড়াও শেখ মুজিবের ব্যাগে থাকত আজাদের কাটিং। (পৃ-২২)।
ভূক্তি-২২৬ সিপাহি বিদ্রোহ এবং ওহাবি আন্দোলনের ইতিহাস শেখ মুজিবের জানা ছিল।(পৃ-২২)।
ভূক্তি-২২৭ তিতুমীরের জেহাদ ও হাজী শরীয়ত উল্লাহর ফারায়াজি আন্দোলন সম¦ন্ধে আলোচনা করে শেখ মুজিব পাকিস্তানে আন্দোলনের ইতিহাস বলতেন।(পৃ-২৩)।
ভূক্তি-২২৮ শেখ মুজিব ভীষণভাবে হিন্দু বেনিয়া ও জমিদারদের আক্রমন করতেন। (পৃ-২৩)।
ভূক্তি-২২৯ একসাথে লেখাপড়া,বল খেলা,বেড়ানোর পরেও যখন শেখ মুজিব তার হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে যেতেন তখন তারা অনেক সময় শেখ মুজিবকে ঘরের মধ্যে নিতে সাহস পেত না।(পৃ-২৩)।
ভূক্তি-২৩০ শেখ মুজিবের বন্ধু ননীকুমার দাস যে শেখ মুজিবের সাথে পড়ত দিনভর তার বাসায় কাটতো এবং গোপনে শেখ মুজিবের সাথে খেত ।ও ওর কাকার বাড়িতে থাকত। একদিন শেখ মুজিব ননীর বাসা হতে বেড়িয়ে আসা মাএই সে শেখ মুজিবের বাসায় এসে হাজির। শেখ মুজিব বললেন,“ননী কি হয়েছে”? কাঁদো কাঁদো স্বরে ননী বলল,তুই আর আমাদের বাসায় যাস না।কারন, তুই চলে আসার পরে কাকীমা আমাকে খুব বকেছে তোকে ঘরে আনার জন্য এবং সমস্ত ঘর আবার পরিস্কার করেছে পানি দিয়ে ও আমাকেও ঘর ধুতে বাধ্য করেছে”।তখন শেখ মুজিব বললেন,“যাব না; তুই আসিস”। (পৃ-২৩)।
ভূক্তি-২৩১ হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ও ইংরেজদের তোষামোদ করে অনেকটা উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়েছিল। (পৃ-২৩)।
ভূক্তি-২৩২আবার হিন্দুরা যখন ইংরেজের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিল তখন অনেকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে মরতে দ্বিধা করে নাই। জীবনভর কারাজীবন ভোগ করেছে,ইংরেজকে তাড়াবার জন্য। (পৃ-২৩)।
ভূক্তি-২৩৩ হিন্দু নেতাদের মধ্যে দেশবন্ধু চিওরঞ্জন দাশ এবং নেতাজী সুভাষ বসু হিন্দু মুসলমানের মধ্যকার বিরাজমান সমস্যা বুঝতে পেরেছিলেন।তারা অনেক সময় হিন্দুদের হুঁশিয়ার করেছেন।কবিগুরুও তাঁর লেখার মাধ্যমে হিন্দুদের সাবধান করেছেন। (পৃ-২৪)।
ভূক্তি-২৩৪ মুসলমান জমিদার ও তালুকদাররা হিন্দু প্রজাদের সাথে একই রকম খারাপ ব্যবহার করত। (পৃ-২৪)।
ভূক্তি-২৩৫ আবুল হাশিম সাহেব বোঝাতে চেষ্টা করেন যে,পাকিস্তান দাবী হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়,হিন্ধু মুসলমানের মেলানোর জন্য।(পৃ-২৪)।
ভূক্তি-২৩৬ হাশিম সাহেব পূর্বে বর্ধমানে থাকতেন।(পৃ-২৪)।
ভূক্তি-২৩৭ কলকাতার মুসলিমলীগ অফিসটা শহীদ সাহেব ভাড়া নিয়েছিলেন।তিনিই ১৯৪৭সাল পর্যন্ত অফিসের ভাড়া দিয়েছেন।(পৃ-২৪)।
ভূক্তি-২৩৮ হাশিম সাহেব ছিলেন শহীদ সাহেবের ভক্ত।এজন্য শেখ মুজিব তাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন,হুকুম মানতেন। (পৃ-২৪)।
ভূক্তি-২৩৯ হাশিম সাহেবও শহীদ সাহেবের হুকুম ছাড়া কিছু করতেন না। (পৃ-২৪)।
ভূক্তি-২৪০ মুসলিমলীগের ফান্ড ও অর্থ মানে শহীদ সাহেবের পকেট। (পৃ-২৪)।
ভূক্তি-২৪১ লীগের টাকা পয়সা শহীদ সাহেবই জোগাড় করতেন। (পৃ-২৪)।
ভূক্তি-২৪২ হাশিম সাহেব বলতেন মুসলিম লীগকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাত হতে উদ্ধার করতে হবে।গ্রাম থেকে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। উপরের তলার প্রতিষ্ঠান করলে চলবে না।জমিদারদের পকেট হতে প্রতিষ্ঠানকে বের করতে হবে। (পৃ-২৪)।
ভূক্তি-২৪৩ হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের সাথে পরামর্শ করে সমস্ত বাংলাদেশ ঘুরতে আরম্ভ করলেন। (পৃ-২৪)।
ভূক্তি-২৪৪ ভাষার উপর হাশিম সাহেবের দখল ছিল।তিনি ইংরেজি ও বাংলাভাষাতে চমৎকার বক্তৃতা দিতে পারেন। (পৃ-২৪)।
ভূক্তি-২৪৫ শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ হতে কলকাতায় ফিরে গেছেন।সে সময় ছাএদের মধ্যে দুটি দল তৈরি হয়েছে।তিনি জানতে পারলেন তাকে দিল্লি যেতে হবে “অল ইন্ডিয়া মুসলিমলীগ সম্মেলনে”যোগ দিতে। (পৃ-২৪)।
ভূক্তি-২৪৬ যাঁরা দিল্লিতে যাবেন নিজের টাকাতেই যাবেন। (পৃ-২৪)।
ভূক্তি-২৪৭ আনোয়ার হোসেন সাহেব তার দলবল থেকে কয়েকজনকে নিলেন। (পৃ-২৪)।
ভূক্তি-২৪৮ শেখ মুজিব ও ইসলামিয়া কলেজের ইউনিয়ন সেক্রেটারি মীর আশরাফ উদ্দিন ঠিক করলেন তারাও নিজের টাকায় দিল্লি যাবেন। (পৃ-২৫)।
ভূক্তি-২৪৯ মীর আশরাফউদ্দিন ওরফে মাখনের বাড়ি ছিল ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জ মহকুম্মার কাজী কসবা গ্রামে। (পৃ-২৫)।
ভূক্তি-২৫০ মীর আশরাফউদ্দিন মাখন ছিলেন শেখ মুজিবের খালাতো বোনের ছেলে। (পৃ-২৫)।
ভূক্তি-২৫১ শেখ মুজিব শহীদ সাহেবকে বললেন, “আমরা দিল্লি কনফারেন্সে যোগদান করব”। (পৃ-২৫)।
ভূক্তি-২৫২ শহীদ সাহেব বললেন,“খুব ভাল,দেখতে পারবে সমস্ত ভারতবর্ষের মুসলমান নেতাদের”। (পৃ-২৫)।
ভূক্তি-২৫৩ টাকার বেশি প্রয়োজন হলে শেখ মুজিব তার বোনের কাছ থেকে নিতেন। (পৃ-২৫)।
ভূক্তি-২৫৪ বাবা ছাড়া মায়ের কাছ হতেও শেখ মুজিব টাকা নিতেন ।এছাড়া রেণুও তাঁর জোগাড় করা টাকা শেখ মুজিবের হাতে দিত । রেণু এ ব্যাপারে কোনদিন আপওি করে নাই।নিজে মোটেও খরচ করত না।গ্রামের বাড়িতে থাকত,শেখ মুজিবের জন্যই সে টাকা রেখে দিত। রেণু হচ্ছেন শেখ মুজিবের স্ত্রী। (পৃ-২৫)।
ভূক্তি-২৫৫ দিল্লিতে যাওয়াই হচ্ছে শেখ মুজিবের প্রথম বাংলাদেশের বাহীরে যাওয়া। হাওড়া থেকে শেখ মুজিব সঙ্গী সহ দিল্লিতে রওনা হলেন। দিল্লি দেখার একটা প্রবল ইচ্ছা তার ছিল।ইতিহাসে ও বন্ধুবান্ধবদের কাছে শেখ মুজিব দিল্লির অনেক কথা শুনেছিলেন। (পৃ-২৫)।
ভূক্তি-২৫৬ দিল্লি পৌছে এ্যাংলো এ্যারাবিয়ান কলেজ প্রাঙ্গনে শেখ মুজিবকে পৌছে দিল স্বেচ্ছাসেবক দল।(পৃ-২৫)।
ভূক্তি-২৫৭ প্রথম দিন কনফারেন্স হয়ে যাবার পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে হাতির পিঠে নিয়ে এক বিরাট শোভাযাাএা হল। (পৃ-২৫)।
ভূক্তি-২৫৮ রাতে আবার কনফারেন্স শুরু হল।একজন এতে তিন ঘন্টা উর্দুতে বক্তব্য রাখলেন।তিনি ছিলেন হায়দারাবাদের নবাব ইয়ার জং বাহাদুর।তিনি স্টেট মুসলিমলীগের সভাপতি ছিলেন(হায়দারাবাদ)। (পৃ-২৫)।
ভূক্তি-২৫৯ দিল্লিতে শেখ মুজিব অসুস্থ হয়ে পড়েন (বুকে,পেটে,সমস্ত শরীরে বেদনা আর পায়খানা বন্ধ)।হেকিম খলিলুর রহমান তাকে দেখতে এলেন। আলিয়া মাদ্রাসায় পড়া ও ইলিয়ট হোস্টেলে থাকা হেকিম খলিলুর রহমান ছিলেন ছাএলীগের বিখ্যাত কর্মী ।আর এক সেচ্ছাসেবক বলেছিলেন,“আভি নেহি,থোড়া বাদ”। তাকে আর পাওয়া গেল না। সে “থোড়া বাদই রয়ে গেল”। (পৃ-২৬)।
ভূক্তি-২৬০ হেকিম আজমল খাঁ সাহেবের হেকিমি বিদ্যালয়,দিল্লিতে পড়তে খলিলুর রহমান সেখানে একবছর যাবৎ ছিলেন। (পৃ-২৬)।
ভূক্তি-২৬১ একজন হেকিমের ব্যবস্থাপএে শেখ মুজিব সুস্থ হয়ে গেলেন। (পৃ-২৬)।
ভূক্তি-২৬২ বরিশালের নুরুদ্দিন আহমদের সাথে আনোয়ার সাহেবের ঝগড়া লাগাতে নূরুদ্দিন রাগ করে এক পয়সা ছাড়াই শেখ মুজিবের কাছে চলে আসে। (পৃ-২৬)।
ভূক্তি-২৬৩ আই এ পড়লেও শেখ মুজিবই কলেজের দলের নেতা ছিলেন। (পৃ-২৬)।
ভূক্তি-২৬৪ শেখ মুজিব খলিল ভাইকে নিয়ে দুই দিনের মধ্যে দিল্লির লালকেল্লা,দেওয়ানি আম, দেওয়ানি ঘাস, কুতুব মিনার,নিজামুদ্দিন আওলিয়ার দরগাহ,নতুন দিল্লি দেখে নিলেন।(পৃ-২৬)।
ভূক্তি-২৬৫ তখন তিনজনের টিকিট কেনার টাকা নেই(কলকাতায় ফেরার)।দুটি টিকিট কেনা যাবে। (পৃ-২৬)।
ভূক্তি-২৬৬ তিনজনে পরামর্শ করে ঠিক করলেন একখানা টিকিট করব(আর দুটি প্লাটফর্ম টিকিট করব)এবং সার্ভেন্ট ক্লাসে উঠে পড়ব।ধরা পড়লে হাওড়ায় একটি বন্দোবস্ত করা যাবে। (পৃ-২৬)।
ভূক্তি-২৬৭ দিল্লি যাওয়ার সময় শেখ মুজিব ইন্টারক্লাশে যান।ফেরার পথে হাওড়া পর্যন্ত একটি তৃতীয় শ্রেনীর টিকিট কিনলেন। (পৃ-২৬)।
ভূক্তি-২৬৮ খান বাহাদুর আবদুল মোমেন সাহেব একই বগিতে কলকাতা যাবেন। (পৃ-২৬)।
ভূক্তি-২৬৯ একজন চেকার জিঞ্জাসা করলেন, “তোমারা কোন সাহেবের লোক”? নূরুদ্দিন ফট করে উওর দিল, “ মোমেন সাহেবে কা”। (পৃ-২৬)।
ভূক্তি-২৭০ ট্রেনে ভাত ও রুটি খাওয়ার পয়সা নেই।নূরুদ্দিন এর কেনা ফলফলাদি শেখ মুজিব সহ তিনজনে খেতেন। (পৃ-২৬)।
ভূক্তি-২৭১ হাওড়া পৌছানোর পরে ঠিক হল মাখন টিকিট নিয়ে সকলের মালপএ সহ বের হবে।মালপএ কোথাও রেখে তিনখানা প্লাটফর্ম টিকিট নিয়ে আবার ঢুকবে।তখন একসাথে শেখ মুজিবসহ সবাই বের হবেন। (পৃ-২৬)।
ভূক্তি-২৭২ শেখ মুজিব চশমা খুলে লুকিয়ে রেখেছেন।পরনে ময়লা জামা। (পৃ-২৬)।
ভূক্তি-২৭৩ মাখনের আনা টিকিটেহাওড়া স্টেষন ত্যাগ করার পরে দেখা গেল শেখ মুজিব সহ তাদের কাছে আছে এক টাকার মত। (পৃ-২৬)।
ভূক্তি-২৭৪ এর পরবাসে উঠে হাওড়া হতে শেখ মুজিব সহ অন্যরা বেকার হোস্টেলে ফিরে গেলেন।তখন না খেয়ে সবার অবস্থা কাহিল। (পৃ-২৬)।
ভূক্তি-২৭৫ নূরুদ্দিন পরে“অল বেঙ্গল মুসলিম ছাএলীগের”অস্থায়ী সাধারন সম্পাদক হন। (পৃ-২৮)।
ভূক্তি-২৭৬ ১৯৪৪ সালে ছাএলীগের এক বাৎসরিক সম্মেলন হবে বলে ঠিক হল। (পৃ-২৮)।
ভূক্তি-২৭৭ ইসলামিয়া কলেজে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কেউ কিছুই করার সাহস পেত না।(পৃ-২৮)।
ভূক্তি-২৭৮ ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব লেখা পড়া ছেড়ে চট্টগ্রামে ফিরে গেছেন। (পৃ-২৮)।
ভূক্তি-২৭৯ বর্ধমানের খন্দকার নূরুল আলম ও চট্টগ্রামের মাহাবুব আলম ছিলেন নি:স্বার্থ ছাএকর্মী। (পৃ-২৮)।
ভূক্তি-২৮০ শহীদ সাহেব শেখ মুজিবকে বললেন, ÒWho are you? You are nobody”. এর উওরে শেখ মুজিব বললেন, ÒIf I am nobody,then why you have invited me?You have no right to insult me.I will prove that I am somebody.Thank you,sir. I will never come to you again”. (পৃ-২৯)।
ভূক্তি-২৮১ ১৯৪৩ সাল হতে চট্রগ্রামের ছাএ কর্মীদের সাথে শেখ মুজিবের বন্ধুত্ব গড়ে উঠে(এম এ আজিজ,জহুর আহমেদ চৌধুরী, ফজলুল কাদের চৌধুরী,আজিজুর রহমান,আবুল খায়ের চৌধুরী ও ডাঃ সুলতান আহমেদ)। (পৃ-২৯)।
ভূক্তি-২৮২ ফজলুল কাদের চৌধুরী খুবই স্বার্থপর হয়ে উঠেন এবং একগুঁয়েমি করতেন। এজন্য চট্রগ্রামের সকলেই তাঁকে ত্যাগ করেন(যাঁরা তাঁকে চট্রগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন)। (পৃ-২৯)।
ভূক্তি-২৮৩ শহীদ সাহেব মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পরে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানের দিকে মন দিলেন।এ সময় কংগ্রেস “ভারত ত্যাগ কর আন্দোলন” ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। (পৃ-৩৫)।
ভূক্তি-২৮৪ এ সময় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠন করে ভারত বর্ষের হিন্দু-মুসলমান সৈন্যদের দলে নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছেন। (পৃ-৩৫)।
ভূক্তি-২৮৫ মাঝে মাঝে সিঙ্গাপুর হতে সুভাষ বসুর বক্তব্য শুনে শেখ মুজিব চঞ্চল হয়ে উঠতেন। (পৃ-৩৫)।
ভূক্তি-২৮৬ ১৯৪৪-৪৫ সালে ট্রেনে-স্টীমারে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে তুমুল তর্ক হত।মাঝে মধ্যে হাতের ব্যবহার হবার উপক্রম হতো। (পৃ-৩৬)।
ভূক্তি-২৮৭ বেকার হোস্টেলে কতগুলি ফ্রি রুম ছিল।এগুলো গরিব ছাএদের জন্য।আজকালকার টেলিফোনে দলীয় ছাত্রদের রুম দেওয়ার অনুরোধ আসতো না।এ ছাড়া ইসলামিয়া কলেজে গরিব ছাএদের সাহায্য করার জন্য একটি ফান্ড ছিল।বিজ্ঞানের শিক্ষক নারায়ণ বাবু সেই ফান্ড দেখাশুনা করতেন। (পৃ৩৭)।
ভূক্তি-২৮৮ আর্টসের ছাত্র হলেও শেখ মুজিবকে নারায়ন বাবু খুব ভালবাসতেন। সকল ছাত্র মুসলমান হলেও নারায়ণ বাবুই দায়িত্ব পালন করতেন কারন,তিনি একজন সত্যিকারের শিক্ষক ছিলেন। (পৃ-৩৭)।
ভূক্তি-২৮৯ নারায়ণ বাবু অনেক দানশীল হিন্দু মুসলমানের কাছ হতে টাকা সংগ্রহ করে তহবিলে জমা করতেন।এমন সহানুভূতিশীল শিক্ষক শেখ মুজিবের চোখে খুব কমই পড়েছে। (পৃ-৩৮)।
ভূক্তি-২৯০ এসময় বাধ্য হয়ে শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজের ছাএ ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক পদে বিনা প্রতিদ্বন্বিতায় নির্বাচিত হন। (পৃ-৩৮)।
ভূক্তি-২৯১ শেখ মুজিব বলেছিলেন তিন মাসের বেশি তিনি পদে থাকবেন না।তিনি তিন মাসের মধ্যেই পদত্যাগ করে আরেকজনকে সাধারন সম্পাদক করে দেন। (পৃ-৩৮)।
ভূক্তি-২৯২ ১৯৪৫ সালের গোড়ার দিকে ইলেকশনের তোড়জোড় শুরু হয়। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে, ইলেকশন হবে,সমস্ত ভারতবর্ষব্যাপী মুসলমানরা “পাকিস্তান”চায়কি চায় না তা নির্ধারন করতে। (পৃ-৩৮)।
ভূক্তি-২৯৩ কংগ্রেস দাবী করে তারা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের জন্য প্রতিনিধিত্ব করে।নজির হিসেবে তারা বলেন,মওলানা আবুল কালামআজাদ কংগ্রেসের সভাপতি। কংগ্রেসের বক্তব্য ছিল ভারতবর্ষ এক থাকলে দশ কোটি মুসলমানের উপর হিন্দুরা অত্যাচার করতে সাহস পাবে না। (পৃ-৩৮)।
ভূক্তি-২৯৪ মুসলিম লীগের বক্তব্য পাকিস্তানের হিন্দুরা আর হিন্দুস্থানের মুসলমানরা সমান নাগরিক অধিকার পাবে।লাহোর প্রস্তাবে এসব কথা লেখা আছে।(২৩ মার্চ১৯৪০)। (পৃ-৩৮)।
ভূক্তি-২৯৫ দৈনিক আজাদ-ই ছিল একমাএ বাংলা খবরের কাগজ যেটি মুসলিমলীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করতো।এর প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক ছিলেন মওলানা আকরম খাঁ।তিনি ছিলেন বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। (পৃ-৪০)।
ভূক্তি-২৯৬ শহীদ সাহেব১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কলকাতা হতে দুটি সীটে এম এলএ হন।(পৃ-৪২)।
ভূক্তি-২৯৭ ১৯৪২ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে খাজা নাজিমুদ্দীন নিজের ভাইকে মন্ত্রীবানিয়েছিলেন এবং বংশের এগারজনকে এম এল এ বানিয়েছিলেন। (পৃ-৪২)।
ভূক্তি-২৯৮ ফজলুল কাদের চৌধুরী দলবল নিয়ে কলকাতায়ছিলেন।চট্রগ্রামের ছাএদের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। (পৃ-৪৩)।
ভূক্তি-২৯৯ শহীদ সাহেব গোপালগঞ্জে আসার দুইদিন আগে শেখ মুজিব বললেন,“আমি গোপালগঞ্জ মুসলিমলীগের জন্মদাতা।শহীদ সাহেব আসবেন,তাকে সংবর্ধনা দেব।যদি কেউ পারে যেন মোকাবেলা করে”। (পৃ-৪৬)।
ভূক্তি-৩০০ পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাস ঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে।বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না,“পরশ্রীকাতরতা”। -শেখ মুজিব। (পৃ-৪৭)।
ভূক্তি-৩০১ সুজলা,সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। তবুও এরা গরিব।কারন,যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়ে আসছে নিজের দোষে।নিজেকে এরা চেনে না।আর যত দিন চিনবে না,বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি হবে না।-শেখ মুজিব। (পৃ-৪৮)।
ভূক্তি-৩০২ হঠাৎ খবর আসল জিন্নাহ সাহেব ৭,৮,৯ এপ্রিল দিল্লিতে সমস্ত ভারতবর্ষের মুসলিমলীগপন্থী কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের কনভেনশন ডেকেছেন।সমস্ত ভারতবর্ষে তখন এগারটা প্রদেশ ছিল। (পৃ-৫০)।
ভূক্তি-৩০৩ শহীদ সাহেব স্পেশাল ট্রেনের বন্দোবস্ত করার হুকুম দিলেন।বাংলা ও আসামের মুসলিমলীগ এমএলএ ও কর্মীরা এই ট্রেনে দিল্লি যাবেন।ট্রেনের নাম দেওয়া হল “পূর্ব পাকিস্তান স্পেশাল”। ট্রেন হাওড়া থেকে ছাড়বে। (পৃ-৫০)।
ভূক্তি-৩০৪ ছাএরা শেখ মুজিবের বগির সামনে দুষ্টামি করে লিখে দিল-“শেখ মুজিবর ও পার্টির জন্য রিজার্ভড”। যদিও ছাএদের নেতা ছিল নূরুদ্দিন।তাকেই সবাই মানত।শেখ মুজিব সহ। (পৃ-৫০)।
ভূক্তি-৩০৫ “নারায়ে তকবির”, “মুসলিমলীগ জিন্দাবাদ”; “পাকিস্তান জিন্দাবাদ”“মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জিন্দাবাদ” “শহীদ সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ” ধ্বনির মধ্যে দিল্লির উদ্দেশ্যে হাওড়া হতে ট্রেন ছাড়ল। (পৃ-৫১)।
ভূক্তি-৩০৬ সকালে পাটনা পৌছে দেখা গেল পাটনা স্টেশন লোকে লোকারন্য।তারা“বাংলাকা মুসলমান জিন্দাবাদ”“শহীদ সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ” “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” “লরকে লেঙ্গে পাকিস্তান” স্লোগান দিতে লাগলো। (পৃ-৫১)।
ভূক্তি-৩০৭ বিহার মুসলিমলীগ প্রত্যেকের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। প্রত্যেকের জন্য ফুলের মালার ব্যবস্থা করেছে। (পৃ-৫১)।
ভূক্তি-৩০৮ এলাহাবাদ স্টেশনে সমস্ত ট্রেনটাকে তারা ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল। পথে বিহার ও ইউপি হতে অনেক ছাত্র ট্রেনে উঠেছিল। (পৃ-৫১)।
ভূক্তি-৩০৯ আট ঘন্টা দেরীতে বিকালে শেখ মুজিবদের ট্রেন দিল্লি পৌছাল। (পৃ-৫১)।
ভূক্তি-৩১০ জিন্নাহ সাহেব বক্তৃক্তা করলেন।মনে হচ্ছিল সকলের মনের একই কথা ।পাকিস্তান কায়েম করতে হবে।৮তারিখে সাবজেক্টকমিটির সভা হল। (পৃ-৫২)।
ভূক্তি-৩১১ জনাব সোহরাওয়ার্দীর বক্তৃতার পর প্রায় বিশ-পঁচিশজন নেতা বিভিন্ন প্রদেশ হতে বক্তৃতা করেন এবং প্রস্তাবটা সমর্থন করেন। প্রস্তাব পাস হলে লিয়াকত আলী খান একটি শপথনামা পেশ করেন এবং সকল প্রদেশের মুসলিমলীদের দলীয় সদস্যরা এতে দস্তখত করেন। (পৃ-৫৪)।
ভূক্তি-৩১২ আমরা প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলাম দিল্লি থেকে আজমীর শরীফে খাজাবাবার দরগাহ জিয়ারত করব,আবার আজমীর হতে তাজমহল দেখতে আগ্রায় যাব।১৯৪৩ সালে তাজমহল না দেখে ফিরে যেতে হয়েছিল।-শেখ মুজিব। (পৃ-৫৪)।
ভূক্তি-৩১৩ এবার যেভাবে হয় দেখতেই হবে। ছোটকাল থেকে আশা করে রয়েছি; সুযোগ আর কখন হবে কে জানে? (পৃ-৫৫)।
ভূক্তি-৩১৪ কয়েক জন মিলে শহীদ সাহেবকে ছাএদের অসুবিধার কথা (তাদের কলকাতা ফেরার টাকা নাই) জানালে তিনি বললেন,“কেন, একজন তো টাকা নিয়ে গেছে, এদের ভাড়া দেবার কথা বলে। তোমার সাথে আলোচনা করে টাকা দিতে বলেছি”। শেখ মুজিব বললেন,“জানি না তো স্যার,সে তো চলে গিয়েছে”।শহীদ সাহেব রাগ করলেও আরো কিছু টাকা দিলেন।প্রত্যেককে পঁচিশ টাকা করে।এতেই হয়ে যাবে। (পৃ-৫৫)।
ভূক্তি-৩১৫ খন্দকার নূরুল আলম ও শেখ মুজিব সবাইকে পঁচিশ টাকা করে দিয়ে রশিদ গিয়ে নিলেন। (পৃ-৫৫)।
ভূক্তি-৩১৬ শেখ মুজিব সহ আট/দশজন ফজলুল কাদের চৌধুরীর সাথে আজমীর শরীফে রওনা হলেন। (পৃ-৫৫)।
ভূক্তি-৩১৭ শেখ মুজিব সদলবলে আজমীর শরীফ যাবার ট্রেনে চড়ে বসলেন।তিনি শুনেছিলেন,“খাজাবাবার দরগায় গিয়ে যা চাওয়া যায়,তাই পাওয়া যায়,যদি চাওয়ার মত চাইতে পারো”। (পৃ-৫৫)।
ভূক্তি-৩১৮ খাজাবাবার দরগায় কোন লোক না খেয়ে থাকে না।পাক হতে থাকে,মানুষখেতে থাকে। (পৃ-৫৫)।
ভূক্তি-৩১৯ শেখ মুজিব দরগায় গিয়ে দেখলেন-এলাহী কান্ড! সেজদা দিয়ে পড়ে আছে অনেক লোক।চিৎকার করে কাদছে, কারো দুঃখে দুই চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সকলের মুখে একই কথা “খাজাবাবা,দেখা দে”। (পৃ-৫৫)।
ভূক্তি-৩২০ খাজাবাবার দরগায় ‘কাওয়ালী’ শুনে মুগ্ধ হলেন শেখ মুজিব।অনিচ্ছা সত্বেও উঠতে হল।যাবেন তারাগড় পাহাড়ে-সেখানে কয়েকটি মাজার আছে।তাঁরা খাজাবাবার খলিফা ছিলেন। (পৃ-৫৬)।
ভূক্তি-৩২১ তারাগড়ের পাহাড় অতিক্রম করেই মুসলমান সৈন্যরা পৃথ্বীরাজকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিল। (পৃ-৫৬)।
ভূক্তি-৩২২ তারাগড় পাহাড় হতে বহুদুর পর্যন্ত দেখা যায় শুধু মরুভূমি।আর একদিকে আজমীর শহর। (পৃ-৫৬)।
ভূক্তি-৩২৩ তারগড় পাহাড় দেখে শেখ মুজিব আবার বেড়িয়ে পড়লেন যাবেন আনার সাগরে। (পৃ-৫৬)।
ভূক্তি-৩২৪ বিরাট লেক।একপাশে মোঘল আমলের কীর্তি পড়ে আছে।এখানে বাদশা ও বেগমরা বিশ্রাম নিতেন।বাদশা শাহজাহানের কীর্তিই সবার চেয়ে বেশী।বাদশা ও বেগমের থাকার জায়গাটি মর্মর পাথরের তৈরী। (পৃ-৫৬)।
ভূক্তি-৩২৫ আজমীর শরীফ হতে বিদায় নিয়ে আগ্রার ট্রেনে উঠলেন। (পৃ-৫৬)।
ভূক্তি-৩২৬ শেখ মুজিবের বহুদিনের স্বপ্ন ছিল তাজমহল দেখার। (পৃ-৫৬)।
ভূক্তি-৩২৭ পূর্নিমার দিন শেখ মুজি আগ্রার তাজমহলে পৌছালেন। (পৃ-৫৭)।
ভূক্তি-৩২৮ শেখ মুজিব সদলবলে আগ্রা হোটেলে উঠলেন। (পৃ-৫৭)।
ভূক্তি-৩২৯ আগ্রার সমস্ত খরচ চৌধুরী সাহেব(ফজলুল কদের চৌধুরী) দিয়েছিলেন (বার/চৌদ্দজনের) (পৃ-৫৭)।
ভূক্তি-৩৩০ শেখ মুজিব ইতিমাদ-উল-দৌলা, দেওয়ানি আম, মতি মসজিদ, মছি ভবন, নাগিনা মসজিদ, দেওয়ানি খাস ও জেসমিন টাওয়ার দেখলেন। তিনি দেখলেন শীশমহল। (পৃ-৫৭)।
ভূক্তি-৩৩১ গাইড শেখ মুজিব সহ অন্যান্যদের আগ্রার বর্ননা দিচ্ছিলেন,সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে। তবে এখানকার লুটতরাজের ঘটনা সত্য। জাঠ,মারাঠি এবং শেষ আঘাত হানে ইংরেজি জাঠ,মারাঠিরা কিছু কিছু লুট করে নিয়ে গিয়েছে ভারত বর্ষ থেকে। কিন্তু ইংরেজ সব কিছু লুট করে নিয়ে গিয়েছে ভারত বর্ষ থেকে।(পৃ-৫৭)।
ভূক্তি-৩৩২ রাত দশটা পযৃন্ত তাজমহলের দরজা খোলা থাকে। (পৃ-৫৯)।
ভূক্তি-৩৩৩ একুশ বছর পরেও শেখ মুজিব লিখতে বসে তাজের রুপকে তুলে ধরেছেন,ভুলতে পারেননি।কোনদিন ভুলবেনও না। (পৃ-৫৯)।
ভূক্তি-৩৩৪ পরের দিন শেখ মুজিব গেলেন ফতেপুর সিক্রিতে। চৌধুরী সাহেবের ঠিক করা মোটর বাসে শেখ মুজিব সহ অন্যরা ফতেপুর সিক্রি ও সেকেন্দ্রা দেখে এলো। (পৃ-৫৯)।
ভূক্তি-৩৩৫ সম্রাট বাবর ফতেপুর সিক্রির সামনের বিরাট ময়দান যার নাম খানওয়া সেখানে সংগ্রাম সিংহকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের ভিওি গড়ে তুলেছিলেন। (পৃ-৫৯)।
ভূক্তি-৩৩৬ সেলিম চিশতী ছিলেন বাদশাহ আকবরের পীর। (পৃ-৫৯)।
ভূক্তি-৩৩৭ খাজাবাবা মঈনুদ্দিন চিশতী ও সেলিম চিশতী দু’জনাই নাকি গান পছন্দ করতেন। (পৃ-৬০)।
ভূক্তি-৩৩৮ শেখ মুজিব আবুল ফজলের বাড়ি, হামামখানা, ধর্মশালা, মিনা মসজিদ, যোধাবাঈ মহলও সেলিম গড় দেখলেন। (পৃ-৬০)।
ভূক্তি-৩৩৯ শেখ মুজিব দেখলেন তানসেনের বাড়ি। (পৃ-৬০)।
ভূক্তি-৩৪০ আট বর্গমাইল জায়গা নিয়ে ফতেপুর সিক্রি। এতে দুইহাজার নয়শত ঘর ছিল। আগ্রা দুর্গে ছিল পাঁচ শত ঘর। (পৃ-৬০)।
ভূক্তি-৩৪১ ফতেপুর সিক্রিতে সম্রাটের অমাত্যবৃন্দ ছাড়াও ষাট হাজার সৈন্য থাকতে পারতো। (পৃ-৬০)।
ভূক্তি-৩৪২ সেকেন্দ্রায় গেলেন শেখ মুজিব। সেখানে সম্রাট আকবর চিরনিদ্রায় শায়িত। সমাধি ক্ষেএ নানারকম ফুল ও ফলের গাছে ভরা। আকবর নিজেই এ জায়গা ঠিক করে গিয়েছিলেন। (পৃ-৬০)।
ভূক্তি-৩৪৩ চৌধুরী সাহেবের তাগাদায় শেখ মুজিব সহ সবাই রওনা হলেন তুন্দলা স্টেশনে। (পৃ-৬০)।
ভূক্তি-৩৪৪ শেখ মুজিবের হাত-পা ঠান্ডা বাতাসে অবশ হয়ে গিয়েছিল। (পৃ-৬১)।
ভূক্তি-৩৪৫ হাওড়া স্টেশনে গিয়ে দেখা গেল শেখ মুজিবের সুটকেসটা হারিয়ে গেছে। শুধু বিছানা নিয়ে তিনি কলকাতায় ফিরে গেলেন। (পৃ-৬১)।
ভূক্তি-৩৪৬ শেখ মুজিব কলকাতায় ফিরে এসে পড়াশুনার কথা ভাবলেন।কলেজে এক বছরের বেতন বাকি। নতুন করে জামা কাপড় বানাতে হবে।কারন,সব কাপড় চুরি হয়ে গেছে।তিনি বাড়ি পৌছে রেণুকে সব কথা জানালেন।দিল্লি ও আগ্রা হতে রেণুকে শেখ মুজিব চিঠিও দিয়েছিলেন।বাবাকে বললেতিনি শেখ মুজিবকে টাকা দিয়ে বললেন,“কোনো কিছুই শুনতে চাই না।বিএ পাস ভালোভাবে করতে হবে।অনেক সময় নষ্ট করেছ,“পাকিস্তানের আন্দোলন বলে কিছুই বলি নাই।এখন কিছুদিন লেখাপড়া কর”। শেখ মুজিব রেণুর ঘরে বিদায় নিতে এলে “অমঙ্গল অশ্রু জল”অনেক কষ্টে বন্ধ করে বলল,“একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাওনা। এবার কলেজছুটি হলেই বাড়ি এস”। (পৃ-৬১)।
ভূক্তি-৩৪৭ কলকাতা গিয়ে শেখ মুজিব বন্ধুদের কাছ হতে বই সংগ্রহ করলেন।কলেজে ক্লাস করতে গেলে প্রফেসর সাহেবরা বললেন,“কি সময় পেয়েছ কলেজে আসতে”। শেখ মুজিব উওর না দিয়ে হাসতেন সহপাঠীরাও হাসত। (পৃ-৬১)।
ভূক্তি-৩৪৮ ২৯ জুলাই জিন্নাহ সাহেব ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিমলীগ কাউন্সিল’সভা বোম্বে শহরে আহবান করলেন।অর্থের অভাবে শেখ মুজিব এতে অংশ নিতে পারলেন না। (পৃ-৬৩)।
ভূক্তি-৩৪৯ জিন্নাহ সাহেব ১৬ আগষ্ট তারিখে “ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে”ঘোষনা করলেন।এর মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশ সরকারকে দেখাতে চেয়েছিলেন যে ভারতবর্ষের দশ কোটি মুসলমান পাকিস্তান দাবি আদায় করতে বদ্ধপরিকর। (পৃ-৬৩)।
ভূক্তি-৩৫০ কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা “এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস”তাদের বিরুদ্ধে ঘোষনা করা হয়েছে বলে বিবৃতি দিতে লাগলেন। (পৃ-৬৩)।
ভূক্তি-৩৫১ সোহরাওয়ার্দী সাহেব শান্তিপূর্নভাবে দিনটি পালনের আহবান জানালেন।তিনি ১৬ আগষ্ট সরকারি ছুটি ঘোষনা করলেন।তখন তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী।ছুটি ঘোষনা করতে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা আরো ক্ষেপে গেল। (পৃ-৬৩)।
ভূক্তি-৩৫২ ১৬ আগষ্ট কলকাতার গড়ের মাঠে সভা হওয়ার কথা ।শেখ মুজিবকে দায়িত্ব দেওয়া হলো ইসলামিয়া কলেজে থাকতে । (পৃ-৬৩)।
ভূক্তি-৩৫৩ ইতিমধ্যেই মারামারি শুরু হয়ে গেছে। রক্তাক্ত ছাত্র-ছাত্রী ইসলামিয়া কলেজে আসতে শরু করেছে।কারো পিঠে ছোরার আগাত,কারো মাথা ফেটে গেছে ।মেয়েরা তাঁদের ওড়না, শাড়ি ছিড়ে ব্যান্ডেজ করা শুরু করলেন। (পৃ-৬৪)।
ভূক্তি-৩৫৪ রিপন কলেজে ছাএরা পতাকা ইওোলন করতে গেলে তাদের উপর আক্রমন হয়েছে। (পৃ-৬৪)।
ভূক্তি-৩৫৫ ইসলামিয়া কলেজের পাশে সুরেন ব্যানার্জী রোড,তারপরেই ধর্মতলা ও ওয়েলিংটন স্কয়ারের জংশন।এখানে প্রায় সবই হিন্দু। ইসলামিয়া কলেজের দিকে হিন্দুরা এগিয়ে আসতে থাকে। (পৃ-৬৪)।
ভূক্তি-৩৫৬ চল্লিশ পঞ্জাশ জন ছাএ নিয়ে প্রায় খালি হাতেই শেখ মুজিব ধর্মতলার মোড় পর্যন্ত গেলেন।দেখলেন শত শত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক মসজিদ আক্রমন করছে।মোলভী সাহেব পালিয়ে আসছেন শেখ মুজিবের দলের দিকে।তার পিছে ছুটে আসছে একদল লোক লাঠি ও তলোয়ার হাতে। হিন্দুরা সামনাসামনি এসে পড়েছে। শেখ মুজিবের দলে দেড়শত লোকের বেশি হবে না। (পৃ-৬৪)।
ভূক্তি-৩৫৭ কে যেন মুজিবের দলে কয়েকখানা লাঠি দিল।এর মধ্যে একটি বিরাট শোভাযাএা এসে পৌছাল।তাদের সকলের হাতেই লাঠি।তারা শেখ মুজিবের দলে যোগদান করল।কয়েক মিনিটের জন্য হিন্দুরা ফিরে গেল। (পৃ-৬৪)।
ভূক্তি-৩৫৮ মুসলমানরা মোটেও দাঙ্গার জন্য প্রস্তুত ছিল না। শেখ মুজিবের দল গড়ের মাঠের দিকে রওনা দিলেন।লাখ লাখ সভায় উপস্থিত । (পৃ-৬৫)।
ভূক্তি-৩৫৯ কালীঘাট, ভবানীপুর, হ্যারিসন রোড, বড়বাজার সকল জায়গায় শোভা যাএার উপর আক্রমন হয়েছে। শহীদ সাহেব বক্তৃতা করে সবাইকে তাড়া তাড়ি বাড়ি যেতে হুকুম দিলেন। (পৃ-৬৫)।
ভূক্তি-৩৬০ ওয়েলেসলী,পার্ক সার্কাস,বেনিয়াপুকুর এরিয়া মুসলমানদের এরিয়া বলাচলে। (পৃ-৬৫)।
ভূক্তি-৩৬১ মিনিটে মিনিটে টেলিফোন আসছে। আমাদের বাঁচাও, আমরা আটকা পড়ে আছি। রাতেই আমরা ছেলেমেয়ে নিয়ে শেষ হয়ে যাব”। (পৃ-৬৫)।
ভূক্তি-৩৬২ মুসলিমলীগ অফিস ও ইসলামিয়া কলেজ রিফিউজি ক্যাস্প হয়ে গেছে। (পৃ-৬৫)।
ভূক্তি-৩৬৩ শেখ মুজিব দৌড়ে কলকাতা মাদ্রাসা খুলতে গেলে দারোয়ান বাধা দিল।তখন মুজিব প্রিন্সিপালের হুকুমে দরজা খুলতে পারলেন।(পৃ-৬৫)।
ভূক্তি-৩৬৪ বেকার হোস্টেল,ইলিয়ট হোস্টেল পূর্বেই ভরে গেছে।শেখ মুজিব ভাবতে লাগলেন টেইলর হোস্টেলের ছেলেদের কি করে বাঁচাই। (পৃ-৬৫)।
ভূক্তি-৩৬৫ অনেক হিন্দু তালতলায় ও ওয়েলেসলী এরিয়ার ছিল।তাদের কিছু লোক গোপনে শেখ মুজিবের দলের সাহায্য চাইল। (পৃ-৬৫)।
ভূক্তি-৩৬৬ বিপদের মাথায় কিছু পরিবারকে হিন্দু এরিয়ার পাঠানো হলো(শেখ মুজিবের দলের সহযোগিতায়)। (পৃ-৬৫)।
ভূক্তি-৩৬৭ শেখ মুজিবের ছয় ভাই বোনের মধ্যে পাঁচ জনই তখন কলকাতা ও শ্রীরামপুরে।একমাএ ভাই শেখ আবু নাসের ম্যাট্রিক পড়ে ।মেজো বোন বেনিয়াপুকুরে আর এক বোন শ্রীরামপুরে। (পৃ-৬৫)।
ভূক্তি-৩৬৮ কলকাতা শহরে শুধু মরা মানুষের লাশ পড়ে আছে।মহল্লার পর মহল্লা আগুনে পুড়ে গেছে।মানুষ মানুষকে এইভাবে হত্যা করতে পারে চিন্তা করতেও ভয় হয়। (পৃ-৬৬)।
ভূক্তি-৩৬৯ লেডী ব্র্যাবোর্ন কলেজে রিফিউজিদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দোতলায় মেয়েরা,নিচে ছেলেরা।সেখানে মাঝে মধ্যে শেখ মুজিব দায়িত্ব পালন করেন। (পৃ-৬৬)।
ভূক্তি-৩৭০ আহত মুসলমানদের উদ্ধার করতে গিয়ে মুজিব আক্রান্ত হয়েছিলেন।মনে হয়েছে মানুষ তার মানবতা হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়েছে। (পৃ-৬৬)।
ভূক্তি-৩৭১ ১৬ আগষ্ট মুসলমানরা ভীষণভাবে মার খেয়েছে।পরের দুইদিন মুসলমানরা হিন্দুদের ভীষণভাবে মেরেছে। (পৃ-৬৬)।
ভূক্তি-৩৭২ সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ হতে শেখ মুজিব,নূরুদ্দিন ও নূরুলহুদা নিজেরা ঠেলাগাড়ি ঠেলে চাল নিয়ে গিয়ে বেকার হোস্টেল ও ইলিয়ট হোস্টেলে পৌছে দিলেন। তিনজনে কিছু চাল কারমাইকেল হোস্টেলেও পৌছে দিলেন।শহীদ সাহেবের নির্দেশে নবাব জাদা নসরুল্লাহ শেখ মুজিবের দলকে চাল সংগ্রহে সহযোগিতা করেছিলেন। (পৃ-৬৬)।
ভূক্তি-৩৭৩ নাসেরের একটি পা ছোট কালে টাইফয়েডে খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল।পা টেনে টেনে হাটতো। (পৃ-৬৭)।
ভূক্তি-৩৭৪ একটা কথা সত্য,অনেক হিন্দু মুসলমানদের রক্ষা করতে যেয়ে বিপদে পড়েছে।জীবনও হারিয়েছে।আবার অনেক মুসলমান হিন্দু পাড়া পড়শীকে রক্ষা করতে গিয়ে জীবন দিয়েছে।শেখ মুজিব নিজেই এর প্রমান পেয়েছেন।মুসলিমলীগ অফিসে যেসব টেলিফোন আসত তার বহু টেলিফোন হিন্দুরাই করেছে।তাদের বাড়িতে মুসলমানরা আশ্রয় নিয়েছে; শ্রীঘ্রই এদের নিয়ে যেতে বলতো,নতুবা এরাও মরবে,আশ্রিত মুসলমানরাও মরবে। (পৃ-৬৭)।
ভূক্তি-৩৭৫ একদল লোক দোকান ভাঙছে,লুট করছে।এদের বাধা দিতে গিয়ে শেখ মুজিব বিপদে পড়েছিলেন। (পৃ-৬৭)।
ভূক্তি-৩৭৬ কারফিউ জারি হয়েছে।সন্ধ্যার পরে রাস্তায় বের হলেই গুলি। জানালা খোলা থাকলেও গুলি করে।ভোরবেলায় দেখা যেত অনেক লোক রাস্তায় গুলি খেয়ে মরে পড়ে আছে। (পৃ-৬৭)।
ভূক্তি-৩৭৭ একবার শেখ মুজিব ও সিলেটের মোয়াজ্জেম চৌধুরির উপর দায়িত্ব পড়েছিল পার্ক সার্কাস ও বালিগঞ্জের মধ্যকার মুসলমান বস্তি পাহাড়া দেওয়ার।প্রত্যেক রাতেই হিন্দুরা সেখানে আক্রমন করে।শেখ মুজিব ও মোয়াজ্জেম বন্দুক চালাতে পারতেন বলে তাদের এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।শেখ মুজিব ও মোয়াজ্জেমের বাবার বন্দুক থাকাতে তাদের গুলি চালানো জানা ছিল। (পৃ-৬৭)।
ভূক্তি-৩৭৮ শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশনে হিন্দু ও মুসলমানদের ক্যাম্প করা হয়েছিল।হিন্দুরা মুসলমান দের মহল্লায় আর মুসলমানরা হিন্দুদের মহল্লায় গেলে আর রক্ষা নাই। (পৃ-৬৮)।
ভূক্তি-৩৭৯ কলকাতার মহিলাদের মধ্যে জনাব সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে মিসেস সোলায়মান, নবাবজাদা নসরুল্লার মেয়ে ইফফাত নসরুল্লাহ, বেগম রশিদ, রোকেয়া কবীর এবং মন্নুজান হোস্টেল ও ব্র্যাবোর্ন কলেজের মেয়েরা খুবই পরিশ্রম করেছেন।রাতদিন রিফিউজি সেন্টারে এরা কাজ করতেন মেয়েদের ভেতর। (পৃ-৬৮)।
ভূক্তি-৩৮০ কলকাতার অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ।বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা করার একমাএ জায়গাছিল এ্যাসপ্লানেড যাকে সবাই বলত চৌরঙ্গী। (পৃ-৬৮)।
ভূক্তি-৩৮১ হঠাৎ এক জায়গায় সামান্য গোলমাল আর ছোরা মারামারি শুরু হয়ে গেল। (পৃ-৬৮ )।
ভূক্তি-৩৮২ শহীদ সাহেব রাতদিন পরিশ্রম করতেন শান্তি রক্ষার জন্য। (পৃ-৬৮)।
ভূক্তি-৩৮৩ কলকাতার চৌদ্দ পনের শত পুলিশ বাহিনীর মধ্যে মাএ পঞ্জাশ-ষাট জন মুসলমান।অফিসসারদের অবস্থাও প্রায় সেই রকম। (পৃ-৬৮)।
ভূক্তি-৩৮৪ শহীদ সাহেব লীগ সরকার চালাবেন কি করে?তিনি আরো এক হাজার মুসলমানকে পুলিশ বাহিনীতে ভীর্ত করতে চাইলে তদানীনতন ইংরেজ গভর্নর আপওি তুলেছিলেন।শহীদ সাহেব পদত্যাগের হুমকি দিলে তিনি রাজী হন।পাঞ্জাব থেকে যুদ্ধ ফেরত মিলিটারি লোকদের এনে ভর্তি করলেন।এতে ভীষন হৈচৈ পড়ে গেল।এবং গ্রেস ও হিন্দু মহাসভার কাগজগুলি হৈচৈ বেশি করল। (পৃ-৬৮)।
ভূক্তি-৩৮৫ কলকাতার দাঙ্গা বন্ধ হতে না হতেই দাঙ্গা শুরু হলো নোয়াখালীতে।মুসলমানরা সেখানে হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুট করল এবং আগুন লাগিয়ে দিল।ঢাকায় তো দাঙ্গা লেগেই আছে।এর প্রতিক্রিয়ায় শুরু হলো বিহারে ভয়াবহ দাঙ্গা। (পৃ-৬৮)।
ভূক্তি-৩৮৬ বিহার প্রদেশের বিভিন্ন জেলায় মুসলমানদের উপর প্ল্যান করে আক্রমন হয়েছিল।এতে অনেক লোক মারা যায়।বহু ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। (পৃ-৬৮)।
ভূক্তি-৩৮৭ বিহার দাঙ্গাশুরু হওয়ার তিন দিনের মধ্যে শেখ মুজিব দলসহ গেলেন পাটনায়। অনেক ডাক্তারও কলকাতা থেকে গিয়েছিল। (পৃ-৬৮)।
ভূক্তি-৩৮৮ শেখ মুজিবের কলকাতার সহকর্মী ইয়াকুব খুব ভাল ফটোগ্রাফার,ঘুরে ঘুরে বিহারের অনেক ছবি তুলেছিল। (পৃ-৬৮)।
ভূক্তি-৩৮৯ জহিরুদ্দিন,নূরুদ্দিন ও শেখ মুজিব যেদিন যান সেদিন ফজলুল হক সাহেবও পাটনার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। (পৃ-৬৯)।
ভূক্তি-৩৯০ পাটনায় নেমে শেখ মুজিব ভয় পেয়ে গেলেন।শেখ মুজিব তার সাথীদের সহ ‘গ্রান্ড হোটেল’ (বিহার সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টার ইউনুস সাহেবের হোটেল) এ উঠলেন। (পৃ-৬৯)।
ভূক্তি-৩৯১ শহীদ সাহেব বললেন,“ট্রেন ভরে রিফিউজিদের আসানসোলে পৌছে দিলে বাংলা সরকার তাদের সকল দয়িত্ব নিতে রাজি আছে”। (পৃ-৬৯)।
ভূক্তি-৩৯২ জনাব আকমল (আইসিএস) শেখ মুজিবকে জিঞ্জাসা করলেন,“আপনি কেমন করে শহীদ সাহেবের পক্ষ থেকে কথা বলতে পারেন”? শেখ মুজিবের বয়স অল্প দেখে আকমল সাহেব বিশ্বাসই করতে পারলেন না যে, শহীদ সাহেব এ ব্যাপারে তার সাথে কথা বলতে পারেন।শেখ মুজিব বললেন,“আমি শহীদ সাহেবের মতামত জানি এবং তাঁর পক্ষ থেকে কথাও কিছু বলতে পারি”। আমি শহীদ সাহেবের ফোন নম্বর দিয়ে বললাম,“টেলিফোন করে দেখতে পারেন”। অনেকে শেখ মুজিবের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। (পৃ-৬৯)।
ভূক্তি-৩৯৩ আকমল সাহেব শেখ মুজিবকে বললেন,“আজ থেকেই আমরা আসানসোলে লোক পাঠাব”। (পৃ-৬৯)।
ভূক্তি-৩৯৪ কলকাতা থেকে ছাএ,ডাক্তার,ন্যাশনাল গার্ড মিলে প্রায় হাজার লোক পাটনায় জমা হয়েছে। (পৃ-৬৯)।
ভূক্তি-৩৯৫ শেখ মুজিব হাজার খানেক রিফিউজি নিয়ে রওনা দিলেন আসানসোলের দিকে ।আসানসোল মুসলিমলীগ নেতা মওলানা ইয়াসিন সাহেবকে টেলিগ্রাম করা হয়েছে। তিনি দু’খানা ট্রাক ও কিছু ভলানটিয়ার নিয়ে স্টেশনে হাজির ছিলেন। লোক গুলিকে প্লাটফমেই রাখা হলো।অনেক লোক জখম ছিল। (পৃ-৬৯)।
ভূক্তি-৩৯৬ শহীদ সাহেব জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও এসডিওকে হুকুম দিয়েছেন দুর্গতদের জায়গা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করতে। (পৃ-৬৯)।
ভূক্তি-৩৯৭ এসডিও ছিলেন একজন ইউরোপিয়ান।তিনি যুবক ও খুবই ভদ্রলোক। (পৃ-৬৯)।
ভূক্তি-৩৯৮ শহীদ সাহেব হুকুম দিলেন যুদ্ধের সময় সৈনিকদের জন্য তৈরী করা ব্যারাকে রিফিউজিদের রাখতে । (পৃ-৬৯)।
ভূক্তি-৩৯৯ সরকারি খাদ্য বিলির জন্য এসডিও,আসানসোলের মুসলিমলীগ নেতারা ও শেখ মুজিব বৈঠক করলেন। (পৃ-৭০)।
ভূক্তি-৪০০ প্রথমে ক্যাম্প খোলা হল “নিগাহ” নামে একটি ছোট গুদামে।এতে হাজার খানেক লোকের জায়গা হবে। পরে কান্দুলিয়া ক্যাম্প খোলা হল।এতে প্রায় দশ হাজার লোকের জায়গা হবে ।শেখ মুজিব এই ক্যাম্পের নাম দিলেন“হিজরতগঞ্জ” এবং মওলানা ইয়াসিন নামটি গ্রহন করলেন এবং খুশি হলেন। (পৃ-৭০)।
ভূক্তি-৪০১ আসানসোল ও পরে রানীগঞ্জ স্টেশনে মোহাজেরদের নামানো হতো।পরে ট্রাকভরে ক্যাম্প গুলিতে নিয়ে আসা হতো।শেখ মুজিবের সাথে সব সময় কাজ করতেন মওলানা ওয়াহিদ সাহেব। (পৃ-৭০)।
ভূক্তি-৪০২ শেখ মুজিব ও অন্যান্য কর্মীদের খাওয়া-দাওয়ার কোনো বন্দোবস্ত ছিল না। মোহাজেরদের জন্য যা পাক হতো তাই তাঁরা খেতেন।দিনে একবারের বেশি মোহাজেরদের খাবার দেওয়া যেত না। (পৃ-৭০)।
ভূক্তি-৪০৩ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে একটি হাসপাতাল চালুহয়েছিল (মোহাজেরদের জন্য)।(পৃ-৭০)।
ভূক্তি-৪০৪ আসানসোলের এসডিও মিস্টার রোজ চার-পাঁচ দিন পরে একজন বৃদ্ধা মেম সাহেবকে নিয়ে এলেন।তিনি ছিলেন এ কাজে অভিজ্ঞ(রিলিফ সংক্রান্ত)।তিনি যে প্ল্যান দিলেন তাতে কাজের সুবিধা হলো। (পৃ-৭০)।
ভূক্তি-৪০৫ ছয়-সাত দিন পরে বাংলা সরকার জনাব সলিমুল্লাহ ফাহমীকে বিহার মোহাজেরদের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী নিয়োগ করলেন।তিনি আসানসোলে গিয়ে শেখ মুজিবের খোঁজ করেন।তিনি শেখ মুজিবের সাক্ষাত পেলেন ‘ময়রা’ ক্যাম্পে এবং ক্যাম্পগুলিকে সরকারের তও¦াবধানে নিয়ে গেলেন। (পৃ-৭০)।
ভূক্তি-৪০৬ শেখ মুজিব ও সলিমুল্লাহ সাহেব পরামর্শ করে মোহাজেরদের মধ্য হতে সুপারিনটেনডেন্ট,এসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট,রেশন ইনচার্জ,দারোয়ান ও অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ করলেন।(পৃ-৭০)।
ভূক্তি-৪০৭ রেশন কার্ড করে প্রত্যেক ফ্যামিলিকে বিনা পয়সায় চা,জ¦ালনীকাঠ,মরিচ,পিয়াজ ইত্যাদি সাত দিনের জন্য দেওয়ার ব্যবস্থা হল।শুধু মাংসের ব্যবস্থা কদিন পরপর।(পৃ-৭০)।
ভূক্তি-৪০৮ বিহার হতে জাফর ইমাম সাহেব মোহাজেরদের দেখতে (বাংলাদেশের লোকেরা কেমন রেখেছে) এলেন।তিনি শেখ মুজিবের সাথে দেখা করলেন রিলিফ অফিসে।তিনি সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ধেখে শেখ মুজিবকে ও তার সহকর্মীদের অনেক ধন্যবাদ দিয়েছিলেন।তিনি মোহাজেরদের সাথে দেখা করে তাদের সুবিধা ও অসুবিধার কথা জিঙ্গাসা করেছিলেন।(পৃ-৭০)।
ভূক্তি-৪০৯ পরে ময়রা ও মাধাইগঞ্জে ক্যাম্প খোলার ব্যবস্থা করলেন শেখ মুজিব।এই দুই ক্যাম্পে প্রায় দশ হাজার মোহাজের দেওয়া হয়েছিল।অনেক শিক্ষিত ভদ্র ফ্যামিলিও এসেছিলেন।(পৃ-৭০)।
ভূক্তি-৪১০ আসানসোলে জায়গা না হওয়াতে বিষ্ণুপুর,অন্ডাল এবং বর্ধমানেও কিছু মোহাজের পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন শেখ মুজিব । (পৃ-৭১)।
ভূক্তি-৪১১ শেখ মুজিবের সাথের প্রায় সকল কর্মী আহার,নিদ্রার অভাব ও কাজের চাপে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।শেখ মুজিব তাদের অনেককে আগেই কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন।(পৃ-৭১)।
ভূক্তি-৪১২ শেখ মুজিবের জ¦র হলো।এই সময় মোহাম্মদ আলী ও এ.এফ.এম আবদুর রহমান মন্ত্রী ছিলেন।তাঁরা শেখ মুজিবকে খবর দিয়ে আসানসোলে আসেন।শেখ মুজিব তাদের সাথে দেখাকরেন।তাদের ক্যাম্পগুলি দেখিয়েছিলেন।(পৃ-৭১)।
ভূক্তি-৪১৩ সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শেখ মুজিব তাঁদের সাথেই কলকাতায় ফিরে যেতে বাধ্য হলেন (শারীরিক কারনে)।বেগম সোলায়মান শেখ মুজিবের শরীর ও চেহারা দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। (পৃ-৭১)।
ভূক্তি-৪১৪ দেড়মাস পরে বিহার হতে শেখ মুজিব কলকাতায় আসেন অসুস্থ শরীর নিয়ে।বেকার হোস্টেলে এসে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন।তাঁর জ¦র ছাড়ছিল না।শহীদ সাহেব খবর পেয়ে এত কাজের ভিতরেও শেখ মুজিবকে ভোলেন নাই।ট্রপিকাল স্কুল অব মেডিসিনের ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডে শেখ মুজিবের জন্য সিট ঠিক করে খবর পাঠিয়ে দিলেন। (পৃ-৭১)।
ভূক্তি-৪১৫ শেখ মুজিব পনেরদিন হাসপাতালে ছিলেন।শহীদ সাহেব ফোন করে প্রিন্সিপালের কাছ থেকে শেখ মুজিবের খোঁজ নিতেন।প্রিন্সিপাল সাহেবও শেখ মুজিবকে হাসপাতালে দেখতে যেতেন।ভাল হয়ে শেখ মুজিব আবার হোস্টেলেফিরে গেলেন। (পৃ-৭১)।
ভূক্তি-৪১৬ আসানসোলে ইউরোপিয়ান ভদ্রমহিলার কাছ থেকে এবং নিজ হাতে কাজ করে যে অভিজ্ঞতা শেখ মুজিব পেয়েছিলেন পরবর্তী জীবনে তা তাঁর অনেক উপকার করেছিল। (পৃ-৭১)।
ভূক্তি-৪১৭ এ সময় শেখ মুজিব মনস্থির করলেন তাকে পরীক্ষা দিতে হবে।প্রিন্সিপাল ড.জুবেরী বললেন,“তুমি যথেষ্ট কাজ করেছ পাকিস্তান অর্জন করার জন্য। তোমাকে আমি বাধা দিতে চাই না।যদি তুমি ওয়াদা কর যে এই কয়েকমাস লেখা পড়া করবা এবং কলকাতা ছেড়ে বাইরে কোথাও চলে যাবা এবং ফাইনাল পরীক্ষার পূর্বেই এসে পরীক্ষা দিবা,তাহলে তোমাকে আমি অনুমতি দিব”। তখন টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে ।শেখ মুজিব ওয়াদা করলেন প্রফেসর তাহের জামিল,প্রফেসর সাইদুর রহমান এবংয় প্রফেসর নাজির আহমদের সামনে।শেখ মুজিব অনুমতি নিয়ে তাঁর এক বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী শেখ শাহাদাৎ হোসেন (১৯৪৬ সালে বিএ পাস করেছে) এর কাছে চলে গেলেন(হাওড়ার উল্টোডাঙ্গায়) সমস্ত বইপএ নিয়ে। (পৃ-৭১)।
ভূক্তি-৪১৮ শেখ মুজিব বিএ পরীক্ষার কিছুদিন পূর্বে কলকাতায় ফিরে আসেন।হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছেন।ছোট বোনের পার্ক সার্কাসের বাসায় উঠলেন। (পৃ-৭১)।
ভূক্তি-৪১৯ কিছুদিন পরে রেণু কলকাতায় এসে হাজির। রেণুর ধারনা,পরীক্ষার সময় সে পাশে থাকলে শেখ মুজিবের পরীক্ষা ভালো হবে।নিশ্চয়ই তিনি পাস করবেন। (পৃ-৭২)।
ভূক্তি-৪২০ বিএ পরীক্ষা দিয়ে শেখ মুজিব পাস করলেন।শেখ শাহাদাত হোসেন দুই মাসের ছুটি নিয়ে শেখ মুজিবকে পড়তে সাহায্য করেছিল।পরে জীবনে সে শেখ মুজিবের অনেক ক্ষতি করেছে।উপকার করার কারনে শেখ মুজিব তাকে কিছুই বলেননি (ক্ষতি করাতেও)।ওর বাড়ি শেখ মুজিবের বাড়ির কাছাকাছি। (পৃ-৭২)।
ভূক্তি-৪২১ ১৯৪৬ সালের শেষের দিকেভারতের রাজনীতিতে এক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল।ব্রিটিশ সরকার বদ্ধপরিকরÑযে কোনোমতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। (পৃ-৭২)।
ভূক্তি-৪২২ কংগ্রেস পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকারে যোগদান করে।মুসলিমলীগ যোগদান করতে অস্বীকার করলেও শেষ পর্যন্ত জিন্নাহ-ওয়েভেল আলোচনা করে মুসসলিমলীগকে সরকারে যোগদান করাতে রাজি করে।(পৃ-৭২)।
ভূক্তি-৪২৩ অক্টোবর মাসের শেষের দিকে লিয়াকত আলী খান,রাজা গজ্নফর আলী এবং যোগেন্দ্রানাথ মন্ডল মুসলিমলীগের পক্ষ হতে অন্তবর্তীকালীন সরকারে যোগদান করেন। (পৃ-৭২)।
ভূক্তি-৪২৪ ১৯৪৭ সালের জুন মাসে ঘোষনা করা হলো ভারতবর্ষ ভাগ হবে । (পৃ-৭৩)।
ভূক্তি-৪২৫ কংগ্রেস ভারতবর্ষকে ভাগ করতে রাজী হয়েছে এই জন্য যে,বাংলাদেশ ও পাঞ্জাব ভাগ হবে। (পৃ-৭৩)।
ভূক্তি-৪২৬ কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা বাংলাদেশ ভাগ করতে হবে বলে জনমত সৃস্টি করতে লাগলো।কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ও কেন্দ্রীয় মুসলিমলীগ মেনে নিয়েছিল এ ভাগের ফর্মুলা। (পৃ-৭৩)।
ভূক্তি-৪২৭ বাংলাদেশ যে ভাগ হবে তা বাংলাদেশের নেতারা জানতেন না।সমস্ত বাংলা ও আসাম পাকিস্তানে আসবে এটিই ছিল তাঁদের ধারনা । (পৃ-৭৩)।
ভূক্তি-৪২৮ কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের কর্মীরা এসে শেখ মুজিব এবংঅন্যান্যদের বলত । তোমরা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে; আমাদের কপালে যে কি হবে খোদাই জানে।শেখ মুজিব ওদের কথা শুনে খুব দুঃখ পেলেন। (পৃ-৭৩)।
ভূক্তি-৪২৯ শহীদ সাহেবের পক্ষ থেকে বাংলা সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ আলী ঘোষনা করেছিলেন, কলকাতা আমাদের রাজধানী থাকবে।দিল্লি বসে অনেক আগেই যে কলকাতাকে ছেড়ে দেওয়া। (পৃ-৭৩)।
ভূক্তি-৪৩০ হয়েছে একথা তো শেখ মুজিব সহ কেউ জানতেন না,বুঝতেনও না। (পৃ-৭৩)।
ভূক্তি-৪৩১ এ সময় শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব মুসলিমলীগের তরফ হতে এবং শরৎ বসু ও কিরনশংকর রায় কংগ্রেসের তরফ হতে আলোচনা সভা করেন।তারা এই সিদ্ধান্তে আসেন যে,বাংলাদেশ ভাগ না করে অন্যপন্থা অবলম্বন করা যায় কি না? (পৃ-৭৩)।
ভূক্তি-৪৩২ বাংলাদেশের কংগ্রেস ও মুসলিমলীগের নেতারা একটি ফর্মুলা বের করেন। (পৃ-৭৩)।
ভূক্তি-৪৩৩ বেঙ্গল মুসলিমলীগ ওয়র্কিং কমিটি এক ফর্মুলা সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহন করে।এতে বলা হয় জনগণের ভোটে একটি গণপরিষদ হবে।সে পরিষদ ঠিক করবে বাংলাদেশ হিন্দুস্তান না পাকিস্তানে যোগদান করবে। নাকি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে। (পৃ-৭৩)।
ভূক্তি-৪৩৪ এই ফর্মুলা নিয়ে সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসু দিল্লিতে জিন্নাহ ও গান্ধীর সাথে দেখা করতে যান। শরৎ বাবু লিখে গেছেন যে, “জিন্নাহ তাঁকে বলেছিলেন,মুসলিমলীগের কোনো আপওি নাই; যদি কংগ্রেস রাজি হয়”। বিট্রিশ সরকার বলে দিয়েছিল কংগ্রেস ও মুসলিমলীগ একমত না হলে তারা কোন নতুন ফর্মুলা মানতে পারবেন না।মহাত্মাগান্ধী ও পন্ডিত নেহেরু কোন কিছুই না বলে শরৎ বাবুকে সরদার প্যাটেলের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল শরৎবাবুকে বলেছিলেন, “শরৎবাবু পাগলামি ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই”। (পৃ-৭৪)।
ভূক্তি-৪৩৫ কলকাতা ফিরে শরৎ বাবু খবরের কাগজে বিবৃতির মাধ্যমে একথা বলেছিলেন এবং জিন্নাহ যে রাজি হয়েছিলেন তাও স্বীকার করেছিলেন। (পৃ-৭৪)।
ভূক্তি-৪৩৬ খাজা নাজিমুদ্দীন ১৯৪৭ সালের ২২ এপ্রিল ঘোষনা করেছিলেন,“যুক্ত বাংলা হলে হিন্দু-মুসলমানের মঙ্গলই হবে।” (পৃ-৭৪)।
ভূক্তি-৪৩৭ মওলানা আকরম খাঁ মুসলিমলীগের সভাপতি হিসেবে ঘোষনা করেছিলেন,“আমার রক্তের উপর দিয়ে বাংলাদেশ ভাগ হবে।আমার জীবন থাকতে বাংলাদেশ ভাগ হতে দেব না।সমস্ত বাংলাদেশই পাকিস্তানে যাবে”। (পৃ-৭৪)।
ভূক্তি-৪৩৮ এ সময় লর্ড মাউন্টব্যাটেন তলে তলে কংগ্রেসকে সাহায্য করছিলেন।তার ইচ্ছা ছিল তিনি ভারত ও পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল থাকবেন জিন্নাহ রাজী হলেন না নিজেই পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল হয়ে বসলেন। (পৃ-৭৪)।
ভূক্তি-৪৩৯ মাউন্টব্যাটেন ক্ষেপে গিয়ে পাকিস্তানের সর্বনাশ করার চেষ্টা করলেন।র্যাডক্লিফকে সীমানা নির্ধারন করার ভার দেওয়া হলেও গোপনে মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেসের সাথে পরামর্শ করে একটি ম্যাপ তৈরী করেছিলেন বলে অনেকের ধারনা। (পৃ-৭৪)।
ভূক্তি-৪৪০ জিন্নাহ গভর্নর জেনারেল হোক তা শেখ মুজিব সহ যুবকরা চাননি। (পৃ-৭৪)।
ভূক্তি-৪৪১ তিনি প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হবেন,পরে প্রেসিডেন্ট হবেন এটিই শেখ মুজিব সহ সবাই আশা করেছিলেন। (পৃ-৭৫)।
ভূক্তি-৪৪২ লর্ড মাউন্টব্যাটেন পাকিস্তানের বড়লাট থাকলে এতখানি অন্যায় করতে পারতেন কিনা সন্দেহ । (পৃ-৭৫)।
ভূক্তি-৪৪৩ পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছিল।বিশেষ করে জনাব সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে দিল্লিতে এক ষড়যন্ত্র শুরু হয়। (পৃ-৭৫)।
ভূক্তি-৪৪৪ সোহরাওযার্দীর ব্যক্তিত্ব অসাধারন।ভবিষৎতে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চাইবেন ।জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীকে ভালোবাসতেন। (পৃ-৭৫)।
ভূক্তি-৪৪৫ কলকাতায় সম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগেই আছে। (পৃ-৭৫)।
ভূক্তি-৪৪৬ কংগ্রেস কলকাতায় ছায়া মন্ত্রিসভা গঠন করেছে। (পৃ-৭৫)।
ভূক্তি-৪৪৭ অন্যদিকে শহীদ সাহেবকে নেতৃত্ব থেকে নামিয়ে নাজিমুদ্দীনকে বসাবার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে কলকাতা ও দিল্লিতে। (পৃ-৭৫)।
ভূক্তি-৪৪৮ শহীদ সাহেবের অনুরোধে দানবীর রায়বাহাদুর আর .পি.সাহা হিন্দু হয়েও কয়েকখানা লঞ্চ সিলেটে পাঠিয়েছিলেন। এই লঞ্চগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল মুসলিমলীগ ও পাকিস্তানের পক্ষে। (পৃ-৭৬)।
ভূক্তি-৪৪৯ শহীদ সাহেবের বন্ধু ছিলেন রায়বাহাদুর।তাঁর কথা তিনি ফেলতে পারেন নাই ।মির্জাপুর হাসপাতাল,ভারতেশ^রী হোম্স,কুমুদিনি কলেজ তারই দানে টিকে আছে। (পৃ-৭৬)।
ভূক্তি-৪৫০ নির্বাচনের আগের রাতে ডা:মালেক শহীদ সাহেবকে বললেন,“আমাদের অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না।কিছু টাকা খরচ করলে বোধহয় অবস্থা পরিবর্তন করা যেত। (পৃ-৭৭)।
ভূক্তি-৪৫১ শহীদ সাহেব মালেক সাহেবকে বললেন,“মালেক পাকিস্তান হয়েছে।এর পাক ভূমিকে নাপাক করতে চাই না।টাকা আমি কাউকেই দেব না।এই অসাধু পন্থা অবলম্বন করে নেতা আমি হতে চাই না। আমার কাজ আমি করেছি”। (পৃ-৭৭)।
ভূক্তি-৪৫২ সেইদিন থেকে শেখ মুজিব শহীদ সাহেবকে আরো ভালোবাসতে শুরু করলেন।(পৃ-৭৭)।
ভূক্তি-৪৫৩ পাকিস্তানের রাজনীতি শুরু হল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে।জিন্নাহ যত দিন বেঁচেছিলেন প্রকাশ্যে কেউ সাহস পায় নাই।যেদিন মারা গেলেন ষড়যন্ত্রের রাজনীতি প্রকাশ্যে শরু হল।(পৃ-৭৮)।
ভূক্তি-৪৫৪ নাজিমুদ্দীন সাহেব নেতা নির্বাচিত হয়েই ঘোষনা করলেন ঢাকা রাজধানী হবে এবং তিনি সদলবলে ঢাকা চলে এলেন।(পৃ-৭৮)।
ভূক্তি-৪৫৫লর্ড মাউন্টব্যাটেন চিন্তিত হয়েছিলেন-কলকাতা নিয়ে কি করবেন?ইংরেজ তখনও ঠিক করে নাই কলকাতা পাকিস্তানে আসবে না, হিন্দুস্তানে থাকবে।আর যদি কোন উপায় না থাকে তবে একে ‘ফ্রি শহর’করা যায় কিনা?(পৃ-৭৮)।
ভূক্তি-৪৫৬ শেখ মুজিব বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন করিমগঞ্জ নিয়ে।কারন, তিনি গনভোটের সময় করিমগঞ্জ নিয়ে কাজ করেছিলেন।(পৃ-৭৯)।
ভূক্তি-৪৫৭ নেতারা যদি নেতৃত্ব দিতে ভুল করে,জনগনকে তার খেসারত দিতে হয়।যে কলকাতা পূর্ববাংলার টাকায় গড়ে উঠেছিল সে কলকাতা আমরা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম।(পৃ-৭৯)।
ভূক্তি-৪৫৮ ইংরেজদের শাসনের প্রথমদিকে কলকাতা একবার সারা ভারতবর্ষের রাজধানী ছিল।তদনীন্তন ভারত বর্ষের শ্রেষ্ঠশহর কলকাতা।(পৃ-৭৯)।
ভূক্তি-৪৫৯ হাশিম সাহেব শামসুল হক সাহেবকে ঢাকা থেকে ডেকে নিয়ে বললেন,“কলকাতার কর্মীরাও অনেকে ঢাকা চলেছে।আমি পাকিস্তানে যাব না।তোমরা প্রেসটা ঢাকায় নিয়ে একে কেন্দ্র করে দলটা ঠিক রাখ,আর কাজ চালিয়ে যাও”। (পৃ-৭৯)।
ভূক্তি-৪৬০ শামসুল হক সাহেব শেখ মুজিব সহ অন্যান্যদের সাথে পরামর্শ করে ঠিক করলেন ঢাকার লীগ অফিস ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে প্রেসটা বসানো হবে।মিল্লাত কাগজ চলবে; আমরা এক একজন এক একটি বিভাগের দায়িত্ব নেব।(পৃ-৭৯)।
ভূক্তি-৪৬১ প্রেস বিক্রির কথা শুনে, শেখ মুজিব হাশিম সাহেবকে বললেন,“প্রেসটা নাকি বিক্রি করবেন”? হাশেম সাহেব বললেন,“উপায় কি? প্রত্যেক মাসেই লোকসান হচ্ছে; কি করি?আর চালাবে কে”? (পৃ-৮০)।
ভূক্তি-৪৬২ এক পর্যায়ে হাশিম সাহেব রেগে গেলে শেখ মুজিবও রেগে গেলেন এবং বললেন ‘‘প্রেস বিক্রি করতে গেলে আমি বাধা দেব, কে আসে এই মিল্লাত প্রেসে?’’ হাশিম সাহেব এতে খুব দুঃখ পেলেন(পৃ-৮০)।
ভূক্তি-৪৬৩ এমন সময় শেখ মুজিব শহীদ সাহেবের কাছে রোজই যান। তাঁর সাথে সভা-সমিতিতেও যান যেখানে সাম্প্রদায়িক সৎভাব সৃষ্টি হয়(পৃ-৮০)।
ভূক্তি-৪৬৪ হাশিম সাহেবের ঘটনা শহীদ সাহেবকে বললে তিনি শেখ মুজিবকে রাগ করলেন। কত বড় উদার ছিলেন শহীদ সাহেব(পৃ-৮০)।
ভূক্তি-৪৬৫ শেখ মুজিব হাশিম সাহেবের সাথে দেখা করে বললেন, ‘‘আপনি কিছু মনে করবেন না, আমার এভাবে কথা বলা অন্যায় হয়েছে। আপনি যা ভাল বোঝেন তাই করুন। আমার কিছুই করার নাই। শেখ মুজিব দেখা করাতে হাশিম সাহেব খুশি হয়েছিলেন। তার সাথে ভিন্নমত হতে পারে, কিন্তু তার কাছ থেকে যে রাজনৈতিক শিক্ষা পেয়েছি, সেটা তো ভোলা কষ্টকর। আমার যদি কোন ভুল হয় বা অন্যায় করে ফেলি; তা স্বীকার করতে আমার কোনদিন কষ্ট হয় নাই। ভুল হলে সংশোধন করে নেব, ভুল তো মানুষের হয়েই থাকে। আমার নিজেরও একটা দোষ ছিল, আমি হঠাৎ রাগ করে ফেলতাম। তবে রাগ আমার বেশি সময় থাকত না। — শেখ মুজিব (পৃ-৮০)।
ভূক্তি-৪৬৬ যদি ভুল হয়, সংশোধন করে নেই। কারণ, যারা কাজ করে তাদেরই ভুল হতে পারে, যারা কাজ করেনা তাদের ভুলও হয় না। —— শেখ মুজিব। (পৃ-৮০)।
ভূক্তি-৪৬৭ এ সময় শহীদ সাহেবের সাথে শেখ মুজিব কয়েক জায়গায় গিয়েছিলেন। (পৃ-৮১)।
ভূক্তি-৪৬৮ মহাত্মা গান্ধীর সাথে শহীদ সাহেব হিন্দু-মুসলমান শান্তি কায়েম করার জন্য কাজ করছিলেন। (পৃ-৮১)।
ভূক্তি-৪৬৯ শহীদ সাহেব শেখ মুজিবকে বললেন, চল ব্যারাকপুরে যাই। সেখানে খুব গোলমাল হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীও যাবেন। শেখ মুজিব বললেন ‘‘যাব স্যার’’। (পৃ-৮১)।
ভূক্তি-৪৭০ নারকেলডাঙ্গা হতে মহাত্মাজী, মনু গান্ধী, আভা গান্ধী ও তার সেক্রেটারী শেখ মুজিব ও শহীদ সাহেবের সাথে চললেন। (পৃ-৮১)।
ভূক্তি-৪৭১ ব্যারাকপুরের রাস্তার আশে পাশে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। তাদের মুখে একই কথা, ‘‘বাপুজী কি জয়’’ । (পৃ-৮১)।
ভূক্তি-৪৭২ রবিবার মহাত্মা গান্ধী কথা বলেন না। বক্তৃতা তো করবেনই না। মহাত্মাজীর লিখিত বক্তব্য তার সেক্রেটারী পড়ে শোনালেন। (পৃ-৮১)।
ভূক্তি-৪৭৩ মহাত্মা গান্ধী সত্যিই যাদু জানতেন। তার লিখিত বক্তব্য শুনে লোকে চিৎকার করে উঠল হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই। সমস্ত আবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল এক মূহূর্তের মধ্যে।(পৃ-৮১)।
ভূক্তি-৪৭৪ শেখ মুজিব ও তার ফটোগ্রাফার বন্ধু ইয়াকুব গান্ধীজিকে উপহার দিবেন স্থির করলেন। উপহারের প্যাকেটে থাকবে ইয়াকুবের তোলা মুসলমান মেয়েদের স্তন কাটা, ছোট শিশুদের মাথা নাই, বস্তি-মসজিদে আগুন জ্বলছে, রাস্তায় লাশ পড়ে আছে এসব সহ আরও অনেক ছবি’’ (পৃ-৮১)।
ভূক্তি-৪৭৫ শেখ মুজিব ও ইয়াকুবের ভাবনা, মহাত্মাজী দেখুক কিভাবে তাঁর লোকেরা দাঙ্গাহাঙ্গামা করেছে এবং নিরীহ লোককে হত্যা করেছে। (পৃ-৮১)।
ভূক্তি-৪৭৬ শেখ মুজিব ও ইয়াকুব নারকেলডাঙ্গায় মাহাত্মাজীর ওখানে গেলেন। গান্ধীজীর সাথে দেখা করতে তাঁর কামরায় গেলেন। মহাত্মাজী তাঁদের কয়েকটি আপেল দিলেন। শেখ মুজিব ও ইয়াকুব প্যাকেটটা উপহার দিলেন। গান্ধীজী হাসিমুখে উপহার গ্রহণ করলেন। (পৃ-৮১)।
ভূক্তি-৪৭৭ উপহার দিয়েই শেখ মুজিব ও ইয়াকুব তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। শেখ মুজিব পরে শহীদ সাহেবকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। (পৃ-৮২)।
ভূক্তি-৪৭৮ কলকাতায় থাকা শেখ মুজিবের পক্ষে সম্ভব ছিল না। গ্রেফতার শুরু হয়েছিল। শেখ মুজিব ও তার ভগ্নিপতি আবদুর রব সাহেব কলকাতার পার্ক সার্কাসে একটি রেষ্টুরেন্ট করেছিলেন। (পৃ-৮২)।
ভূক্তি-৪৭৯ শেখ মুজিব শহীদ সাহেবের কাছে বিদায় নিতে গেলেন। তাকে রেখে চলে আসতে শেখ মুজিবের খুব কষ্ট হচ্ছিল (পৃ-৮২)।
ভূক্তি-৪৮০ শহীদ সাহেবকে শেখ মুজিব বললেন, ‘‘চলুন স্যার পাকিস্তানে, এখানে থেকে কি করবেন?’’ তিনি বললেন ‘‘যেতে তো হবেই, তবে এখন এই হতভাগা মুসলমানদের জন্য কিছু একটা না করে যাই কি করে ? আমি চলে গেলে এদের আর উপায় নাই’’ । তিনি আরো বললেন, ‘‘তোমরা একটা কাজ করো দেশে গিয়ে, সাম্প্রদায়িক গোলমাল যাতে না হয়, তার চেষ্টা করো। পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্যই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে দিও না’’। (পৃ-৮২)
ভূক্তি-৪৮১ শেখ মুজিব শহীদ সাহেবকে বললেন, ‘‘ঢাকা যেতে হবে, শামসুল হক সাহেব খবর দিয়েছেন। রাজনৈতিক কর্মীদের একটা সভা হবে। পরে আবার একবার এসে দেখা করব। শহীদ সাহেব শেখ মুজিবকে বললে, ‘‘এস’’। (পৃ-৮২)।
ভূক্তি-৪৮২ শেখ মুজিব ভাবতে লাগলেন, পাকিস্তান কায়েম হয়েছে। আর চিন্তা কি? এখন ঢাকায় যেয়ে ল’ ক্লাসে ভর্তি হয়ে কিছুদিন মন দিয়ে লেখাপড়া করা যাবে। পাশাপশি ভাবলেন, চেষ্টা করব, সমস্ত লীগ কর্মীদের নিয়ে যাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা না হয়। (পৃ-৮২)।
ভূক্তি-৪৮৩ বাবা, মা ও রেনুর কাছে কয়েকদিন থেকে শেখ মুজিব সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা গেলেন। পূর্বে দু’একবার তিনি ঢাকা গিয়েছেন বেড়াতে। পথ-ঘাট চেনেন না। শেখ মুজিব ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে লীগ অফিসে গেলেন। (পৃ-৮৩)।
ভূক্তি-৪৮৪ কিছুদিনের জন্য শেখ মুজিব কলকাতায় যান।তাদের রেস্টুরেন্ট বিক্রির ব্যাপারে খবর নিতে। (পৃ-৮৩)।
ভূক্তি-৪৮৫ শহীদ সাহেব পূর্ব পাঞ্জাব,দিল্লি,জয়পুর আলোয়ার ঘুরে কলকাতায় এসেছেন।তিনি খুব চিন্তিত।এসকল জায়গায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। ভারতবর্ষও পাকিস্তানে তিনিই একমাএ মুসলমান নেতা তিনি সাহস করে সে সকল জায়গায় গিয়ে স্বচক্ষে করুন অবস্থা দেখে এলেছেন।শেখ মুজিবকে দেখে শহীদ সাহেব খুব খুশি হলেন। (পৃ-৮৩)।
ভূক্তি-৪৮৬ শেখ মুজিব ঢাকায় এলেন। বরিশালের সভায় যোগ দিলেন। শহীদ সাহেব থাকলেন। (পৃ-৮৬)।
ভূক্তি-৪৮৭ ভোরবেলা পাটগাতি স্টেশনে ষ্টিমার এসে পৌছালো।যেটি শেখ মুজিবের বাড়ি হতে প্রায় আড়াই মাইল দুরে।বাড়ি পৌছে দেখেন তার বাবার কলেরা হয়েছে। শেখ মুজিব বাবার বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেললেন। (পৃ-৮৬)।
ভূক্তি-৪৮৮ শেখ মুজিবের বাবা আস্তে আস্তে আরোগ্য লাভ করলেন। “যে ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা মায়ের ¯েœহ থেকে বঞ্চিত তাদের মত হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নাই। আর যারা বাবা মায়ের ¯েœহ আর আশীর্বাদ পায় তাদের মত সৌভাগ্যবান কয়জন!” -শেখ মুজিব। (পৃ-৮৭)।
ভূক্তি-৪৮৯ শেখ মুজিব ঢাকায় চলে এলেন। বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন।আইন পড়বেন।বই-পুস্তক কিছু কিনলেন। (পৃ-৮৭)।
ভূক্তি-৪৯০ শেখ মুজিবুর রহমান ‘ইওেহাদ’ কাগজের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিলেন। মাসে প্রায় তিনশত টাকা পেতেন। (পৃ-৮৮)।
ভূক্তি-৪৯১ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রথম সভার জায়গা ঠিক হল টাঙ্গাইল। শহীদ সাহেব যাবেন।স্টিমারে মানিকগঞ্জ হয়ে যেতে হবে,পথে আরো একটা সভা হবে। (পৃ-১০৮)।
ভূক্তি-৪৯২ সন্ধ্যায় বাদামতলি ঘাট হতে জাহাজ ছাড়বে।মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব সাথে যাবেন। জাহাজ ছয়টায় ছাড়বার কথা, ছাড়ছে না। (পৃ-১০৮)।
ভূক্তি-৪৯৩ বঙ্গবন্ধু খবর নিয়ে জানলেন,সরকার হুকুম দিয়েছে না ছাড়তে। (পৃ-১০৮)।
ভূক্তি-৪৯৪ রাত আটটায় জেলা ম্যজিস্ট্রেট ও ডিআইজি পুলিশ শহীদ সাহেবের হাতে একটা কাগজ দিলেন তাতে লেখা, “তিনি ঢাকা ত্যাগ করতে পারবেন না”। তবে যদি কলকাতা ফিয়ে যান,সরকারের আপওি নেই।তিনি ঢাকার যে কোনো জায়গায় থাকতে পারেন তাতেও আপওি নেই। (পৃ-১০৮)।
ভূক্তি-৪৯৫ শহীদ সাহেব জাহাজ ছেড়ে নেমে আসলেন।শেখ মুজিবও তার মালপএ নিয়ে সাথে নেমে এলেন।কোথায় থাকবেন তিনি?আর কেইবা জায়গা দেবেন?(শহীদ সাহেবকে) (পৃ-১০৮)।
ভূক্তি-৪৯৬ কামরুদ্দিন সাহেব ক্যাপ্টেন শাহজাহান ও তাঁর স্ত্রী বেগম নূরজাহানের সাথে সাক্ষাৎ করবেন কারন তাঁদের বাড়িটা সুন্দর ও থাকার মত ব্যবস্থাও আছে। (পৃ-১০৮)।
ভূক্তি-৪৯৭ বেগম নূরজাহান বললেন, “এ তো আমাদের সৌভাগ্য। শহীদ সাহেবকে আমি বাবার মত ভক্তি করি। আমাদের বাড়িতেই থাকবেন তিনি, নিয়ে আসুন”। (পৃ-১০৮)।
ভূক্তি-৪৯৮ সেইদিন এই উপকার বেগম নূরজাহান না করলে সত্যিই দু:খের কারন হত।পাকিস্তান সত্যিকারে যিনি সৃষ্টি করেছিলেন,সেই লোকের থাকার জায়গা হল না(বঙ্গবন্ধু)। (পৃ-১০৮)।
ভূক্তি-৪৯৯ দুইদিন শহীদ সাহেব ছিলেন তাঁর বাসায়।কি সেবাই না ভদ্রমহিলা করেছিলেন, তা প্রকাশ করা কষ্টকর।(বঙ্গবন্ধু) (পৃ-১০৮)।
ভূক্তি-৫০০ দুই দিন পরে শহীদ সাহেবকে নিয়ে নারাণগঞ্জে জাহাজে তুলে দিলেন। বঙ্গবন্ধু সাথে যেতে চেয়েছিলেন।শহীদ সাহেব রাজী হলেন না। (পৃ-১০৮)।
ভূক্তি-৫০১ বঙ্গবন্ধু বিদায় নিতে গেলে শহীদ সাহেব বললেন, “তোমার উপরও অত্যাচার আসছে। এরা পাগল হয়ে গেছে।শাসন যদি এইভাবে চলেবলা যায় না,কি হবে!” (পৃ-১০৯)।
ভূক্তি-৫০২ বঙ্গবন্ধু বললেন, “স্যার,চিন্তা করবেন না, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার শক্তি খোদা আমাকে দিয়েছেন।আর সে শিক্ষা আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি”। (পৃ-১০৯)।
ভূক্তি-৫০৩ ১৯৪৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরন করেন এবংখাজা নজিমুদ্দীনকে গর্ভনর জেনারেল নিযুক্ত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন জনাব নূরুল আমিন সাহেব। (পৃ-১০৯)।
ভূক্তি-৫০৪ এই সময়ও কিছু সংখক এমএলএ শহীদ সাহেবকে র্পূব বাংলায় এসে প্রধানমন্ত্রী হতে অনুরোধ করেছিলেন।তিনি রাজী হন নাই।গনপরিষদে একটা নতুন আইন পাস করে শহীদ সাহেবকে গনপরিষদ থেকে বের করে দেওয়া হল। (পৃ-১০৯)।
ভূক্তি-৫০৫ বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাএলীগ সংগঠনের দিকে নজর দিলেন। (পৃ-১০৯)।
ভূক্তি-৫০৬ প্রধানমন্ত্রী জনাব লিয়াকত আলী খান সর্বময় ক্ষমতার মালিক হলেন। তিনি কোনো সমালোচনাই সহ্য করতে পারছিলেন না। (পৃ-১০৯)।
ভূক্তি-৫০৭ দু’চার জন কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন ছাএ ছিল যারা সরকারকে পছন্দ করত না।তাদের আদর্শ তখনকার সাধারন ছাএ ও জনসাধারন শুনলে ক্ষেপে যেত। বঙ্গবন্ধু তাদের বলতেন, “জনসাধারন চলছে পায়ে হেটে,আর আপনারা আদর্শ নিয়ে উড়োজাহাজে চলছেন।জন সাধারন আপনাদের কথা বুঝতেও পারবেনা, আর সাথেও চলবে না ।যতটুকু হজম করতে পারে ততটুকুই জনসাধারনের কাছে পেশ করা উচিত”। তারা তলে তলে বঙ্গবন্ধুরবিরুদ্ধাচারনও করত ,কিন্তু ছাএ সমাজেকে দলে ভেড়াতে পারত না। (পৃ-১০৯)।
ভূক্তি-৫০৮ ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারি মাসে দিনাজপুরেও ছাএদের গ্রেফতার করা হয়েছিল।জেলের ভিতর দবিরল ইসলামকে ভীষনভাবে মারপিট করেছিল। (পৃ-১১০)।
ভূক্তি-৫০৯ ছাএরা শেখ মুজিকে কনভেনর করে “জুলূম প্রতিরোধ দিবস”পালন করার জন্য একটি কমিটি করেছিল। একটা দিবসও ঘোষনা করা হয়েছিল।পুর্ব বাংলার সমস্ত জেলায় জেলায় এই দিবসটি উদ্যাপন করা হয়। (পৃ-১১০)।
ভূক্তি-৫১০ এই প্রথম পাকিস্তানে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আন্দোলন এবং জুলুমের প্রতিবাদ।এর পূর্বে আর কেউ সাহস পায় নাই। (পৃ-১১০)
ভূক্তি-৫১১ আব্বাস উদ্দিন সাহেব বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, “মুজিব,বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষরযন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি,সভ্যতাসব শেষ হযে যাবে।আজ যে গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদা নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্টভাষা করতেই হবে”। বঙ্গবন্ধু কথা দিয়েছিলেন এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলেন। (পৃ-১১১)।
ভূক্তি-৫১২ একটা কমিটি করা হয়েছিল, কর্মচারীদের জন্য একটা ফান্ড করা হবে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে টাকা তুলে সাহায্য করা হবে।কারন,এদের প্রায় সকলেই বিশ-এিশ টাকার বেশি বেতন পেত না।সংসার চালাবে কি করে?(ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের নি¤œভোগী কর্মচারীরা) (পৃ-১১৩)।
ভূক্তি-৫১৩ বঙ্গবন্ধু ট্রেনের মধ্যে খবরের কাগজে দেখলেন তাকে সহ সাতাশজন ছাএকে বিশ^বিদ্যালয় হতে বহিস্কার করা হয়েছে।তবে দন্ড জরিমানা দিলে সকলে লেখাপড়া করতে পারবে (চারজন ছাড়া)। মেয়েদের মধ্যে একমাএ লুলু বিলকিস বানুকে বহিস্কার করা হয়েছিল। তিনি ছাএলীগের মহিলা শাখার কনভেনর ছিলেন। (পৃ-১১৪)।
ভূক্তি-৫১৪ এক মাসের মধ্যে প্রায় সকল কর্মচারীই গোপনে গোপনে কাজে যোগদান করল।বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ, ছাএরা নাই। এই সুযোগে কতৃপক্ষ নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীদের মনোবল ভাঙ্গতে সক্ষম হয়েছিল। (পৃ-১১৪)।
ভূক্তি-৫১৫ সরকারি মুসলীম লীগ ছাড়াও কংগ্রেসের একটি প্রতিষ্ঠান ছিল।এদের সকলেই হিন্দু। এরা বেশি কিছু বললেই ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ আখ্যা দেওয়া হত। (পৃ-১১৪)।
ভূক্তি-৫১৬ ১৯৪৯ সালের মার্চের শেষের দিকে অথবা এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে টাঙ্গাইলে উপনির্বাচন হবে বলে ঘোষনা করা হয়েছিল। ছাএও কর্মীরা ঘড়ি,কলম বিক্রি করেও কিছুটাকা শামসুল হক সাহেবের নির্বাচনের খরচ বাবদ দিয়েছিল। (পৃ-১১৫)।
ভূক্তি-৫১৭ ছাএ প্রতিনিধিদের ধারনা,বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে আন্দোলন চলবে।কারন, আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়েছিল।একে চাঙ্গা করতে হলে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার হওয়া দরকার। বঙ্গবন্ধু সবার এ যুক্তি মেনে নিলেন।সবার সাথে বঙ্গবন্ধু জেলে চলে গেলেন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে)। (পৃ-১১৭)।
ভূক্তি-৫১৮ রেণু তখন হাচিনাকে নিয়ে বাড়িতেই থাকে। হাচিনা তখন একটু হাঁটতে শিখছে। রেণুর চিঠি জেলেই পেয়েছিলাম।কিছু টাকাও আব্বা পাঠিয়েছিলেন। রেণু জানত,আমি সিগারেট খাই।টাকা পয়সা নাও থাকতে পারে।টাকার দরকার হলে লিখতে বলেছিল। (পৃ-১১৮)।
ভূক্তি-৫১৯ ১৯৪৭ সালে যে মুসলিম লীগকে পাগলের মত সমর্থন করেছিল,সেই মুসলিম লীগ প্রার্থীর পরাজয় বরন করতে হল কি জন্য? কোটারি, কুশাসন,অত্যাচার এবং অর্থনৈতিক কোন সুষ্ঠুপরিকল্পনাগ্রহন না করার ফলে।ইংরেজ আমলের সেই বাঁধাধরা নিয়মে শাসন চলল। (পৃ-১১৯)।
ভূক্তি-৫২০ জিন্নাহর মৃত্যুর পর থেকেই কোটারি ও ষরযন্ত্রেররাজনীতির শুরু হয়েছে। লিয়াকত আলী খান এখন সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী।তিনি কাউকেও সহ্য করতে চাইছিলেন না। যদিও তিনি গনতন্ত্রের কথা মুখে বলতেন, কাজে তার উল্টা করছিলেন। (পৃ-১১৯)।
ভূক্তি-৫২১ জিন্নাহ সাহেব বড়লাট হয়ে প্রচন্ড ক্ষমতা ব্যবহার করতেন। খাজা সাহেব কোনো ক্ষমতাই ব্যবহার করতেন না। তিনি সাময়িক ও দুর্বল প্রকৃতির লোক ছিলেন ।ব্যক্তিত্ব বলে তার কিছুই ছিল না। (পৃ-১১৯)।
ভূক্তি-৫২২ পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন সাহেব সরকারি কর্মচারীদের উপর নির্ভর করতেন এবং তাদের রিপোর্টের উপর ভিওি করে অত্যাচার করতে শুরু করলেন।টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে পরাজিত হয়েও তদের চক্ষু খুললনা।সরকারি দল তাদের সভায় ঘোষনা করল, “যা কিছু হোক, শামসুল হক সাহেবকে আইন সভায় বসতে দেওয়া হবেনা”। (পৃ-১১৯)।
ভূক্তি-৫২৩ শামসল হক সাহেব ঢাকায় দিয়ে আসার পরই পুরানা লীগ কর্মীরা মিলে এক কর্মী সম্মেলন ডাকল ঢাকায়-ভবিষ্যৎ কর্ম পন্থা ঠিক করার জন্য।১৯৪৯ সালের ২৩ জুন সে সভা আহবান করা হয়েছিল। (পৃ-১১৯)।
ভূক্তি-৫২৪ কারাগারের যন্ত্রনা কি এইবারই বুঝতে পারলাম।সন্ধ্যর পরে বাইরে থেকে তালা বদ্ধ করে দিলেই আমার খারাপ লাগতো।সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে কয়েদির কামরায় কামরায় বাইরে থেকে তালা বদ্ধ করে দেওয়া হয় গননা করার জন্য।আমি কয়েদিদের কাছে বসে তাদের জীবনের ইতিহাস ও সুখ দুঃখের কথা শুনতে ভালবাসতাম। তখন কয়েদিদের বিড়ি তামাক খাওয়া আইনে নিষেধ ছিল।তবে রাজনৈতিক বন্দিদের নিষেধ ছিল না ।নিজের টাকা দিয়ে কিনে এনে খেতে পারত।একটা বিড়ির জন্য কয়েদিরা পাগল হয়ে যেত।কিন্তু কতৃপক্ষ যদি কাউকেও বিড়ি খেতে দেখত তাহলে তাদের বিচার হত এবং শাস্তি পেত।সিপাহিরা যদি কোনো সময় দয়াপরবশ হয়ে একটা বিড়ি বা সিগারেট দিত কতই না খুশি হত। আমি বিড়ি এনে এদের কিছু কিছু দিতাম।পালিয়ে পালিয়ে খেত কয়েদিরা। (পৃ-১২০)।
ভূক্তি-৫২৫ কর্মী সম্মেলনের জন্য খুব তোড়তোড় চলছিল।জেলে বসেই অন্যান্যদের সাথে বঙ্গবন্ধু খবর পান ১৫০নম্বর মোগলটুলীতে অফিস হয়েছে।শওকত মিয়া সকলের খাওয়া ও থাকার বন্দোবসÍ করত।সে ছাড়া ঢাকা শহরে কেইবা করবে? (পৃ-১২০)।
ভূক্তি-৫২৬ আমি উওর পাঠিয়েছিলাম,ছাএ রাজনীতি আমি আর করব না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ,বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে”(বঙ্গবন্ধু) (পৃ-১২০)।
ভূক্তি-৫২৭ নাম দেওয়া হল, “পূর্ব পাকিস্তন আওয়ামী মুসমিল লীগ”। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি,জনাব শামসুল হক সাধারন সম্পাদক এবং শেখ মুজিবকে করা হল জয়েন্ট সেক্রেটারি।খবরের কাগজে বঙ্গবন্ধু দেখলেন তার নামের পাশে লেখা আছে ”নিরাপওা বন্দি”। (পৃ-১২১)।
ভূক্তি-৫২৮ আমি মনে করেছিলাম,পাকিস্তান হয়ে গেছে তাই সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই।একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে,যার একটা ম্যানিফেষ্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনও আসে নাই,তাই যারা বাইরে আছেন তারা চিন্তা ভাবনা করেই করেছেন। (পৃ-১২১)।
ভূক্তি-৫২৯ জেলগেটে গিয়ে দেখি বিরাট জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য এসেছে মৌলানা ভাসানী সাহেবের নেতৃত্বে ।বাহাউদ্দিন আমাকে চুপি চুপি বলে, “মুজিব ভাই,পূর্বে মুক্তি পেলে একটা মালাও কেউ দিত না, আপনার সাথে মুক্তি পাচ্ছি,একটা মালা তো পাব।” আমি হেসে দিয়ে বললাম, “আর কেউ না দিলেতোমাকে আমি মালা পড়িয়ে দিতাম।”জেলগেট থেকে বের হয়ে দেখি,আমার আব্বাওউপস্থিত। তিনি আমাকে দেখবার জন্য বাড়ি থেকে এসেছেন ।আমি আব্বাকে ছালাম করে ভাসানী সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁকেওসালাম করলাম। সাথে সাথে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ,ছাএলীগ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি উঠল। জেল গেটে এই প্রথম “আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ”হল। শামসুল হক সাহেবকে কাছে পেয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানালাম এবং বললাম, “হক সাহেব,আপনার জয়, আজ জনগনের জয়”।হক সাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, “চল,এবার শুরু করা যাক”।পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ নামে পরিচিত হয়। (পৃ-১২১)।
ভূক্তি-৫৩০ আওয়ামী লীগের প্রথম ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয় ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে। শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক সাহেব তাতে যোগদান করেছিলেন। (পৃ-১২১)।
ভূক্তি-৫৩১ ঢাকার নামকরা ভীষণ প্রকৃতির লোক বড় বাদশা বাবুবাজারে (বাদামতলী ঘাট)থাকে। বড় বাদশার লোকবল ছিল, তার নামে দোহাই দিয়ে ফিরত এই সমস্ত এলাকায়। (পৃ-১২১)।
ভূক্তি-৫৩২ বাদশা মিয়া মাইকের কাছে গিয়ে বলল, “আমাকে মুসলীম লীগ নেতারা ভুল বুঝিয়েছিল আপনাদের বিরুদ্ধে।আপনাদের সভা ভাঙ্গতে আমাকে পাঁচশত টাকা দিয়েছিল। এটাকা এখনও আমার পকেটে আছে। আমার পক্ষে এ টাকা গ্রহন করা হারাম। আমি এ টাকা আপনাদের সামনে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছি”। (পৃ-১২২)।
ভূক্তি-৫৩৩ এ কথা বলে টাকাগুলি (পাঁচ টাকার নোট) ছুঁড়ে দিল।সভার মধ্যে টাকাগুলি উড়তে লাগল। অনেকে কুড়িয়ে নিল অনেকে ছিড়ে ফেলল।বাদশা মিয়া আরও বলল, “আজ থেকে আমি আওয়ামীলীগের সদস্য হলাম,দেখি আরমানি টোলার কে আপনাদের সভা ভাঙ্গতে পারে?জন সাধারন ফুলের মালা বাদশা মিয়ার গলায় পরিয়ে দিল। (পৃ-১২২)।
ভূক্তি-৫৩৪ আমি জেল থেকে বের হয়েছি,আব্বা আমার জন্য ঢাকায় এসেছেন,আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবেন। আমি আব্বাকে বললাম, “আপনি বাড়ি যান,আমি সাত-আট দিনের মধ্যে আসছি”। (বঙ্গবন্ধু) (পৃ-১২২)।
ভূক্তি-৫৩৫ আমার টাকার দরকার, বাড়ি না গেলে টাকা পাওয়া যাবে না।বৃদ্ধা মা,আর স্ত্রীও মেয়েটিকে দেখতে ইচ্ছা করছিল।(বঙ্গবন্ধু) (পৃ-১২৩)।
ভূক্তি-৫৩৬ গোপালগঞ্জে খবর দিয়ে আমি বাড়িতে রওয়ানা করলাম ।বোধহয় জুলাই মাসের মাঝামাঝি হবে, জন সভা ডাকা হয়েছিল। সালাম খান সাহেব উপস্থিত হলেন,আমিও বাড়ি থেকে আসলাম।সভায় হাজার হাজার জনসমাগম হয়েছিল।হঠাৎ সকালবেলা ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। (পৃ-১২৩)।
ভূক্তি-৫৩৭ সালাম সাহেব ও গোপালগঞ্জ মহকুমার নেতাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক হল আমি (বঙ্গবন্ধু) বক্তৃতা করে লোকদের চলে যেতে বলব। আমি বক্তৃতা করলাম বলার যা ছিল সবই এবং রাস্তা ছেড়ে দিতে অনুরোধ করলাম।মসজিদ থেকে সেই তিন মিনিটের রাস্তা মাএ।পুলিশ ও আমরা কয়েক ঘন্টা আটক আছি।জন সাধারন শেষ পর্যনÍ আমাদের সাথেই জিন্দাবাদ দিতে দিতে কোর্টে এল।রাত আট ঘটিকার সময় আমাদের জামিন দিয়েছেড়ে দেয়া হল।তার পর জনগন চলেগেল।এটা আমাদের আওয়ামীলীগের মফস্বলের প্রথম সভা এবংসে উপলক্ষে১৪৪ ধারা জারি। (পৃ-১২৩)।
ভূক্তি-৫৩৮ মধুমতির একদিকে ফরিদপুর অন্যদিকে যশোর ও খুলনা জেলা ।নদীটা এক জায়গায় খুব চওড়া।মাঝে মঝে সেই জায়গায় ডাকাতি হয়,আমাদের জানা ছিল।একটা ছিপ নৌকা আমাদের নৌকার কাছে এসে হাজির হল। চারজন লোক নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞাসা করল,আগুন আছে কিনা?আগুন চেয়েই এই ডাকাতরা নৌকার কাছে আসে,এই তাদের পন্থা। আমাদের নৌকার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, “নৌকা যাবে কোথায়?”মাঝি বলল,টুঙ্গিপাড়া,আমার গ্রামের নাম।নৌকায়কে?মাঝি আমার নাম বলল। ডাকাতরা মাঝিকে বৈঠা দিয়ে ভীষণ ভাবে একটা আঘাত করে বলল, “শালা আগে বলতে পার নাই শেখ সাহেব নৌকায়। এই কথা বলে নৌকা ছেড়ে দিয়ে তারা চলে গেল। (পৃ-১২৫)।
ভূক্তি-৫৩৯ আমি জেগে উঠে জিজ্ঞসা করলাম, ব্যাপার কি?কাজী সাহেব বললেন, “ডাকাতরা আপনাকে শ্রদ্ধা করে, আপনার নাম করেই বেঁচে গেলাম; না হলে উপায় ছিল না”।আমি বললাম, “বোধ হয় ডাকাতরা আমাকে ওদের দলের এক জন বলে ধরে নিয়েছে”। দুইজনে খুব হাসাহাসি করলাম। (পৃ-১২৫)।
ভূক্তি-৫৪০ আমি কয়েকদিন বাড়িতে ছিলাম। আব্বা খুবই দু:খ পেয়েছেন। আমি আইন পড়ব না শুনে বললেন, “যদি ঢাকায় না পড়তে চাও,তবে বিলাত যাও।সেখান থেকে বার এট ল ডিগ্রি নিয়ে এস। যদি দরকার হয় আমি জমি বিক্রি করে তোমাকে টাকা দিব”। আমি বললাম, “এখন বিলাত গিয়ে কি হবে,অর্থ উপার্জন করতে আমি পারব না”। আমার ভীষণ জেদ হয়েছে মুসলিম লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে।যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম। (পৃ-১২৫)।
ভূক্তি-৫৪১ এখন দেখি তার উল্টা হয়েছে। এর একটা পরিবর্তন করা দরকার। পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প কারখানা গড়া শুরু হয়েছে।পূর্বপাকিস্তানের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না।রাজধানী করাচী ।সব কিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে।পূর্ব বাংলায় কিছুই নাই।আব্বাকে সকল কিছুই বললাম। (পৃ-১২৬)।
ভূক্তি-৫৪২ আব্বা বললেন, “আমাদের জন্য কিছু করতে হবে না।তুমি বিবাহ করেছ; তোমার মেয়ে হয়েছে তাদের জন্য তো কিছু একটা করা দরকার। ”আমি আব্বাকে বললাম, “আপনি তো আমাদের জন্য জমিজমা যথেষ্ট করেছেন,যদি কিছু না করতে পারি, বাড়ি চলে আসব। তবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া চলতে পারে না। ”আমাকে আর কিছুই বললেন না । রেণু বলল,”এ ভাবে তোমার কত কাল চলবে।”আমি বুঝতে পারলাম,যখন আমি ওর কাছে এলাম। রেণুআড়াল থেকে সব কথা শুনেছিলাম। রেণু খুব কষ্ট করত ,কিন্তু কিছুই বলত না।নিজে কষ্ট করে আমার জন্যে টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়। আমি ঢাকায় রওনা হয়ে আসলাম। রেণুর শরীর খুব খারপ দেখে এসেছিলাম। ইত্তেহাদের কাজটা আমার ছিল।মাঝে মাঝে কিছু টাকা পেতাম,যদিও দৈনিক ইওেহাদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছিল। পূর্ব বাংলা সরকার সবই ব্যান্ড করে দিয়েছিল।এজেন্টরা টাকা দেয় না।পূর্ব বাংলায় কাগজ যদিও বেশি চলত। (পৃ-১২৬)।
ভূক্তি-৫৪৩ আমরা প্রতিষ্ঠানের কাজে আত্বনিয়োগ করলাম।মওলানা সাহেব, শামসুল হক সাহেব ও আমি ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমায় প্রথম সভা করতে যাই। (পৃ-১২৬)।
ভূক্তি-৫৪৪ রাতে এক বাড়িতে খেতে গেলেন মওলনা সাহেব। রাগ, খাবেন না।তিনি থাকতে কেন শামসুল হক সাহেবের নাম প্রস্তাব করা হল সভাপতিত্ব করার জন্য। এক মহাবিপদে পড়ে গেলাম।মওলানা সাহেবকে আমি বোঝাতে চেষ্টাকরলাম,লোকে কি বলবে?তিনি কি আর বুঝতে চান?তাঁকে নাকি অপমান করা হয়েছে! শামসুল হক সাহেবও রাগ হয়ে বলেছেন, মওলানা সাহেব সকলের সামনে একথা বলছেন কেন?এই দিন আমি বুঝতে পারলাম মওলানা ভাসানীর উদারতার অভাব,তবুও তাঁকে আমি শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। কারন, তিনি জনগনের জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত।যে কোন মহৎ কাজ করতে গেলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোন ভাল কাজ করতে পারে নাই এ বিশ^াস আমার ছিল। (পৃ-১২৮)।
ভূক্তি-৫৪৫ নির্যাতনের ভয় পেলে বেশি নির্যাতন ভোগ করতে হয়। (পৃ-১২৮)।
ভূক্তি-৫৪৬ জনাব শামসুল হক সাহেব একটু ব্যস্ত ছিলেন; কারন তাঁর বিবাহের দিন ঘনিয়ে এসেছে।আমাকেই পার্টির সমস্ত কাজ দেখতে হত।যদিও তাঁর সাথে পরামর্শ করেই করতাম।আমাদের মধ্যে এত মিল ছিল যে কোন ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনাই ছিল না। (পৃ-১২৯)।
ভূক্তি-৫৪৭ আমি বুঝতে পারতাম মওলানা সাহেব হক সাহেবকে অপছন্দ করতে শুরু করেছেন।সুযোগ পেলেই তাঁর বিরুদ্ধে বলতেন।আমি চেষ্টা করতাম যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয়। (পৃ-১২৯)।
ভূক্তি-৫৪৮ বেগম আনোযারা খাতুন এম এল এ প্রতিষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট কাজ করতেন ।দরকার হলে টাকা পয়সা দিয়েও সাহায্য করতেন। (পৃ-১২৯)।
ভূক্তি-৫৪৯ আতাউর রহমান সাহেবকে ডাকলেই পাওয়া যেত,লেখা পড়া জানতেন,কাজ করার আগ্রহ এবং আন্তরিকতা ছিল।জেলায় জেলায় সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সমর্থকরা আওয়ামীলীগে যোগদান করা শুরু করল। (পৃ-১২৯)।
ভূক্তি-৫৫০ এই সময় কলকাতায় ইওেহাদ কাগজ বন্ধ হওযার উপক্রম হয়েছে।সোহরাওয়ার্দী সাহেব কলকাতা ত্যাগ করে করাচি চলে গিয়েছেন।মানিক ভাই ঢাকা এসে পৌঁছেছেন প্রায় নি:স্ব অবস্থায়। তিনিও এসে মোগলটুলিতে উঠেছেন।সোহরাওয়ার্দী সাহেব সামান্য কিছু কাপড় ছাড়া আর কিছু নিয়ে আসতে পারেন নাই।ভারত সরকার তাঁর সর্বস্ব ক্রোক করে রেখেছে। অনেকে শুনে আশ্চর্য হবেন,শহীদ সাহেবের কলকাতায় নিজের বাড়ি ছিল না। ৪০ নম্বর থিয়েটার রোডের বাড়ি,ভাড়া করা বাড়ি।তিনি করাচিতে তাঁর ভাইয়ের কাছে উঠলেন,কারন তাঁর খাবার পয়সাও ছিল না। (পৃ-১২৯)।
ভূক্তি-৫৫১ ১৯৪৯ সালের ভিতরেই আমরা সমস্ত জেলায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলব ঠিক করেছি।ছুটি থাকলেই আমরা সমস্ত জেলায় বের হব। (পৃ-১৩০)।
ভূক্তি-৫৫২ নবাবজাদা লিয়াকত আলি খা মৌলানা সাহেবের টেলিগ্রামের উওর দেওয়ারও দরকার মনে করলেন না।আমরা জানতে পারলাম তিনি ১১ই অক্টোবর ঢাকায় আসবেন।তিনি প্রেস রিপোর্টারদের কাছে বললেন, “আওয়ামীলীগ কি তিনি জানেন না।”আমরা ১১ই অক্টোবর আরমানিটোলা ময়দানে সভা আহবান করলাম।একদল মুসলিম লীগ কর্মী আমাদের কর্মীদের মেরে মাইক্রো ফোনটা কেড়ে নিয়ে যায়। (পৃ-১৩০)।
ভূক্তি-৫৫৩ আমি ইব্রাহিম ও আলাউদ্দিনকে চিনতাম। বললাম, “আমাদের মাইক্রোফোনটা নিয়েছ কেন?এ তো বড় অন্যায় কথা!মাইক্রোফোনটা দিয়ে দাও”। আমাকে বলল, “আমরা নেই নাই; কে নিয়েছে জানি না।” (পৃ-১৩০)।
ভূক্তি-৫৫৪ ইয়ার মোহাম্মদ খান সাহেব ঢাকার পুরনো লোক।বংশমর্যাদা,অর্থ বল, লোকবল সকল কিছুই তাঁরআছে। তিনি বললেন, “কেন তোমরা মাইক্রোফোনটা কেড়ে নিয়েছ,এটা কি মগের মুল্লুক”। এর মধ্যে একজন বলে বসল, “নিয়েছি তো কি হয়েছে?”ইয়ার মোহাম্মদ হাত উঠিয়ে ওর মুখে বর চর মেরে দিলেন। হালিমও এক ঘুষি মেরে দিল। (পৃ-১৩১)।
ভূক্তি-৫৫৫ এই দিনের পর হতে আর কোন দিন এই এলাকায় কেউ আমাদের মারপিট করতে সাহস পায় নাই।ইয়ার মোহাম্মদ খানও এর পর থেকে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহন করতে শুরু করলেন।তাতে আমাদের শক্তি ঢাকা শহরে বেড়ে গেল।আমি মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে একদল যুবক সৃষ্টি করলাম। (পৃ-১৩১)।
ভূক্তি-৫৫৬ ১১ই অক্টোবর আরমানিটোলায় বিরাট সভা হল। সমস্ত ময়দান ও আশেপাসের রাস্তা লোকে ভরে গেল।আমি শেষ বক্তা।আমি বক্তৃতা করতে উঠে যা বলার বলে জনগনকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলাম, “যদি কোন লোককে কেউ হত্যা করে, তার বিচার হবে?” জনগন উওর দিল,“ফাঁসি হবে”। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, “যারা হাজার হাজার লোকের মৃত্যুর কারন,তাদের কি হবে?” জনগন উওর দিল, “তাদেরও ফাঁসি হওয়া উচিত।” আমি বললাম, “না,তাদের গুলি করে হত্যা করা উচিত”। কথাগুলি আজও আমার পরিস্কার মনে আছে।তারপর বক্তৃতা শেষ করে বললাম, “চলুন আমরা মিছিল করি এবং লিয়াকত আলী খান দেখুক পূর্বে বাংলার লোক কি চায়!” (পৃ-১৩২)।
ভূক্তি-৫৫৭ তখন মওলানা ভাসানী ইয়ার মোহাম্মদ খানের বাড়িতে থাকতেন।তাঁর সাথে আমার দেখা করা দরকার; কারন তাঁকে এখনও গ্রেফতার করা হয় নাই। তাঁকে জিঞ্জাসা করা দরকার কেন তিনি আমাকে গ্রেফতার হতে নিষেধ করেছেন? আমি পালিয়ে থাকার রাজনীতিতে বিশ^াস করি না ।কারন,আমি গোপন রাজনীতি পছন্দ করি না, আর বিশ^াসও করি না। (পৃ-১৩৪)।
ভূক্তি-৫৫৮ মওলানা সাহেব ও ইয়ার মেহাম্মদ আমাকে দেখে খুব খুশি হন।মওলানা সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি ব্যাপার,কেন পালিয়ে বেড়াব?” (পৃ-১৩৪)।
ভূক্তি-৫৫৯ নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান লীগ সভায় ঘোষনা করলেন, “যো আওয়ামী লীগ করেগা, উসকো শের হাম কুচাল দে গা”। তিনি যদিও বলতেন,গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, কিন্তু‘ কোনো বিরুদ্ধ দল সৃষ্টি হোক তা তিনি চাইতেন না।নিজের দলের কেউ বিরুদ্ধাচারন করলে তাকেও বিপদে ফেলতে চেষ্টা করেছেন,যেমন নবাব মামদোত। তিনি জনগনের প্রধানমন্ত্রী হতে চান নাই। একটা দলের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছেন।রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দল যে একক হতে পারে না, একথা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। (পৃ-১৩৪)।
ভূক্তি-৫৬০ যো আওয়ামী লীগ করেগা উসকো শের কুচাল দে গা -একথা একমাএ ডিকটেটর ছাড়া কোনো গনতন্ত্রে বিশ্বাসী লোক বলতে পারে না।জিন্নাহর মৃত্যুর পর সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছিলেন। (পৃ-১৩৫)।
ভূক্তি-৫৬১ মওলানা সাহেব আমাকে বললেন, তুমি লাহোর যাও, কারন সোরাওয়ার্দী সাহেব লাহোর আছেন। একটা নিখিল পাকিস্তান পার্টি হওয়া দরকার। সোহরাওয়াদীসাহেব ছাড়া আর কেউ এর নেতৃত্ব দিতে পারবেন না”। (পৃ-১৩৫)।
ভূক্তি-৫৬২ আমি ভাসানী সাহেবকে বললাম, কি ভাবে যাব? ভারতবর্ষ হয়ে যেতে হবে।আমি যে পাকিস্তানী,তার প্রমান লাগবে,তাহলেই পশ্চিম পাকিস্তানে ঢুকতে দেবে। তখনও পাসপোর্ট ভিসা চালু হয় নাই। গরম কাপড়ও বাড়িতে রয়েছে।টাকা পয়সাও হাতে নাই।ওদিকে আবার পূর্ব পাঞ্জাবে মুসলমান পেলেই হত্যা করে।কি করে লাহোর যাব বুঝতে পারছি না।আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলছে।খুঁজে বেড়াচ্ছে পুলিশ”। (পৃ-১৩৫)।
ভূক্তি-৫৬৩ ভাসানী সাহেব বললেন, “তা আমি কি জানি!যে ভাবে পার লাহোর যাও। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে দেখা কর এবং তাঁকে সকল কিছু বল”। আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম।আমার একটা গরম আচকান ছাড়া আর কিছুইছিল না।আমার মামা জাফর সাদেকের কাছ থেকে সামান্য কিছু টাকা ধার নিলাম।আর ‘ইওেফাকে’ আমার কিছু টাকা পাওনা ছিল:সেখান থেকে সামান্য কিছু পেলাম।তাই নিয়ে রওনা করলাম।লাহোর পর্যন্ত কোনোমতে পৌঁছাতে পারলে হয়। সোওরাওয়ার্দী সাহেব আছেন কোন অসুবিধা হবে না।আমি অনেক কষ্টে লাহোর পৌঁছালাম।পূর্ব বাংলার পুলিশকে আমার অনেক কষ্টে ফাঁকি দিতে হয়েছিল।আমার জন্য অনেক বাড়ি থানা তল্লাশি হচ্ছিল।বাড়িতেই পুলিশ নিয়ে খবর এনেছে আমি বাড়ি যাই নাই। (পৃ-১৩৫-১৩৬)।
ভূক্তি-৫৬৪ লাহোর তখন ভীষন শীত।আমার তা সহ্য করা কষ্ঠকর হচ্ছিল।কোনো দিন লাহোর যাই নাই। মিয়া ইফতিখার উদ্দিন সাহেব ছাড়া কেউ আমাকে চিনত না।সোওয়াওয়ার্দী সাহেব নবাব মামদোতের বাড়িতে থাকতেন,একথা আমি জানি।এক দোকানের সামনে মালপএ রেখে আমি নবাব সাহেবের বাড়িতে ফোন করলাম।সেখান থেকে উওর এলো,সোহরাওয়ার্দী সাহেব লাহোর নাই,বাইরে গেছেন,দুই দিন পরে ফিরবেন।আমার কাছে মাএ দুই টাকা আছে,কি করব?কোথায় যাব ভাবছিলাম,মালপএইবা কোথায় রাখি?বেলা তখন একটা,ক্ষিধেও লেগেছে,সকাল থেকে কিছুইপেটে পরে নাই।দুইটা টাকা মাএ,কিছু খেলেই তা শেষ হয়ে যাবে। অনেক চিন্তা করে মিয়া সাহেবের বাড়িতে ফোন করলাম। মিয়া সাহেব লাহোরে আছেন; কিন্তুু বাড়িতে নাই। (পৃ-১৩৬)।
ভূক্তি-৫৬৫ মিয়া সাহেব এসে কাগজটা দেখেই বের হয়ে এলেন,আমাকে চিনলেন এবং খুব আদর করলেন।আমার অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি একটা রুম ঠিক করে দিয়ে গোসল করে নিতে বললেন। একসাথে খানা খাবেন এবং পূর্ব বাংলার অবস্থা শুনবেন।মিয়া সাহেব,বেগম সাহেবা ও আমি একসাথে খানা খেয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সমন্ধে আলোচনা করলাম।পূর্ব বাংলার সকল খবর দিলাম। মওলানা ভাসানীর কথাও বললাম,সরকারের অত্যাচারের কাহিনীও জানালাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মুসলিম লীগের অবস্থা কি?” আমি বললাম, “নির্বাচন হলেই মুসলীম লীগকে আমরা পরাজিত করতে পারব এবং সে পরাজয় হবে শোচনীয়”। (পৃ-১৩৬)।
ভূক্তি-৫৬৬ রাতে আমার ভীষণ জ¦র হল। মিয়া সাহেব ব্যস্ত হয়ে ডাক্তার ডাকলেন। ঔষধ কিনে দিলেন; দুই দিনেই আমার জ¦র পড়ে গেল।মিয়া সাহেবের বাড়িতে এই একটাই অতিথিদের থাকার ঘর ছিল।সোওরাওয়ার্দী সাহেবের ভাই প্রফেসর শাহেদ সোহরাওয়ার্দী লাহোর আসবেন এবং মিয়া সাহেবের বাড়িতে থাকবেন। তাই দুই দিনের মধ্যেই আমার ছেড়ে যাওয়া উচিত হবে।আলাপ আলোচনার মধ্যে সেটা বুঝতে পারলাম।মিয়া সাহেব আমার জন্য অন্য বন্দোবস্ত করতে রাজী আছেন জানালেন। (পৃ-১৩৭)।
ভূক্তি-৫৬৭ সোহরাওয়ার্দী সাহেব ফিরে এসেছেন,ফোন করে জানলাম।আজ আর জ¦র নাই।ভীষন শীত,বেলা এগারটায় নবাব সাহেবের বাড়িতে পৌঁছালাম।শহীদ সাহেব লনে বসে কয়েকজন এডভোকেটের সাথে মামলা সমন্ধে আলোচনা করেছিলেন।আমি কাছে যেয়ে সালামকরতেই তিনি উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, “কিভাবে এসেছ?তোমার শরীরতো খুব খারাপ,কোথায় আছ?”আমাকে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।সকলকে বিদায় দিয়ে আমাকে নিয়ে বসলেন।আমিসকল ইতিহাস তাঁকে বললাম।প্রত্যেক কর্মী ও নেতাদের কথা জিজ্ঞেস করলেন।পূর্ব বাংলার অবস্থা কি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাও জিজ্ঞাসা করলেন।বাংলাকে তিনি কতটা ভালবাসতেন তাঁর সাথে না মিশলে কেউ বুঝতে পারতনা।শহীদ সাহেব বললেন,তাঁর আর্থিক অবস্থার কথা।মামলাটা না পেলে খুবই অসুবিধা হত। তিনি আমাকে যেতে দিলেন না মিয়া সাহেবের বাসায়।একসাথে খানা খেলাম,নবাব মামদোত উপস্থিত ছিলেন। (পৃ-১৩৭)।
ভূক্তি-৫৬৮ আমি রাতেই মিয়া সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে চলে এলাম। মিয়া সাহেব বললেন, জায়গা থাকলে তোমাকে হোটেলে যেতে দিতাম না। আমি বললাম, অসুবিধা হবে না। (পৃ-১৩৭)।
ভূক্তি-৫৬৯ শহীদ সাহেব আমাকে নিয়ে দোকানে গেলেন এবং বললেন, “কিছু কাপড় আমার বানাতে হবে,কারন দুইটা মাএ স্যুট আছে,এতে চলে না।তিনি নিজের কাপড় বানানোর হুকুম দিয়ে একটা ভাল কম্বল, একটা গরম সোয়েটার,কিছু মোজা ও মাফলার কিনে নিলেন এবং বললেন, কোনো কাপড় লাগবে কিনা! আমি জানি শহীদ সাহেবের অবস্থা। (পৃ-১৩৭)।
ভূক্তি-৫৭০ বললাম না আমার কিছু লাগবে না। তিনি আমাকে যখন গাড়িতে নিয়ে হোটেলে পৌঁছাতে আসলেন, জিনিস গুলি দিয়ে বললেন, “এগুলি তোমার জন্য কিনেছি।”আরোও কিছু দরকার হলে আমাকে বলো।”গরম ফুলহাতার সোয়েটার ও কম্বলটা পেয়ে আমার জানটা বাঁচল।কারন,শীতে আমার অবস্থা কাহিল হতে চলেছিল। (পৃ-১৩৮)।
ভূক্তি-৫৭১ সকালেই শহীদ সাহেবের কাছে যেতাম আর রাতে ফিরে আসতাম।তাঁর সাথেই কোর্টে যেতাম।নবাব সাহেবের ভাইদের সাথেও আমার বন্ধুত্ব হয়ে উঠেছিল। (পৃ-১৩৮)।
ভূক্তি-৫৭২ শহীদ সাহেব আমাকে কিছু টাকা দিলেন।আমরা দুইজন একসাথে লুন্দখোর সাহেবের মোটর গাড়িতে চড়ে ক্যামে¦লপুর রওয়ানা হলাম রাত দশটায়। তিনি গাড়ি চালিয়ে রাওয়ালপিন্ডি পৌঁছালেন ভোর রাতের দিকে।সকালে নাস্তা করে আবার রওয়ানা করলাম ক্যাম্বেলপুরের দিকে।এগার-বারটার মধ্যে সেখানে পৌছালাম। এই আমার জীবনের প্রথম পাঞ্জাব প্রদেশের ভিতরে বেড়ান। আমার ভালই লাগলো পঞ্চনদীর এই দেশটাকে। (পৃ-১৩৮)।
ভূক্তি-৫৭৩ পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিম পাঞ্জাবের ভয়াবহ দাঙ্গার স্মৃতি আজও মানুষ ভোলে নাই। লক্ষ লক্ষ মোহাজের এসেছে পশ্চিম পাঞ্জাবে, তবে বেশি অসুবিধা হয় নাই।কারন পশ্চিম পাঞ্জাব থেকেও লক্ষ লক্ষ হিন্দু ও শিখ চলে গিয়েছে।মুসলমানরা তা দখল করে নিয়েছে। ক্যাম্বলপুরে যাওয়ার পূর্বে আমি একটা বিবৃতি দিয়েছিলাম,পূর্ব বাংলায় কি হচ্ছে তার উপরে।আমি বিবৃতি লিখে শহীদ সাহেবকে দেখিয়েছিলাম। তিনি দেখে দিয়েছিলেন। (পৃ-১৩৮)।
ভূক্তি-৫৭৪ আমরা ক্যাম্বেলপুর পৌঁছালাম।ডাক বাংলো পীর সাহেবের জন্য রিজার্ভ ছিল।কিছু সময়ের মধ্যে পেশোয়ার,মর্দান ও অন্যান্য জায়গা থেকে সীমান্ত আওয়ামীলীগের কর্মকর্তা ও সদস্যরা এসে পৌঁছালেন। (পৃ-১৩৯)।
ভূক্তি-৫৭৫ আমি পূর্ব বাংলার মানুষ; একটা গরম চাদর গায়ে দিয়েই শীতকাল কাটিয়ে দিতে পারি।এখানে তো গরম কাপড়ের ওপর গরম কাপড়,কম্বলের ওপর কম্বল তারপর ঘরের মধ্যে আগুন জ¦ালিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে হয়; তবুও ঘুম হবে কি না বলা কষ্টকর! পীর সাহেব পূর্ব বাংলার অবস্থা শুনে খুবই দুঃখিত হলেন এবং আমাকে সীমান্ত প্রদেশে কাইয়ুম খান কি কি অত্যাচার করছে তাও বললেন। (পৃ-১৩৯)।
ভূক্তি-৫৭৬ পরের দিন সকালে আমরা রওয়ানা করলাম।আমি অনুরোধ করলাম,এত কাছে এসে আটক ব্রিজ ও আটক ফোর্ট না দেখে যাই কি করে! মাএ কয়েক মাইল। লুন্দখোর সাহেব রাজি হলেন,আমাকে আটক ব্রিজেনিয়ে গেলেন।আমি ব্রিজ পার হয়ে সীমান্ত প্রদেশে ঢুকলাম।লুন্দখোর সাহেব একজন লোক সাথে দিয়েছিলেন।ছোট ছোট কয়েকটা ফলের দোকান। ফল কিনে নিয়ে ফিরলাম। আটক ফোর্টের ভিতরে যাওয়ার অনুমতি লাগে; কারন কিছু যুদ্ধবন্দি সেখানে আছে।কয়েকজন শিখকে কাজ করতে দেখলাম দূর থেকে। (পৃ-১৩৯)।
ভূক্তি-৫৭৭ লুন্দখোর সাহেবকে অনেক লোকে জানে দেখলাম।তিনি মাঝে মাঝে গাড়ি রেখে হুক্কা খান।যেখানেই তিনি গাড়ি নামান কোন হোটেল বা রেস্টুরেন্ট ঢুকলে প্রথমেই হুক্কা এনে সামনে দেন খান সাহেবের।এরা প্রায় সকলেই সীমান্ত প্রদেশের লোক বলে মনে হল।আমরা ঝিলাম,গুজরাট ও গুজরানওয়ালায় থেকে চা খেয়েছি। রাত প্রায় দশটায় লাহোরে পৌঁছালাম। আমাকে হোটেলে দিয়ে তিনি চলে গেলেন এবং বললেন,আগামী কাল সকালে আমাকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কাছে যাবেন এবং কি সিদ্ধান্ত হয়েছে রিপোর্ট দিবেন। (পৃ-১৪০)।
ভূক্তি-৫৭৮ শহীদ সাহেব একটা জনসভায় যোগদান করবেন বলে মত দিয়েছেন।আমরা মোটরে গিয়েছিলাম।সারগোদা জেলায় এই সভা হবে।আমাকে বললেন সাথে যেতে।আমার কাজ কি!রাজি হলাম।সারগোদায় অনেক মোহাজের এসেছে,তাদের দুরবস্থার সীমা নাই।শহীদ সাহেব বক্তৃতা করলেন।আমাকে বক্তৃতা করতে অনেক অনুরোধ করলেন, আমি বললাম, “স্যার, না জানি উর্দু, না জানি পাঞ্জাবি; ইংরেজিতে কেউ বুঝবে না, কি বক্তৃতা করব! “তিনি বললেন,থাক,প্রয়োজন নাই।আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল।আমি সালাম জানিয়ে বসে পড়লাম।সুদুর সারগোদা জেলায়ও শহীদ সাহেব জনপ্রিয় ছিলেন এই বার প্রথম বুঝলাম। (পৃ-১৪০)।
ভূক্তি-৫৭৯ লাহোরে যে হোটেলে আমি থাকতাম তার দুইটা রুম ভাড়া নিয়ে মিস্টার আজিজ বেগ ও মিস্টার খুরশিদ(যিনি আজাদ কাশ্মীরের প্রেসিডেন্ট ছিলেন)সাপ্তাহিক “গার্ডিয়ান” কাগজ বের করতেন। এরা “পাকিস্তান টাইমসে” আমার বিবৃতি দেখেছিলেন এবং বিবৃতির কিছু “গার্ডিয়ান” কাগজে প্রকাশ করেছিলেন। আমি তাঁদের সাথে দেখা করলাম এবং সকল বিষয়ে আলোচনা করলাম। “গার্ডিয়ান” প্রতিনিধি আমার সাথে দেখা করে একটা সাক্ষাতের রিপোর্ট বের করলেন।আস্তে আস্তে লাহোরের রাজনীতিবিদরাও জানতে পারলেন আমি লাহোরে আছি।গোয়েন্দা বিভাগ যে আমার পিছু লেগেছে সে খবরও হোটেলের ম্যানেজার আমাকে বলে দিলেন এবংআরো বললেন,সকল সময়ের জন্য একটা লোক আপনাকে অনুসরন করছে।আমি তো টাঙ্গায় বা হেঁটে চলতাম,ওরা আমাকে সাইকেলে অনুসরন করত। (পৃ-১৪০)।
ভূক্তি-৫৮০ এ সময় একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেল।আমি একদিন মিয়া সাহেবের সাথে দেখা করতে “পাকিস্তান টাইমসের” অফিসে যাই।তখন প্রায় সকাল এগারটা।মিয়া সাহেব সেখানে নাই।আমি কিছু সময় দেরি করলাম।মিয়া সাহেব আসলেন না।আমার কাজ ছিল শহীদ সাহেবের সাথে।হাইকোর্টে যাব তাঁর সাথে দেখা করতে।যখন আমি বের হয়ে কিছদূর এসেছি,তিন চার জন লোক আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল,আমার গাড়ি কোথায়?আমি বললাম, “পূর্ব পাকিস্তানে”।হঠাৎ একজন আমার হাত আর একজন আমার জামা ধরে বলল, “তোম পাকিস্তান কা দুশমন হ্যায়”।আরেকজন একটা হান্টার,অন্যজন একটা ছোরা বের করল। আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, “আপনারা আমাকে জানেন আমি কে? তারা বলল, “হ্যাঁ,জানতা হ্যায়”। আমি বললাম, “কথা শোনেন,কি হয়েছে বলুন,আর যদি লড়তে হয় তবে একজন করে আসুন”। একজন আমাকে ঘুষিমারল,আমি হাত দিয়ে ঘুষিটা ফিরালাম।অনেক লোক জমা হয়ে আছে।কয়েকজন ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে? আমি বললাম, “কিছুই তো জানি না।এদের কাউকেও চিনিত না।আমি পূর্ব বাংলা থেকে এসেছি।পাকিস্তান টাইমস অফিসে এসেছিলাম মিয়া সাহেবের সাথে দেখা করতে ।এরা কেন আমাকে মারতে চায়, বুঝতে পারলম না”। তারা ওদের কি যেন বলল,ওরা সরে পড়ল।আমি একটা টাঙ্গা নিয়ে হাইকোর্টে আসলাম সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কাছে।কিছুই খেলাম না,ভীষন রাগ হয়েছে।বিকালে তাাঁর সাথে নবাব সাহেবের বাড়িতে যেয়ে সকল ঘটনা বললাম।শহীদ সাহেব নবাব সাহেবকে জানালেন।সন্ধ্যার পূর্বেই হোঠেলে চলে এলাম। বোঝা গেল মুসলিম লীগ ওয়ালাদের কাজ।এখানেও গুন্ডা লেলিয়ে দিয়েছে। লুন্দখোর আমাকে বলল, “সাবধানে থেকো”। আমি এই ঘটনা আর কাউকে বললাম না।নবাব সাহেবকে পাঞ্জাবের বড় বড় সরকারি কর্মচারীরা সম্মান করত।আমার উপর আক্রমনের কথাটা সেখানেও পৌঁছে ছিল। (পৃ-১৪১)।
ভূক্তি-৫৮১ এসময় পাঞ্জাবে প্রগতিশীল লেখকদের একটা কনফারেন্স হয়।মিয়া সাহেব আমাকে যোগদান করতে অনুরোধ করলেন।আমি যোগদান করলাম।লেখক আমি নই, একজন অতিথী হিসেবে যোগদান করলাম।কনফারেন্স দুই দিন চলল।লুন্দখোর সাহেবও যোগদান করেছিলেন।কে বা কারা লুন্দখোর সাহেবের গাড়িটায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল।ইংরেজরা ১৯৪২ সালের আন্দোলনে তাঁর বাড়িটা পুড়িয়ে দিয়েছিল।কারন,তখন তিনি সীমান্ত কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। লুন্দখোর আমাকে বললেন, “লাহোরে এ সকল ঘটনা ঘটে থাকে,তবে আমি পাঠান,আমাকে এরা ভয় করে। সামনে কিছুই বলতে বা করতে সাহস পাবে না,তাই পিছন থেকে আঘাত করার চেষ্টা করছে”। (পৃ-১৪২)।
ভূক্তি-৫৮২ প্রায় এক মাস হয়ে গেল, আর কতদিন আমি এখানে থাকব?ঢাকায় মওলানা সাহেব,শামসুল হক সাহেব এবং সহকর্মীরা জেলে আছেন।সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে বললাম। তিনি বললেন, “ঢাকায় পৌছার সাথে সাথেই তারা তোমাকে গ্রেফতার করবে।লাহোরে গ্রেফতার নাও করতে পারে।” (পৃ-১৪২)।
ভূক্তি-৫৮৩ আমি বললাম, “এখান থেকে গ্রেফতার করেও আমাকে ঢাকায় পাঠাতে পারে। কারন লিয়াকত আলী সাহেবও ক্ষেপে আছেন।পূর্ব বাংলার সরকার নিশ্চয়ই চুপ করে বসে নাই। তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে খবর পাঠিয়েছে পাঞ্জাব সরকারকে হুকুম দিতে।সে খবর এসে পৌছাতেও পারে।এখানেও আমি তো চুপ করে নাই।তাই যা হবার পূর্ব বাংলায় হোক,পূর্ব বাংলার জেলে ভাত পাওয়া যাবে। পাঞ্জাবের রুটি খেলে আমি বাঁচতে পারব না। রুটি আর মাংস খেতে আমার আর সহ্য হচ্ছে না।আর জেলে যদি যেতেই হবে,তাহলে আমার সহকর্মীদের সাথেই থাকব”। (পৃ-১৪২)।
ভূক্তি-৫৮৪ শহীদ সাহেব বললেন,তবে যাবার বন্দোবস্ত কর।কি করে কোন পথে যাবা, তিনি জিঞ্জেস করলেন। আমি বললাম, “রাস্তা তো একটাই,পূর্ব পাঞ্জাব দিয়ে আমি যাব না।প্লেনে লাহোর থেকে দিল্লি যাব ,সেখান থেকে ট্রেনে যাব।ভারত বর্ষ হয়ে যেতে হলে একটা পারমিট লাগবে।ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার পারমিট দেওয়ার মালিক। লাহেরে তাদের অফিস আছে। আমি আরও বললাম, “মিয়া সাহেবকে বলেছি,তিনি ডেপুটি হইকমিশনারকে বলে দেবেন। কারন,তাঁকে তিনি জানেন”। শহীদ সাহেব আমাকে প্রস্তুত হতে বললেন।এই সময় পূর্ব বাংলার সি এস এস পরীক্ষায় উওীর্ন কয়েকজন বন্ধু লাহোরের সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে ছিলেন।তাঁদের সাথে দেখা করতে গেলাম।অনেকের সাথে দেখা হল। (পৃ-১৪২)।
ভূক্তি-৫৮৫ একজন সরকারি দলের ছাএনেতা ছিলেন,তিনি বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন।আমার সাথে তাঁর পরিচয় ছিল। আমাকে বললেন, “আপনি আমার কাছে চা খাবেন।কারন,আমি বূঝতে পেরেছি লাহোর এসে,যে বাংলা ভাষার ঢাবি আপনারা করেছিলেন তা ঠিক ছিল,আমিই ভুল করেছিলাম।বাঙালীদের এরা অনেকেই ঘৃনা করে”। আমি কোন আলোচনা করলাম না সেখানে বসে, কারন সেটা উচিত না।এরা এখন সকলেই সরকারি কর্মচারী,কেউ কিছু মনে করতে পারেন। (পৃ-১৪২-১৪৩)।
ভূক্তি-৫৮৬ আমি পারমিট পেলাম,দেরি হলনা,কারন মিয়া সাহেব বলেদিয়েছেন।পারমিটে ছিল,তিন দিনের মধ্যে ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে হবে।তিন দিনের বেশি ভারতবর্ষে থাকতে পারব না।আমি হিসাব করে দেখলাম তিন দিনের মধ্যেই পূর্ব বাংলায় ঢুকতে পারব।শহীদ সাহেব আমার হোটেলের টাকা শোধ করে দিলেন, দিল্লি পর্যন্ত প্লেনের টিকিট কিনে দিলেন।আর সামান্যকিছু টাকা দিলেন,যাতে বাড়িতে পৌছাতে পারি। পাকিস্তানের টাকা বেশি নেওয়ার হুকুম নাই।শহীদ সাহেব নবাবজাদা জুলফিকারকে (নবাব সাহেবের ছোট ভাই)বললেন, আমাকে প্লেনে তুলে দিতে।কারন একটা খবর পেয়েছিলেন আমাকে গ্রেফতার করতে পারে এয়ারপোর্টে। (পৃ-১৪৩)।
ভূক্তি-৫৮৭ মালপত্র ভালভাবে তল্লাশী করলেন এবং বললেন, “আপনি এখানে বসুন; কোথাও যাবেন না”। নবাবজাদা জুলফিকার সাহেব আমার কাছে আসলেন এবং বললেন, “মনে হয় কিছু একটা করবে।প্লেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে কিন্তু প্লেন ছাড়ছে না”। নবাবজাদা খবর আনলেন এবং বললেন আপনার ব্যাপার নিয়েই প্লেন দেরি হচ্ছে।এক ঘন্টা পর প্লেন ছাড়ার অনুমতি পেল এবং আমাকে বলল, “আপনি যেতে পারেন”। আমি নবাবজাদার কাছথেকে বিদায় নিয়ে প্লেনে উঠলাম এবং তাঁকেÍ অনুরোধ করলাম,শহীদ সাহেকে ঘটনাটা বলতে। (পৃ-১৪৩)।
ভূক্তি-৫৮৮ আমি যে ভারতবর্ষে থাকতে পারব না একথা পারমিটে লেখাআছে।কলকাতার সরকারি কর্মচারীর খবর পেলে আমাকে কলকাতার জেলের ভাতও খাওয়াতে দ্বিধাবোধ করবে না,কারন আমি শহীদ সাহেবের দলের মানুষ। (পৃ-১৪৩)।
ভূক্তি-৫৮৯ সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে ছেড়ে আসতে আমার খুব কষ্টই হচ্ছিল,কারন জীবনের বহুদিন তাঁর সাথে সাথে ঘুরেছি।তাঁর ¯েœহ পেয়েছি এবং তাঁর নেতৃত্বে কাজ করেছি।বাংলাদেশে শহীদ সাহেবের নাম শুনলে লোকে শ্রদ্ধা করত,তাঁর নেতৃত্বে বাংলার লোক পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। যাঁর একটা ইঙ্গিতে হাজার হাজার লোক জীবন দিতে দ্বিধাবোধ করত না,আজ তাঁর কিছুই নাই। মামলা না করলে তাঁর খাওয়ার পয়সা জুটছে না। কত অসহায় তিনি! তাঁর সহকর্মীরা-যারা তাঁকে নিয়ে গর্ববোধ করত,তারা আজ তাঁকে শক্র ভাবছে।কতদিনে আবার দেখা হয় কি করে বলব?তবে একটা ভরসা নিয়ে চলেছি,নেতার নেতৃত্ব আবার পাব।তিনি নীরবে অত্যাচার সহ্যকরবেন না, নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করবেন।পূর্ব বাংলায় আমরা রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করতে পারব এবং মুসলিমলীগের স্থান পূর্ব বাংলায় থাকবে না, যদি একবার তিনি আমাদের সাহায্য করেন।তাঁর সাংগঠনিক শক্তি ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব জাতি আবার পাবে। (পৃ-১৪৩-১৪৪)।
ভূক্তি-৫৯০ দিল্লি পৌঁছালাম এবং সোজা রেলষ্টেশনে হাজির হয়ে দ্বিতীয় শ্রেনীর ওয়েটিংরুমে মালপএ রাখলাম।গোসলকরে কিছু খেয়ে মালপএ দারোয়ানের কাছে বুঝিয়েদিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।টিকিট কিনে নিয়েছি।রাতে ট্রেন ছাড়বে। অনেক সময় হাতে আছে।আমি একটা টাঙ্গা ভাড়া করে জামে মসজিদের কাছে পৌঁছালাম।গোপনে গোপনে দেখতে চাই মুসলমানদের অবস্থা।পার্টিশনের সময় এক ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল এইদিল্লিতে।দেখলাম,মুসলমানদের কিছু কিছু দোকান আছে। কারও সাথে আলাপ করতে সাহস হচ্ছিল না।হাঁটতে হাঁটতে লালকেল্লায় গেলাম।পূর্বও গিয়েছি,হিন্দুস্তানের পতাকা উড়ছে।ভিতরে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।মুসলমানদের অনেক দোকান ছিল পূর্বে,এখন দুএকটা ছাড়া নাই।বেশি সময় থাকতে ইচ্ছা হল না।বেরিয়ে আসলাম,আর একটা টাঙ্গা নিয়ে চললাম এ্যালো এ্যারাবিয়ান কলেজের দিকে,যেখানে১৯৪৬ সালে মুসলিমলীগ কনভেনশনে যোগদান করেছিলাম। (পৃ-১৪৪)।
ভূক্তি-৫৯১ নতুন দিল্লিও ঘুরে দেখলাম।নতুন দিল্লি এখন আরও নতুন রুপ ধারন করেছে।ভারত বর্ষের রাজধানী।শত শত বৎসর মুসলমানরা শাসন করেছে এই দিল্লি থেকে,আজ আর তারা কেউই নাই।শুধু ইতিহাসের পাতায় স্বাক্ষর রয়ে গেছে।জানি না যে স্মৃতিটুকু আজও আছে,কতদিন থাকবে!যে উগ্র হিন্দু গোষ্ঠী মহাত্মা গান্ধীর মত নেতাকে হত্যা করতে পারে, তারা অন্য সম্প্রদায়কে সহ্য করতে পারবে কি না?এই দিল্লিতেই মহাত্বা গান্ধী, পন্ডিত নেহেরু ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। খোদা শহীদ সাহেবকে রক্ষা করেছিলেন।নাথুরাম গডসের সহকর্মী মহাত্বা গান্ধী হত্যা মামলার সাক্ষী হিসাবে জবানবন্দিতে এই কথা স্বীকার করেছিল। (পৃ-১৪৪)।
ভূক্তি-৫৯২ আমি রাতের ট্রেনে চড়ে বসলাম।আমার সিট রিজার্ভ ছিল।দ্বিতীয় শ্রেনীতে আরও তিনজন ভদ্রলোক ছিলেন।কারও সাথে আলাপ করতে সাহস হল না।একটা কাগজ নিয়ে পড়তে লাগলাম।তখনও ভারতবর্ষে মাঝে মাঝে গোলমাল চলছিল।তবে মহাত্বাকে হত্যা করার পর কংগ্রেস সরকার বাধ্য হয়েছিল সাম্প্রদায়িক আর এস এস ও হিন্দু মহাসভার কর্মীদের উপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করতে।মহাত্বা গান্ধী যে মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য জীবন দিলেন তার জন্য তাঁর ভক্তদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল।তারা মুসলমানদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। (পৃ-১৪৪)।
ভূক্তি-৫৯৩ ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখি দুইজন প্যাসেঞ্জারনেমে গেছেন,একজন আছেন। তিনি পশ্চিম বাংলার লোক। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,আমি কোথা থেকে এসেছি?কোথায় যাব? আমি সত্য কথাই বললাম।লাহোর থেকে এসেছি,পূর্ব বাংলায় যাব।আমার বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। ভদ্রলোক বললেন, “আমার বাড়িও বরিশাল জেলায় ছিল। এখন চাকরি করি দিল্লিতে”। অনেক আলাপ হল,পূর্ব বাংলার মাছ ও তরকারি,পূর্ব বাংলার আলো-বাতাস।আর জীবনে যেতে পারবেন না বলে আফসোস করলেন,কেউই নাই তাঁর এখন বরিশালে।ভদ্রলোক আমাকে হাওড়ায় নেমে যেতে বললেন, “আপনি আমার বাড়িতে রাতে থাকতে পারেন,কোনো অসুবিধা হবে না”।আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, “কাল সকালে চলে যেতে হবে,সেজন্য রাতটা এক বন্ধুর বাড়িতে থাকব”। (পৃ-১৪৫)।
ভূক্তি-৫৯৪ নুরুল আলমের বাড়ি পার্ক সার্কাসে আসলাম।কিছু সময়ের মধ্যে নুরুল আলম এলো।আমাকে পেয়ে কত খুশি।একসাথে খেলাম তারপর বেড়ালম।নুরুল আলম বলল যে,সে পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনার অফিসে একটা চাকরির জন্য দরখাস্ত করেছে। (পৃ-১৪৫)।
ভূক্তি-৫৯৫ টেলিফোন করে জানলাম সকাল এগারটায় খুলনার ট্রেন ছাড়ে। ইন্টার ক্লাস টিকিট কাটলাম।কারন বেনাপোলে আমাকে পুলিশের চোখে ধুলা দিতে চেষ্টা করতে হবে।গোয়েন্দা বিভাগ ব্যস্ত আছে,আমাকে গ্রেফতার করার জন্য।আমিও প্রস্তুত আছি,তবে ধরা পড়ার পূর্বে একবার মা-বাবা,ভাইবোন,ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা করতে চাই। লাহোর থেকে রেণুকে চিঠি দিয়েছিলাম,বোধ হয় পেয়ে থাকবে।বাড়ির সকলেই আমার জন্য ব্যস্ত।ঢাকায়ও যাওয়া দরকার,সহকর্মীদের সাথে আলাপ করতে হবে।টাকা পয়সার খুবই অভাব আমাদের। আমি কিছু টাকা তুলতে পারব বলে মনে হয়।সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কয়েকজন ভক্ত আছে,যাদের আমি জানি,গেলে একেবারে ’না’ বলতে পারবে না।রানাঘাট এসে গাড়ি থামল অনেকক্ষ।সন্ধ্যা হয় হয় ,ঠিক এই সময় ট্রেন বেনাপোলে এসে পৌঁছাল। (পৃ-১৪৫-১৪৬)।
ভূক্তি-৫৯৬ ট্রেন থামবার পূর্বেই আমি নেমে পড়লাম।একজন যাএীর সাথে পরিচয় হল।তাকে বললাম,আমার মালগুলি পাকিস্তানের কাষ্টমস আসলে দেখিয়ে দিবেন,আমার একটু কাজ আছে।আসতে দেরিও হতে পারে।অন্ধকার থেকে একটা গাছের নিচে আশ্রয় নিলাম।এখানে ট্রেন অনেক ক্ষন দেরি করল।গোয়েন্দা বিভাগের লোক ও কিছু পুলিশ কর্মচারী খোরাফেরা করছে,ট্রেন দেখছে তন্ন তন্ন করে। আমি একদিক থেকে অন্যদিক করতে লাগলাম।একবার ওদের অবস্থা দেখে ট্রেনের অন্যপাশে গিয়ে আত্বগোপন করলাম।ফাঁকি আমাকে দিতেই হবে।মন চলে গেছে বাড়িতে।কয়েকমাস পূর্বে আমার বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে,ভাল করে দেখতেও পারি নাই ওকে।হাচিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না।অনুভব করতে লাগলাম যে,আমি ছেলে মেয়ের পিতা হয়েছি।আমার আব্বাও মাকে দেখতে মন চাইছে।তাঁরা জানেন,লাহোর থেকে ফিরে নিশ্চয়ই একবার বাড়িতে আসব। রেণু তো নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে।সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে,কিন্তু কিছু বলে না।কিছুবলে না বা বলতে চায়না,সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে। (পৃ-১৪৬)।
ভূক্তি-৫৯৭ মওলানা সাহেব,শামসুল হক সাহেব ও সহকর্মীরা জেল অত্যাচার সহ্য করছেন।তাঁদের জন্যও মনটা খারাপ।কিছু করতে না পারলেও তাঁদের কাছেযেতে পারলে কিছুটা শান্তি তো পাব।ট্রেন ছেড়ে দিল,আস্তে আস্ত ট্রেন চলছে, আমি এক দৌড় দিয়ে এসে ট্রেনে উঠেপড়লাম।আর এক মিনিট দেরি হলে উঠতে পারতাম কি না সন্দেহ ছিল।ট্রেন চলল,যশোরেও হুঁশিয়ার থাকতে হবে।রেলস্টেশনে যে গোয়েন্দা বিভাগের লোক থাকে, আমার জানা আছে। যশোরে ট্রেন থামবার কয়েক মিনিট পূর্বেইআমি পায়খানায় চলেগেলাম।আর ট্রেন ছাড়লে বের হয়ে আসলাম।একজন ছাএ আমার কামরায় উঠে বসেআছে।আমি পায়খানা থেকে বের হয়ে আসতেই আমাকে বলল, “আরে, মুজিব ভাই”। আমি ওকে কাছে আসতে বললম এবং আস্তে আস্তে বললাম, “আমার নাম ধরে ডাকবা না”। সে ছাএলীগের সভ্য ছিল,বুঝতে পেরে চুপ করে গেল।অনেক যাএী ছিল,বোধহয় কেউ বুঝতে পারে নাই।আর আমাকে তখন বেশি লোক জানত না।ছাএটি পথে নেমে গেল। (পৃ-১৪৬)।
ভূক্তি-৫৯৮ খুলনার অবস্থা আমার জানা আছে।ছোটবেলা থেকে খুলনা হয়ে আমাকে যাতায়াত করতে হয়েছে।কলকাতায় পড়তাম,খুলনা হয়ে যেতে আসতে হত।রাত দশটা বা এগারটায় হবে এমন সময় খুলনায় ট্রেন পৌঁছাল।সকল যাএী নেমে যাওয়ার পরে আমার পাঞ্জাবি খুলে বিছানার মধ্যে দিয়ে দিলাম।লুঙ্গি পরা ছিল,লুঙ্গিটা একটু উপরে উঠিয়ে বেঁধে নিলাম। বিছানাটা ঘাড়ে,আর সুটকেসটা হাতে নিয়েনেমে পড়লাম।কুলিদের মত ছুটতে লাগলাম,জাহাজ ঘাটের দিকে।গোয়েন্দা বিভাগের লোক তো আছেই।চিনতে পারল না।আমি রেলরাস্তা পার হয়ে জাহাজ ঘাটে ঢুকে পড়লাম।আবার অন্য পথ দিয়ে রাস্তায় চলে এসে একটা রিকশায় মালপএ রাখলাম।পাঞ্জাবিটা বের করে গায়ে দিলাম।রিকশাওয়ালা গোপালগঞ্জের লোক,আমাকে চিনতে পেরে বলল, “ভাইজান না,কোথা থেকে এইভাবে আসলেন। আমি বললাম, “সে অনেক কথা, পরে বলব। রিকশা ছেড়ে দাও”। ওকে কিছুটা বলব, না বলে উপায় নাই।গোপালগঞ্জের লোক, কাউকেও বলবে না,নিষেধ করে দিলে। (পৃ-১৪৬-১৬৩)।
ভূক্তি-৫৯৯ মামাকে জাহাজ ঘাটে পাঠিয়ে তার নামে প্রথম শ্রেনীতে দুইটা সিট রিজার্ভ করলাম যাতে অন্য কেউ আমার কামরায় না উঠে।আমার এক বন্ধু ছিল,জাহাজ কোম্পানীতে চাকরি করত,তাকে খবর দিলাম।সে বলল যে,জাহাজ ছাড়বার মাএ দুই মিনিট আগে যেন আমি জাহাজে উঠি।জাহাজে ওঠার সাথে সাথে সে জাহাজ ছেড়ে দেবার বন্দোবস্ত করবে।জাহাজ ঘাটেও গোয়েন্দাদের আমদানি আছে। দুঃখের বিষয় কুয়াশা পড়ায় জাহাজ আসতে অনেক দেরি হয়েছিল এবংছাড়তেও দেরি হবে,প্রায় এক ঘন্টা অর্থাৎ সকাল৭ টায়।মহাবিপদ! ছয়টায় তো একটু অন্ধকার থাকে সাতটায় সূর্য উঠে যায়। মামা পূর্বেই মালপএ নিয়ে উঠে কামরা ঠিক করে রেখেছে।আমি কাছেই একদোকানে চুপটি করে বসেছিলাম।খুলনার গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা আমাকে চিনে।মামার সাহায্যে আমি প্যান্ট, কোট ও মাথায় হ্যাট লাগিয়ে অন্য রুপ ধরেছি। যখন দুইটা সিঁড়ি টেনেছে আর দুইটা বাকি আছে,আমি এক দৌড় দিয়ে উঠে পড়লাম।দেখলাম আমার বন্ধু দাড়িয়ে আছে ঘাটে।উঠার সাথে সাথে ওই দুইটা সিঁড়িও টেনে নিল এবং জাহাজ ছেড়ে দিল।দুইজনের চোখে চোখে আলাপ হল, আমি আমার চক্ষু দিয়েই কৃতজ্ঞতা জানালাম। (পৃ-১৬৩)।
ভূক্তি-৬০০ এবার আশা হল, বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব।আমি কামরাতেই শুয়ে রইলাম।খাবার জিনিস কামরায় আনিয়ে নিলাম।আমি যে জাহাজে উঠেছি অনেকে দেখে ফেলেছে।এই জাহাজই গোপালগঞ্জ হয়ে বরিশাল ও নারায়নগঞ্জে যায়। গোপালগঞ্জের অনেক লোক ছিল।মানিকদহ ঘাটে যখন জাহাজ ভিড়েছে,তখন আমি জানালা দিয়ে চুপটি করে দেখেছিলাম।ঘাট থেকে রহমত জান ও ইউনুস নামে দুইজন ছাএ,যারা খুব ভাল কর্মী আমার চোখ দেখেই চিনতে পেরে চিৎকার করে উঠেছে।আমি ওদের ইশারা করলাম, কারন, খবর রটে গেলে আবার পুলিশ গ্রামের বাড়িতে যেয়ে হাজির হবে।রহমত জান ও ইউনুস বরিশাল কলেজে পড়ে। এই জাহাজেই বরিশাল যাবে। ওরা সোজা আমার কাছে চলে এল।জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে।আমি ওদের বললাম, “তোমরা চিনলা কেমন করে?” ওরা বলে, “ও চোখ আমাদের বহু পরিচিত”। আমি বললাম, “পুলিশ খবর পেলে রাস্তায় গ্রেফতার করতে চেষ্টা করতে পারে”। ওরা বলল, “ভাইজান, এটা গোপালগঞ্জ; এখন থেকে ইচ্ছা না করলে ধরে নেওয়ার ক্ষমতা কারও নাই”। গোলাপগঞ্জের মানুষ বিশেষ করে ছাএ ও যুবকরা আমাকে “ভাইজান” বলে ডাকে। এমনও আছে, ছেলেও ‘ভাইজান’ বলে, আবার বাবাও ‘ভাইজান’বলে ডাকে । (পৃ-১৬৩)।
ভূক্তি-৬০১ সন্ধ্যার সময় আমাদের জাহাজ ঘাট পাটগাতি পৌঁছালাম।নৌকায় প্রায় এক ঘন্টা লাগবে।বাড়িতে পৌঁছালাম,কেউ ভাবতেও পারে নাই আমি আসব।সকলেই খুব খুশি।মেয়েটা তো কোল থেকে নামতেই চায় না,আর ঘুমাতেও চায় না।আব্বাকে বললাম সকল কথা।বাড়িতে পাহাড়া রাখলাম।বৈঠকখানায় রাতভর লোকজেগে থাকবে; যদি কেউ আসে আমাকে খবর দিবে।আমাদের বাড়ি অনেক বড় এবং অনেক লোক।এখন গ্রেফতার হতে আমার বেশি আপওি নাই।তবে ঢাকা যাওয়া দরকার একবার।বোধহয় সাত-আট দিন বাড়িতে রইলাম। (পৃ-১৬৪)।
ভূক্তি-৬০২ বড়বোনের বাড়ি শিবচর হতে মাএ পাঁচ মাইল পথ। রেণু বলল, “কতদিন দেখা হবে না বলতে পারি না।আমি ও ছেলেমেয়ে দুইটা তোমার সাথে থাকব।পরে আব্বা যেয়ে আমাকে নিয়ে আসবেন”। আমি রাজি হলাম,কারন আমিতো জানি,এবার আমাকে বন্দি করলে সহজে ছাড়বে না।দুইজন কর্মীও আমার সাথে চলল। একজনের নাম শহীদুল ইসলাম, আরেক জনের নাম সিরাজ।এরা কবিরাজপুর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল এবংরাতভর পাহাড়া দিয়েছিল।শীতের দিন ওরা এক কাপড়ে এসেছিল। রেণু নিজের গায়ের চাদর ওদের দিয়েছিল। (পৃ-১৬৪)।
ভূক্তি-৬০৩ আমরা বোনের বাড়িতে পৌঁছালাম,একদিন দুইদিন করে সাত দিন সেখানে রইরাম।ছেলেমেয়েদের জন্য যেন একটু বেশি মায়া হয়ে উঠেছিল। ওদের ছেড়ে যেতে মনচায়না,তবুও তো যেতে হবে। দেশ সেবায় নেমেছি,দয়া মায়া করে লাভ কি?দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবংসে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে।আব্বা আমাকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন।আর রেণুও কিছু টাকা নিয়ে এসেছিল আমাকে দিতে। আমি রেণুকে বললাম, “এতদিন একলা ছিলে,এখন আরও দু’জন তোমার দলে বেড়েছে। আমার দ্বারা তো কোনো আর্থিক সাহায্য পাবার আশা নাই।তোমাকেই চালাতে হবে।আব্বার কাছে তো সকল সময় তুমি চাইতে পার না,সে আমি জানি।আর আব্বাই বা কোথায় এত টাকা পাবেন?আমার টাকার বেশি দরকার নাই।শীঘ্রই গ্রেফতার করে ফেলবে।পালিয়ে বেড়াতে আমি পারব না।তোমাদের সাথে কবে আর দেখা হয় ঠিক নাই।ঢাকা এস না।ছেলেমেয়েদের কষ্ট হবে।মেজোবোনের বাসায়ও জায়গা খুব কম। কোনো আত্মীয়দের আমার জন্য কষ্ট হয়,তা আমি চাই না। চিঠি লিখ, আমিও লিখব”। (পৃ-১৬৪)।
ভূক্তি-৬০৪ রাতে রওয়ানা হয়ে এলাম, দিনের বেলায় আসলে হাচিনা কাঁদবে। কামাল তো কিছুই বোঝে না। রেণু আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় নীরবে চোখের পানি ফেলছিল।আমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম না,একটা চুমা দিয়ে বিদায় নিলাম। বলবার তো কিছুই আমার ছিল না। সবই তো ওকে বলেছি।রাতে নৌকা ছেড়ে সকালে চান্দের চর স্টেশনে পৌঁছালাম। (পৃ-১৬৫)।
ভূক্তি-৬০৫ শাহজাহান বলতে লাগল, “আর কেউ পুলিশকে খবর দেয় নাই,মামাই দিয়েছে। বাবা বাড়িতে আসুক ওকে মজা দেখাব”। শাজাহান আমাকে খুব ভালবাসত,সময় পেলেই আমার কাছে ছুটে আসত। আমি যখন পুলিশের গাড়িতে উঠেচলে যাই,শাহজাহান কেঁদে দিয়েছিল।আমার খুব খারাপ লেগেছিল।শাহজাহানের ঐ কান্নার কথা কোনদিন ভুলতে পারি নাই। (পৃ-১৬৭)।
ভূক্তি-৬০৬ পরের দিন দুপুরবেলায় আমাকে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দিল।আমি জেলে আসার পরেশুনলাম,আমাকে ডিভিশন দেয় নাই। সাধারন কয়েদি হিসেবে থাকতে হবে। কখনও রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য কোনো স্ট্যাটাস দেওয়া হয় নাই।যাকে ইচ্ছা ডিভিশন দিতে পারে সরকার,আর না দিলে সাধারন কয়েদি হিসেবে জেল খাটতে হবে। সাধারন কয়েদিরা যা খায় তাই খেতে হবে। দুপুরে কিছুই খেলাম না।আমাকে হাজতে রাখা হয়েছে সাধারন কয়েদিদের সাথে। (পৃ-১৬৭)।
ভূক্তি-৬০৭ ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি জেলে আসলাম।১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হয়েছে।আমার তিনবার জেলে আসতে হল,এইবার নিয়ে।মওলানা সাহেবের কাছে সকল কিছুই বললাম।মওলানা সাহেব এক এক করে জিঞ্জাসা করতে লাগলেন।সোহরাওয়ার্দী সাহেব কি বলেছেন? পীর মানকী শরীফের মতামত কি?মিয়া সাহেব রাজনীতি করবেন কি না?নিখিলপাকিস্তান আওয়ামীলীগ গঠন হবে কি না?হলে,কতদিন লাগবে?লাহোরে কোথায় ছিলাম? (পৃ-১৬৮)।
ভূক্তি-৬০৮ শামসুল হক সাহেব আমার উপর খুব রাগ করেছিলেন।কারন,কেন আমি শোভাযাএা করতে প্রস্তাব দিয়েছিলাম।শোভাযাএা না করলে তো গোলমাল হত না।আর আমাদের আসতে হত না এই সময়। (পৃ-১৬৮)।
ভূক্তি-৬০৯ শামসুল হক সাহেব মাএ দেড় মাস পূর্বে বিবাহ করেছিলেন।হক সাহেব ও তাঁর বেগম আফিয়া খাতুন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতেন।একে অন্যকে পছন্দ করেই বিবাহ করেছিলেন।আমাকে বেশিকিছু বললে আমি তাঁকে “বউ পাগলা”বলতাম।তিনি ক্ষেপে আমাকে অনেক কিছু বলতেন। মওলানা সাহেব হাসতেন, তাতে তিনি আরও রাগ করতেন এবং মওলানা সাহেবকে কড়া কথা বলে ফেলতেন।মওলানা সাহেবের সাথে আমরা তিনজনই নামাজ পড়তাম।মওলানা সাহেব মাগরিবের নামাজের পরে কোরআন মজিদের অর্থ করে আমাদের বোঝাতেন।রোজই এটা আমাদের জন্য বাঁধা নিয়মছিল।শামসুল হক সাহেবকে নিয়ে বিপদ হত ।এক ঘন্টার কমে কোনো নামাজই শেষ করতে পারতেন না। এক একটা সেজদায় আট-দশ মিনিট লাগিয়ে দিতেন।মাঝে মাঝে চক্ষু বুজে বসে থাকতেন। (পৃ-১৬৮-১৬৯)।
ভূক্তি-৬১০ আতাউর রহমান সাহেব আমাদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করতেন।যেদিন হক সাহেবের সাথে তাঁর বেগম দেখা করতে আসতেন,সেদিন হক সাহেবের সাথে কথা বলা কষ্টকর হত।সত্যই আমার দু:খ হত।দেড় মাসও একসাথে থাকতে পারল না বেচারী!একে অন্যকে যথেষ্টভালবাসত বলে মনে হয়।আমি বেগম হককে ভাবী বলতাম,ভাবী আমাকেও দু’একখানা বই পাঠাতেন। হক সাহেবকে বলে দিতেন,আমার কিছু দরকার হলে যেন খবর দেই। আমি ফুলের বাগান করতাম। তাদের দেখা হবার দিনে ফুল তুলে হয় আমি ফুলের মালা,না হয় তোড়া বানিয়ে দিতাম। হক সাহেব জেলের আবদ্ধ অবস্থা আর সহ্য করতে পারছিলেন না। (পৃ-১৬৯)।
ভূক্তি-৬১১ তিনি (হক সাহেব)এক নতুন উৎপাত শুরু করলেন।রাতে বারটার পরে জিকির করতেন।আল্লাহ,আল্লাহ বলে জোরে জিকির করতে থাকতেন।এক ঘন্টা থেকে দুই ঘন্টা পর্যন্ত। অনেক সময় মধ্যরাতেও শুরু করতেন। আমরা দশ-পনেরজন কেউই ঘুমাতে পারতাম না।একদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে হক সাহেবকে বললাম, “এভাবে চলবে কেমন করে?রাতে ঘুমাতে না পারলে শরীরটা তো নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি রাগ করে বললেন, “আমার জিকির করতে হবে,যা ইচ্ছা কর।এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাও”। তখন আমি কিছুই বললাম না, কিছু সময় পরে বললাম,রাতে যখন জিকির করবেন আমি আপনার মাথায় পানি ঢেলে দেব,যা হবার হবে।তিনি রাগ করলেন না, আস্তে আস্তে আমাকে বললেন, “বুঝতে পারছ না কিছুই,আমি সাধনা করছি।একদিন ফল দেখবা”কি আর করা যাবে নীরবে সহ্য করা ছাড়া!হক সাহেবের শরীর খারাপ হয়ে চলেছে। (পৃ-১৬৯-১৭০)।
ভূক্তি-৬১২ আমরা যখন জেলে তখন এক রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হল, কলকাতা ও ঢাকায়।কলকাতায় নিরাপরাধ মুসলমান এবং ঢাকায় ও বরিশালে নিরাপরাধ হিন্দু মারা গেল।কে বা কারা রটিয়ে দিয়েছিল যে,শেরে বাংলা ফজলুল হক সাহেবকে কলকাতায় হত্যা করেছে। আর যায় কোথায়! মুসলমানরা ঝাঁপিয়ে পড়ল।তাদের অনেক লোককে গ্রেফতার করে আনল ঢাকা জেলে।আমরা যেখানে থাকি সেই পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডেই এদের দিনের বেলায় রাখত।আমার মনে হয় সাত-আটশত লোককে গ্রেফতার করেছে।সাধারনত দোষী ব্যাক্তিরা গ্রেফতার বেশি হয় না।রাস্তার নিরিহ লোকই বেশি গ্রেফতার হয়। তাদের কাছে বসে বলি,দাঙ্গা করা উচিত না; যে কোনোদোষ করে না তাকে হত্যা করা পাপ।মুসলমানরা কোনো নিরাপরাধীকে অত্যাচার করতে পারে না,আল্লাহ ও রাসুল নিষেধ করে দিয়েছেন।হিন্দুরেও আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন।তারাও মানুষ।হিন্দুস্তানের হিন্দুরা অন্যায় করবে বলে আমরাও অন্যায় করব-এটা হতে পারে না।ঢাকার অনেক নামকরা গুন্ডা প্রকৃতির লোকদের সাথে আলাপ হল,তারা অনেকেই আমাকে কথা দিল,আর কোনোদিনও দাঙ্গা করবে না। (পৃ-১৭০)।
ভূক্তি-৬১৩ হক সাহেব আমার পাশের সেলে থাকবেন ঠিক করলেন এবং বললেন, “খুব ভাল হয়েছে।এখন আমি রাতভর জিকির করব। কেউকিছু বলতে পারবে না”। তাঁকে বললাম, ‘‘হয় আপনি উপরে থাকেন,না হয় আমি উপরে থাকব। আমার পাশের সেলে থেকে যদি শুরু করেন, তবে ঘুমের কাজ হয়েছে”।হক সাহেব রাগ করে নিচে গেলেন এবং এক পাশের একটা সেল নিলেন।আমি তাঁকে অনেক অনুরোধ করলাম, মওলানা সাহেবও বললেন; কিছুতেই শুনলেন না।এখন থেকে তিনি আরও জোরে জোরে জিকির করতে লাগলেন।আর তার উৎপাতে আমরা ঘুমাতে পারি না।কয়েকদিন পরে হাজী দানেশ সাহেব কে ঢাকা জেলে এনে আমাদের সাথে রেখেছে। (পৃ-১৭০)।
ভূক্তি- ৬১৪ এই প্রথম আমি সেলে থাকি।জেলের মধ্যেজেল,তাকেই বলে সেল।(বঙ্গবন্ধু)
(পৃ-১৭১)।
ভূক্তি- ৬১৫ আমি একটি ফুলের বাগান শুরু করেছিলাম।এখানে কোনো ফুলের বাগান ছিল না।জমাদার সিপাহীদের দিয়ে আমি ওয়ার্ড থেকে ফুলের গাছ আনাতাম।আমার বাগানটা খুব সুন্দর হয়েছিল।(বঙ্গবন্ধু) (পৃ-১৭১)।
ভূক্তি- ৬১৬ এই ওয়ার্ডের দেয়ালের পাশেই সরকারি প্রেস ছিল।এটা জেলের একটা অংশ।প্রেসের শব্দ পেতাম,কিন্তু প্রেস দেখতে পারতাম না।সকালবেলা যখন কর্মচারীরা আসতেন এবং বিকালে ছুটির পর যখন যেতেন আমি জানালা দিয়ে তাঁদের দেখতাম।ওদের দেখলেই আমার মনে হত যে ওরা বড় জেলে,আর আমরা ছোট জেলে আছি।স্বাধীন দেশের মানুষের ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই, এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কি হতে পারে? (পৃ-১৭১)।
ভূক্তি- ৬১৭ পাকিস্তানের নাগরিকদের বিনা বিচারে বছরের পর কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে।ছয়মাস পর পর একটা করে হুকুমনামা সরকার থেকে আসে। ইংরেজ আমলেও রাজনৈতিক বন্দিদের কতগুলি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হত,যা স্বাধীন দেশে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।রাজনৈতিক বন্দিদের খাওয়া দাওয়া,কাপড়চোপড়, ঔষধ,খবরের কাগজ,খেলাধুলার সামগ্রী এমনকি এদের ফ্যামিলি এলাউন্সও দেওয়া হত ইংরেজ আমলে।নূরুল আমিন সাহেবেরমুসলিম লীগ সরকার সেসব থেকে ও বন্দিদের বঞ্চিত করেছেন।এমনকি মুসলিম লীগ নেতারা বলতে শুরু করেছে,বিদেশী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জেল খাটলে সেটা হত দেশ দরদীর কাজ।এখন দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জেল খাটছে যারা, তারা হল “দেশদ্রোহী”।এদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে না।ইংরেজের ‘স্যার’, ‘খান বাহাদুর’ উপাধিধারীরা সরকার গঠন করার সুযোগ পেয়ে আজ একথা বলছেন। (পৃ-১৭১)।
ভূক্তি-৬১৮ রাজনৈতিক বন্দিরা যাতে কারাগারের মধ্যে ইংরেজ আমলের সুযোগ –সবিধাটুকু পেতে পারে তার জন্য অনেক দরখাস্ত,অনেক দাবি করেছে কিন্তু কিছুতেই সরকার রাজি হল না।বাধ্য হয়ে তাদের অনশন ধর্মঘট করতে হয়েছিল।১৯৪৯ সালে৩৬৫ দিনের মধ্যে ২০০ দিন রাজনৈতিক বন্দিরা অনশন করে,যার ফলে ঢাকা জেলে শিবেন রায় মারা যান।যাঁরা বেঁচেছিলেন অনেকের স্বাস্থ্য চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। অনেক পরে যক্ষারোগে অক্রান্ত হন। অনেকের মাথাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। খাদ্যও চিকিৎসার অভাবে তাঁদের অবস্থা কি হয়েছিল তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউই বুঝতে পারবেন না (পৃ-১৭২)।
ভূক্তি- ৬১৯ ১৯৫০ সালে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে খাপড়া ওয়ার্ডের কামরায় বন্ধ করে রাজনৈতিক বন্দিদের উপর গুলি করে সাতজনকে হত্যা করা হয়। লিয়াকত আলী খান তাঁর কথা রাখবার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যারা আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল করবে তাদের ‘শের কুচাল দেঙ্গে’- কথা তিনি ঠিকই রেখেছিলেন। মাথা ভাঙ্গতে না পারলেও মাজা ভেঙ্গে দিয়েছিলেন, জেলে রেখে ও নির্যাতন করে। মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পরে লিয়াকত আলী খান সমস্ত ক্ষমতার মালিক হয়ে এক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর হুকুম মত প্রাদেশিক সরকারের নেতারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীদের উপর। সীমান্ত প্রদেশ ও বাংলার জেল তখন রাজনৈতিক বন্দিতে প্রায় ভর্তি হয়ে গেছে (পৃ-১৭২)।
ভূক্তি-৬২০ লিয়াকত আলী খান বাঙ্গালি ও পাঞ্জাবি সদস্যদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রেখে শাসন করতে চাইছিলেন, কারণ তিনি রিফিউজি। তাঁকে বিশেষভাবে নির্ভর করতে হয়েছিল আমলাতন্ত্রের উপর- যারা সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানের (পৃ-১৭৩)
ভূক্তি-৬২১ শামসুল হক সাহেবকে নিয়ে মাওলানা সাহেব ও আমি খুব বিপদে পড়লাম। তাঁর স্বস্থ্যও খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। প্রায় বাইশ পাউন্ড পর্যন্ত ওজন কমে গেছে। তারপরও রাতভরই জিকির করেন। মাঝে মাঝে গরমের দিন দুপুর বেলা কম্বল দিয়ে সারা শরীর ঢেকে ঘন্টার পর ঘন্ট শুয়ে থাকতেন। মাওলানা সাহেব ও আমি অনেক আলোচনা করলাম। আর কিছুদিন থাকলে পাগল হয়ে যাবার সম্ভবনা আছে। দু’একদিন আমার উপর রাগ হয়ে বলে, ‘‘আমাকে না ছাড়লে বন্ড দিয়ে চলে যাব। তোমার ও ভাসানীর পাগলামির জন্য জেল খাটব নাকি ?’’ (পৃ-১৭৪)
ভূক্তি-৬২২ আমার মেজোবোন (শেখ ফজলুল হক মচির মা) ঢাকায় থাকতেন, আমাকে দেখতে আসতেন। আমি বাড়িতে সকলকে নিষেধ করে দিয়েছিলাম, তবুও আব্বা আমাকে দেখতে আসলেন একবার। (পৃ-১৭৪)
ভূক্তি-৬২৩ একদিন ভাসানী সাহেব ও আমি কোর্টে যেয়ে দেখি মানিক ভাই দাড়িয়ে আছেন, আমাদের সাথে দেখা করার জন্য। আলাপ-আলোচনা হওয়ার পরে মানিক ভাই বললেন, ‘‘নানা অসুবিধায় আছি, আমাদের দিকে খেয়াল করার কেউই নাই। আমি কি আর করতে পারব, একটা বড় চাকরি পেয়েছি করাচিতে চলে যেতে চাই, আপনারা কি বলেন ?’’আমি বললাম, ‘‘মানিক ভাই, আপনিও আমাদের জেলে রেখে চলে যাবেন ? আমাদের দেখবারও কেউ বোধয় থাকবে না। আমি জানতাম মানিক ভাই চারটা ছেলেমেয়ে নিয়ে খুবই অসুবিধায় আছেন। ছেলেমেয়েদের পিরোজপুর রেখে তিনি একলাই ঢাকায় আছেন। মানিক ভাই কিছু সময় চুপ করে থেকে আমাদের বললেন, ‘‘না, যাব না আপনাদের জেলে রেখে (পৃ-১৭৪, ১৭৫) ।
ভূক্তি-৬২৪ মাওলানা সাহেব সাপ্তাহিক ইত্তেফাক কাগজ বের করছিলেন। কয়েক সপ্তাহ বের হওয়ার পরে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, টাকা কোথায় ? মানিক ভাইকে বললেন, কাগজটা তো বন্ধ হয়ে গেছে, যদি পার তুমিই চালাও, মানিক ভাই বলললেন, কি করে চলবে, টাকা কোথায়, তবুও চেষ্টা করে দেখব। আমি মানিক ভাইকে আমার এক বন্ধুর কর্মচারীর কথা বললাম, ভদ্রলোক আমাকে আপন ভাইয়ের মত ভালোবাসতো। কলকাতায় চাকরি করতেন, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ভক্ত ছিলেন। আমার কথা বললে কিছু সাহায্য করতেও পারেন
মানিক ভাই মামলার তারিখে বললেন যে, কাগজ তিনি চালাবেন। কাগজ বের করলেন। অনেক জায়গা থেকে টাকা যোগাড় করতে হয়েছিল। নিজেরও যা কিছু ছিল এই কাগজের জন্যই ব্যায় করতে লাগলেন। কিছুদিনের মধ্যে কাগজটা খুব জনপ্রিয় হতে লাগল। আওয়ামী লীগের সমর্থকরা তাঁকে সাহায্য করতে লাগল। সমস্ত জেলায় জেলায় কর্মীরা কাগজটা চালাতে শুরু করল। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানের কাগজ হিসেবে জনগন একে ধরে নিল। মানিক ভাই ইংরেজি লিখতে ভালবাসতেন, বাংলা লিখতে চাইতেন না। সেই মানিক ভাই বাংলায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলামিষ্টে পরিণত হলেন। চমৎকার লিখতে শুরু করলেন। নিজেই ইত্তেফাকের সম্পাদক ছিলেন। তাঁকে ছাত্র লীগের দুই-তিনজন কর্মী সাহায্য করত। টাকা পয়সার ব্যাপারে আমার বন্ধুই তাঁকে বেশি সাহায্য করতেন। বিজ্ঞাপন পাওয়া কষ্টকর ছিল, কারণ ব্যবসা-বানিজ্য কোথায়? আর সরকারি বিজ্ঞাপন তো আওয়ামী লীগের কাগজে দিত না। তবুও মানিক ভাই কাগজটাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন একমাত্র তাঁর নিজের চেষ্টায় (পৃ-১৭৫)
ভূক্তি-৬২৫ ১৯৫০ সালের শেষের দিকে মামলার শুনানি শেষ হল। ম্যজিস্ট্রেট সাহেব যে রায় দিলেন, তাতে মাওলানা সাহেব ও শামসুল হক সাহেবকে মুক্তি দিলেন। কিছুদিন পরে আমাকে গোপালগঞ্জ পাঠিয়ে দিল, কারণ গোপালগঞ্জে আরও একটা মামলা দায়ের করেছিল। মাওলানা সাহেবের কাছে এতদিন থাকলাম। তাঁকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হল। কিন্তুু উপায় নাই-যেতে হবে। আমি সাজাও ভোগ করছি এবং নিরাপত্তা বন্দিও আছি। ঢাকা জেলে আমাকে সুতা কাটতে দিয়েছিল। আমি যা পারতাম তাই করতাম। আমার খুব ভাল লাগত (পৃ-১৭৫)
ভূক্তি-৬২৬ পাটগাতি স্টেশন থেকে আমরা উঠানামা করি। আমাকে সকলেই জানে। স্টেশন মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের বাড়ির খবর কিছু জানেন কি না ? যা ভয় করেছিলাম তাই হল, পূর্বের রাতে আমার মা, আব্বা, রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা হয়ে গেছেন আমাকে দেখতে। এক জাহাজে আমি এসেছি। আর এক জাহাজে ওরা ঢাকা গিয়েছে। দুই জাহাজের দেখাও হয়েছে একই নদীতে। শুধু দেখা হল না আমাদের। এক বৎসর দেখি না ওদের। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বাড়িতে আর কাউকেও খবর দিলাম না। কিছুদিন পূর্বে রেণু লিখেছিল, ঢাকায় আসবে আমাকে দেখতে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হবে বুঝতে পারি নাই। (পৃ-১৭৬)
ভূক্তি-৬২৭ পুলিশ লাইন থেকে আমার গোপালগঞ্জ বাড়িও খুবই কাছাকাছি। বাড়িতে কয়েকজন ছাত্র থাকে, লেখাপড়া করে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগ অফিসও আমার বাড়িতে। আমার মনও খারাপ, আবার ক্লান্তও ছিলাম। একটা খাট আমাকে ছেড়ে দিল। খুব যতœ করল। তাড়াতাড়ি আমার বিছানাটাও করে দিল। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। (পৃ-১৭৬)
ভূক্তি-৬২৮ সকাল বেলা উঠে হাত মুখ ধুয়ে প্রস্তুত হতে লাগলাম। খবর রটে গেছে গোপালগঞ্জ শহরে। দশটার সময় আমাকে কোর্টে হাজির করল। অনেক লোক জমা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিলেন, আমাকে থানা এরিয়ার মধ্যে রাখতে। পরের দিন মামলার তারিখ। কোর্ট থেকে থানা প্রায় এক মাইল, আমাকে হেটে যেতে হবে। অন্য কেনো ব্যবস্থা নাই। কারণ, তখন গোপালগঞ্জে রিকশাও চলত না। অনেক লোক আমার সাথে চলল। গোপালগঞ্জের প্রত্যেকটা জিনিসের সাথে আমি পরিচিত। এখানকার স্কুলে লেখাপড়া করেছি, মাঠে খেলাধুলা করেছি। নদীর সাঁতার কেটেছি, প্রতিটি মানুষকে আমি জানি আর তাঁরাও আমাকে জানে। বাল্যস্মৃতি কেউ সহজে ভোলে না। এমন একটা বাড়ি হিন্দু-মুসলমানের নাই যা আমি জানতাম না। গোপালগঞ্জের প্রত্যেকটা জিনিসের সাথে আমার পরিচয়। এই শহরের আলো-বাতাসে আমি মানুষ হয়েছি। এখানেই আমার রাজনীতির হাতেঘড়ি হয়েছে। ছাত্ররা লেখাপড়া ছেড়ে বের হয়ে পড়ল, আমাকে দেখতে। সকলকে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতে করতেই থানার দিকে চললাম। (পৃ-১৭৬, ১৭৭)
ভূক্তি-৬২৯ থানায় পৌঁছালেই দারোগা সাহেবরা আমাকে একটা ঘর দিলেন, সেখানে স্বাধীনতার পূর্বে রাজনৌতিক কর্মীদের নজরবন্দি রাখা হত। এই মহল্লায় আমি ছোট সময় ছিলাম। এমন নজরবন্দিদের সাথে আলাপ করতাম ও মিশতাম। আমি ছোট ছিলাম বলে কেউ কিছু বলত না। আজ ভাগ্যের পরিহাস আমাকেই সেই পুরানা ঘরে থাকতে হল, স্বাধীনতা পাওয়ার পরে। থানার পাশেই আমার মামার বাড়ি। তিনি নামকরা মোক্তার ছিলেন। তিনি আর ইহজগতে নাই। (পৃ-১৭৭)
ভূক্তি-৬৩০ বহুদিন সূর্যাস্তের পরে বাইরে থাকতে পারি নাই। জেলের মধ্যে এক বৎসর হয়েছে, সন্ধ্যার পরে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেয়। জানালা দিয়ে শুধু কিছু জ্যোৎসা বা তারাগুলি দেখার চেষ্টা করেছি। আজ আর ঘরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বাইরে বসে রইলাম; পুলিশ আমাকে পাহাড়া দিচ্ছে। পুলিশ কর্মচারী যিনি রাতে ডিউটি করছিলেন, তিনিও এসে বসলেন। অনেক আলাপ হল। বাইরে থেকে দু’একজন বন্ধু-বান্ধবও এসেছিল। অনেক রাতে শুতে যেয়ে দেখি, ঘুমাবার উপায় নাই। এক রুমে আমি আর এম রুমে ওয়ারলেস মেশিন চলছে। খট খট শব্দ; কি আর করা যাবে ! আবার বাইরে যেয়ে বসলাম। বাইরে শোয়ার ইচ্ছা করছিল; কিন্তু উপায় নাই। গোপালগঞ্জের মশা নামকরা। কোর্টে পরের দিন হাজিরা দিলাম। সরকার পক্ষের থেকে মামলাটি পরিচালনা করবেন সরকারি উকিল রায় বাহাদুর বিনোদ ভদ্র। তিনি আসতে পারেন নাই। এক মাস পরে তারিখ পড়ল এবং আমাকে ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে রাখবার হুকুম হল। (পৃ-১৭৭)
ভূক্তি-৬৩১ অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে রইলাম নদীর দিকে মুখ করে। নৌকা যাচ্ছে আর নৌকা আসছে। পুলিশদের বললাম, ‘‘আমার জন্য চিন্তা করবেন না, ঘুমিয়ে থাকেন। আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিলেও যাব না।’’ তারা সকলেই হেসে দিয়ে বলল, ‘‘আমরা তা জানি, আপনার জন্য আমরা চিন্তা করি না।’’ (পৃ-১৭৮)
ভূক্তি-৬৩২ আমি চুপ করে বসে আছি। একজন জমাদার এসে আমাকে বলল, আপনি এই কামরায় আসেন। আমি সেই কামরায় গেলে, সে এসে আমার পকেটে হাত দিল। আমি তাকে বললাম, ‘‘আপনি আমার গায়ে হাত দেবেন না। আপনি আমাকে তল্লাশি করতে পারেন না। আইনে নাই। জেলার সাহেব বা ডেপুটি জেলার সাহেব দরকার হলে আমাকে তল্লাশি করতে পারেন।’’ আমি রাগ করে কথাটা বললাম, বেচারা ঘাবরিয়ে গেছে। আমি বললাম, ‘‘কার হুকুমে আপনি আমার শরীরে হাত লাগালেন, আমি জানতে চাই ! ’’একথা বলে ডেপুটি জেলারকে বললাম, ‘‘ব্যাপার কি ? আপনি হুকুম দিয়েছেন ?’’ ডেপুটি জেলার তাকে যেতে বললেন এবং আমাকে বললেন, ‘‘মনে কিছু করবেন না। ও জানে না”। ডেপুটি সাহেবকে বললাম, ‘‘দেখুন কি আছে আমার কাছে। সিগারেট, ম্যাচ ও রুমাল আছে’’। তিনি লজ্জা পেয়েছিলেন। আমাকে তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। (পৃ-১৭৯)
ভূক্তি-৬৩৩ আমাকে একা রাখা হতো শাস্তি দেওয়ার জন্য। কারাগারের অন্ধকার কামরায় একাকী থাকা যে কী কষ্টকর, ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারবে না। জেল কোডে আছে কোনো কয়েদিকে তিন মাসের বেশি একাকী রাখা চলবে না (পৃ-১৮০)
ভূক্তি-৬৩৪ ১৯৩৮-১৯৩৯ সালে আমার মা, বড় বোন এবং অন্যান্য বোনদের সোয়া শ’ ভরি সোনার গহনা এবং আমার মার নগদ কয়েক হাজার টাকা চুরি হয়ে যায়। আব্বা তখন গোপালগঞ্জ ছিলেন। আমাদের বাড়ির দুই চারশত বৎসরের ইতিহাসে কোনোদিন চুরি হয় নাই। এই প্রথম চুরি। রহিম মিয়া আস্তে আস্তে বললেন, ‘‘হ্যাঁ আমি চুরি করেছিলাম’’। আমি বললাম, ‘‘আমাদের বাড়ীতেও সাহস করে এলেন কি করে ? আমাদের ঘরে বন্দুক আছে। অনেক শরিকদের বাড়িতে বন্দুক আছে। এত বড় বাড়ি, কত লোক’’। সে বলল, ‘‘গ্রামের লোক এবং আপনাদের বাড়ির লোক সাথে ছিল’’। (পৃ-১৮১)
ভূক্তি-৬৩৫ রহিম বলতে লাগল তার ইতিহাস। আজ অনেক দিন জেলে আছে। বলল, ‘‘আপনাদের বাড়িতে চুরি করে যখন কিছু হল না, তখন ঘোষণা করলাম, লোকে বলে চেরের বাড়িতে দালান হয় না, আমি দালান দেব। কিছু দিন পরে আর একটা ডাকাতি করতে গেলাম বাগেরহাটে। সেখানে ধরা পড়লাম। সকল মামলা মিলে আমার পনের-ষোল বৎসর জেল হয়েছে। পাকিস্তান হওয়ার পূর্বে দমমম জেলে ছিলাম। সেখান থেকে রাজশাহী তারপর ফরিদপুর জেলে এসেছি। জেলে বসে চিন্তা করে দেখলাম, আপনাদের বাড়ি আমাদের পুন্যস্থান ছিল, সেখানে হাত দিয়ে হাত জ্বলে গেছে। আপনার মা’র কাছে ক্ষমা চাইতে পারলে বোধয় পাপমোচন হত’’।
আমি বললাম, ‘‘রহিম মিয়া, আমার মা ও আব্বা বড় দুঃখ পেয়েছিলেন। কারণ আমাদের সর্বস্ব গেলেও কিছু হত না কিন্তু আমার বিধবা বড়বোনের গহনাই বেশি ছিল। সে একটা ছেলে ও একটা মেয়ে নিয়ে উনিশ বছর বয়সে বিধবা হয়েছিল’’ বলল, ‘‘আর জীবনে চুরি করব না। আরও কয়েক বৎসর ঘাটতে হবে। শরীর ভেঙ্গে গেছে”। রহিম মিয়া হাসপাতালে প্রাই ভর্তি হয়ে থাকত। শরীর স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সময় পেলেই আমার কাছে আসত। সুখ-দুঃখের অনেক কথাই বলত। আমার মনে হচ্ছিল, বোধহয় একটা পরিবর্তন এসেছে ওর মনে। (পৃ-১৮১, ১৮২)
ভূক্তি-৬৩৬ যদিও সরকার কয়েদিদের দিয়ে ঘানি ঘুরিয়ে তেল করতে নিষেধ করেছেন, তথাপি ফরিদপুর জেলে এখনও ঘানি ঘুরিয়ে তেল করা হচ্ছিল। আমি জেলার সাহেবকে বললাম, ‘‘এখনও আপনারা জেলে মানুষ দিয়ে ঘানি ঘুরান”? তিনি বললেন, ‘‘কয়েকদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে। গরু কিনতে দিয়েছি”। কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। (পৃ-১৮২)
ভূক্তি-৬৩৭ ঢাকা ও ফরিদপুর জেলে অনেক বড় চোর ও দুর্ধর্ষ ডাকাতের সাথে আলাপ হয়েছে। কারও গলার মাধ্যে ‘‘খোকর” (মানে গর্ত) থাকে। তার মধ্যে লুকিয়ে টাকা, সোনার আংটি, যিনি রাখে। দরকার হলে সেগুলি দিয়ে জিনিসপত্র কিনে আনায়। একটু ভালভাবে থাকার জন্য কিছু কিছু খরচও করে। আমার কাছে সিগারেটের কাগজও চেয়ে নিয়েছে অনেকে। একবার ঢাকায় এক কয়েদিকে বললাম, ‘‘আমাকে খোকরের কেরামতি দেখালে কাগজ দিব, নতুবা কাগজ দিব না,’’ বলল, ‘‘দেখাব আপনাকে, একটু দেরি করেন,’’ সিপাহি একটু দূরে গেলে বমি করার ভান করল, তাতে একটা কাাঁচা টাকা বের হয়ে আসল। বললাম, ‘‘হয়েছে আর দরকার নাই। বুঝতে পেরেছি”। (পৃ-১৮২)
ভূক্তি-৬৩৮ গোপালগঞ্জ যেয়ে দেখি থানার ঘাটে আমাদের নৌকায় আব্বা, মা, রেণু, হাচিনা ও কামালকে নিয়ে হাজির। ঘাটেই দেখা হয়ে গেল। এরাও এইমাত্র বাড়ি থেকে এসে পৌঁছেছে। গোপলগঞ্জ থেকে আমার বাড়ি দৌদ্দ ঘাটল দূরে। এক বৎসর পরে আজ ওদের সাথে আমার দেখা। হাচিনা আমার গলা ধরে আর ছাড়তে চায় না। কামাল আমার দিকে চেয়ে আছে, আমাকে চেনেও না আর বুঝতে পারে না, আমি কে? মা কাঁদতে লাগল। আব্বা মাকে ধমক দিলেন এবং কাঁদতে নিষেধ করলেন। আমি থানায় আসলাম, বাড়ির সকলে আমাদের গোপালগঞ্জের বাসায় উঠল। (পৃ-১৮৩)
ভূক্তি-৬৩৯ তাড়াতাড়ি কোর্টে যেতে হবে। প্রস্তুত হয়ে কোর্টে রওনা করলাম, এবার রাস্তায় অনেক ভিড়। বহু গ্রাম থেকেও অনেক সহকর্মী ও সমর্থক আমাকে দেখতে এসেছে। কোর্টে হাজির হলাম, হাকিম সাহেব বেশি দেরি না করে সাক্ষ্য নিতে শুরু করলেন। আমি আমার আইনজীবীকে বললাম অনুমতি নিতে, যাতে আমার মা, আব্বা, ছেলেমেয়েরা আমার সাথে থানায় সাক্ষাৎ করতে পারেন। তিনি অনুমতি দিলেন। (পৃ-১৮৩)
ভূক্তি-৬৪০ থানার দিকে এলাম এবং দারোগা সাহেবের বাড়িতেই আমার মালপত্র রাখা হল। আব্বা, মা, রেণু খবর পেয়ে সেখানেই আসলেন। আব্বা, মা, ও ছেলে মেয়েরা কয়েক ঘন্টা রইল। কামাল কিছুতেই আমার কাছে আসল না। দূর থেকে চেয়ে থাকে। ও বোধহয় ভাবত, এ লোকটা কে? পরের দিন আবার দেখা হল, আমি কোর্টে থেকে ফিরে আসার পরেই আমাকে রওয়ানা করতে হল। (পৃ-১৮৩, ১৮৪)
ভূক্তি-৬৪১ খুলনা জেলে যেয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কোনো জায়গাই নাই। একটা মাত্র দালান, তারই মধ্যে কয়েদি ও হাজতি সকলকে একসঙ্গে রাখা হয়েছে। আমাকে কোথায় রাখবে? একটা সেল আছে, সেখানে ভীষণ প্রকৃতির কয়েদিদের রাখা হয়। জেলার সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন ভিতরে। বললেন, ‘‘দেখুন অবস্থা, কোথায় রাখব আপনাকে, ছোট জেল’’। আমি আবার রাজনৈতিক বন্ধি হয়ে গেছি। সাজা আমার খাটা হয়ে গেছে। মাত্র তিন মাস জেল দিয়েছিল। একটা সেলে আমাকে রাখা হল আর হাসপাতাল থেকে ভাত তরকারি দিবে তাই খেতে হবে, রেগীরা যা খায়। বাড়ি থেকে কিছু চিঁড়া, মুড়ি, বিস্কুট আমাকে দিয়েছিল। আমাকে খেয়ে বাঁচতে হবে। আমার জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। আমি জেলার সাহেবকে বললাম, ‘‘আপনি লেখেন ওপরে। এখানে জায়গা নাই। আমার এখানে থাকা চলবে না। আর যদি রাখতে হয়, থাকার ভাল ব্যবস্থা করতে হবে”। (পৃ-১৮৪)
ভূক্তি-৬৪২ তখন খুলনায় মোহাম্মদ হোসেন সাহেব সিভিল সার্জন। তিনি জেল পরিদর্শন করতে এসে আমার কথা শুনে আমাকে অফিসে নিয়ে যেতে বললেন। আমি যেয়ে দেখি তিনি বসে আছেন। আমাকে বসতে বললেন তাঁর কাছে। আমি বসার সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আপনি কেন জেল খাটছেন”। আমিও উত্তর দিলাম, ‘‘ক্ষমতা দখল করার জন্য’’। তিনি আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘‘ক্ষমতা দখল করে কি করবেন?’’ বললাম, ‘‘যদি পারি দেশের জণগনের জন্য কিছু করব। ক্ষমতায় না যেয়ে তা করা যায় ?’’ (পৃ-১৮৫)
ভূক্তি-৬৪৩ তিনি আমাকে বললেন, ‘‘বহুদিন জেলের সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে। অনেক রাজবন্দির সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। অনেকের সাথে আলাপ হয়েছে, এভাবে কেউ আমাকে উত্তর দেয় নাই; যেভাবে আপনি উত্তর দিলেন। সকলের ঐ একই কথা, জনগণের উপকারের জন্য জেল খাটছি। দেশের খেদমত করছি, অত্যাচার সহ্য করতে পারছি না বলে প্রতিবাদ করেছি, তাই জেলে এসেছি। কিন্তু আপনি সোজা কথা বললেন, তাই আপনাকে ধন্যবাদ দিলাম”। তারপর আমার সুবিধা অসুবিধার কথা আলোচনা হল। তিনি আমাকে বললেন যে, তিনিও উপরের কর্মকর্তাদের কাছে রাজবন্দিদের অসুবিধার কথা লিখেছেন। শীঘ্রই উত্তর পাবার আশা করেন। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে তাও বললেন। জেল অফিসের পিছনে সামান্য জায়গা ছিল। বিকালে এখানে আমি হাঁটাচলা করতাম। জেলার সাহেব হুকুম দিয়েছিলেন। এই অন্ধকূপের মধ্যে থাকা সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। জানালা নাই, মাত্র একটা দরজা, তার সামনেও আবার দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। রাজশাহীর একজন সিপাহীর ডিউটি প্রায়ই ওকানে পড়ত। চমৎকার গান গাইত। সে আসলেই তার গান শুনতাম। (পৃ-১৮৫)
ভূক্তি-৬৪৪ আমি গোপালগঞ্জে আসলাম, মামলা চলছিল। সরকারি কর্মচারীরা সাক্ষী। আমি জেল থেকে যাই আর সরকারি উকিল ও কোর্ট ইন্সপেক্টর ফরিদপুর থেকে আসেন। বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এসেছে। বললাম কিছু ডিম কিনে দিতে, কারণ না খেয়ে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। এক মাসে শরীর আমার একদম ভেঙ্গে গিয়েছে। চোখের অবস্থা খারাপ। পেটের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। বুকে ব্যাথা অনুভব করতে শুরু করেছি। রেণু আমাকে সাবধান করল এবং বলল, ‘‘ভুলে যেও না, তুমি হার্টের অসুখে ভুগেছিলে এবং চক্ষু অপারেশন হয়েছিল”। ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, আর কি করা যায়। হাচু আমাকে মোটেই ছাড়তে চায় না। আজকাল বিদায় নেওয়ার সময় কাঁদতে শুরু করে। কামালও আমার কাছে এখন আসে। হাচু ‘আব্বা’ বলে দেখে কামালও ‘‘আব্বা” বলতে শুরু করেছে। (পৃ-১৮৫)
ভূক্তি-৬৪৫ কিছু দিন পরে ঢাকা জেল থেকে নেতা বিষ্ণু চ্যাটার্জী এলেন, পায়ে ডান্ডা বেড়ি দেওয়া অবস্থায়। তাঁর সাজা হয়েছে একটা মামলায়। এখন একজন সাধারণ কয়েদি। সদা হাসি খুশি মুখ, কোনো দুঃখ নাই বলে মনে হল। একদিন বললেন, ‘‘দুঃখ তো আর কিছু নয়, এরা আমাকে ডাকাতি মামলার আসামী করল”। বিষ্ণু বাবুকে ডিভিশন দেয় নাই। (পৃ-১৮৬)
ভূক্তি-৬৪৬ প্রায় তিন মাস হয়েছে খুলনা জেলে এসেছি। নিরাপত্তা আইনের বন্দিরা ছয় মাস পরপর সরকার থেকে একটা করে নতুন হুকুম পেত। আমার বোধহয় আঠার মাস হয়ে গেছে। জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে কোন হুকুমের ওপর ভিত্তি করে জেলে রাখবেন ? আমি বললাম, ‘‘অর্ডার যখন আসে নাই, আমাকে ছেড়ে দেন। যদি আমাকে বন্দি রাখেন, তবে আমি বেআইনিভাবে আটক রাখার জন্য মামলা দায়ের করে দিব”। (পৃ-১৮৬)
ভূক্তি-৬৪৭ রেডিওগ্রামে অর্ডার এসেছে আমাকে আবার গ্রেফতার করতে, নিরাপত্তা আইনে। আমি বললাম, ‘‘ঠিক আছে চলুন” কর্মচারীরা ভদ্রতা করে বলল, ‘‘আমাদের সাথে আসতে হবে না। আপনি থানায় গেলেই চলবে’’। কারণ, আমাকে নিয়ে যাওয়া হলে একটা গোলমাল হতে পারত। আমি সকলকে ডেকে বললাম, “আপনারা হৈচৈ করবেন না, আমি মুক্তি পেলাম না। আবার হুকুম এসেছে আমাকে গ্রেফতার করতে। আমাকে থানায় যেতে হবে। এদের কোন দোষ নাই। আমি নিজে হুকুম দেখেছি”। কয়েকজন কর্মী কেঁদে দিল। আর কয়েকজন চিৎকার করে উঠল, ‘‘না যেতে দিব না; তাঁরা কেড়ে নিয়ে যাক”। আমি ওদের বুঝিয়ে বললাম, তারা বুঝতে পারল। (পৃ-১৮৭)
ভূক্তি-৬৪৮ রাতভর সকলে জেগেছিল বাড়িতে, আমি কোনো সময় পৌঁছাতে পারি ভেবে। মা অনেক কেঁদেছিল, খবর পেলাম। আমার মনটাও খারাপ হল। আমার মা, আব্বা ও ভাইবোন এবং ছেলেমেয়েদের এ দুঃখ না দিলেই পারত। (পৃ-১৮৭)
ভূক্তি-৬৪৯ আমি ফরিদপুর জেলে ফিরে এলাম। এবার আমাকে রাখা হল রাজবন্দিদের ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডে দুইটা কামরা; এক কামরায় পাঁচজন ছিল। আরেক কামরায় গোপালগঞ্জের বাবু চন্দ্র ঘোষ, মাদারীপুরের বাবু ফনি মজুমদার ও আমি। এই দুজনকে আমি পূর্ব থেকেই জানতাম। ফনি মজুমদার পূর্বে ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা ছিলেন। ইংরেজ আমলে আট-নয় বৎসর জেল খেটেছেন। বিবাহ করেন নাই। ফনি বাবু দেশ ছাড়তে রাজী হন নাই বলে তাঁর বাবাও দেশ ছাড়েন নাই। হিন্দু-মুসলমান জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তাঁকে ভালবাসত। কেউ কোন বিপদে পড়লে ফনি মজুমদার হাজির হতেন। কারো বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে ফনি মজুমদারকে পাওয়া যেত। আমাকে অত্যন্ত ¯েœহ করতেন। সরকার যাদের কমিউনিস্ট ভাবতেন, তারা আছে এক কামরায়। আমরা তিনজন কমিউনিস্ট নই, তাই আমরা আছি অন্য কামরায়।
চন্দ্র ঘোষ ছিলেন একজন সমাজকর্মী। জীবনে রাজনীতি করেন নাই। মহাত্মা গান্ধীর মতো একখানা কাপড় পড়তেন, একখানা গায়ে দিতেন। শীতের সময়ও তার কোনো ব্যতিক্রম হত না। জুতা পরতেন না, খড়ম পায়ে দিতেন। গোপালগঞ্জ মহুকুমায় তিনি অনেক স্কুল করেছেন। কাশিয়ানী থানার রামদিয়া গ্রামে একটা ডিগ্রি কলেজ করেছেন। অনেক খাল কেটেছেন, রাস্তা করেছেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব গোপলগঞ্জে এসে ১৯৪৮ সালে বলেছিলেন, চন্দ্র ঘোষের মত মানুষকে গ্রেফতার করে ও মিথ্যা মামলা দিয়ে পাকিস্তানের বদনামই করা হচ্ছে। আমিও অনেক সরকারি কর্মচারীকে বলেছিলাম, এ ভদ্রলোককে অত্যাচার না করতে। কারণ, তিনি কোনোদিন রাজনীতি করেন নাই। সমাজের অনেক কাজ হবে তাঁর মত নিঃস্বার্থ ত্যাগী সমাজসেবক দিয়ে। (পৃ-১৮৭, ১৮৮)
ভূক্তি-৬৫০ আমি ফরিদপুর জেলে আসলাম, স্বাস্থ্য খারাপ নিয়ে। এসেই আমার ভীষণ জ্বর, মাথার যন্ত্রণা, বুকে ব্যাথা অনুভব করতে লাগলাম। রাতভর চন্দ্রবাবু আমার মাথার কাছে বসে পানি ঢেলেছেন। যখনই আমার হুঁশ হয়েছে দেখি চন্দ্র বাবু বসে আছেন। ফনি বাবুও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতেন আমার জন্য। তিন দিনের মধ্যে আমি চন্দ্র বাবুকে বিছানায় শুতে দেখি নাই। আমার মাথা টিপে দিয়েছেন। কখনও পানি ঢালছেন, কখনও ঔষধ খাওয়াচ্ছেন। কখনও পথ্য খেতে অনুরোধ করছেন। না খেতে চাইলে ধমক দিয়ে খাওয়াতেন। আমি অনুরোধ করতাম, এত কষ্ট না করতে। তিনি বলতেন, ‘‘জীবনভরই তো এই কাজ করে এসেছি, এখন বুড়াকালে কষ্ট হয় না’’। ডাক্তার সাহেব আমাকে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু চন্দ্র বাবু ও ফনি বাবু দেন নাই, কারণ সেখানে কে দেখবে ? (পৃ-১৮৯)
ভূক্তি-৬৫১ খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম বলে গোপালগঞ্জে মামলার দিনে যেতে পারি নাই। বাড়ির সকলে এসে ফিরে গিয়েছিল। আমি গোপালগঞ্জে না যাওয়ায় আব্বা খুব চিন্তিত হয়ে পরে টেলিগ্রাম করেছিলেন। (পৃ-১৮৯)।
ভূক্তি-৬৫২ গোপালগঞ্জে মামলার তারিখে আবার সেই পুরানা পথ দিয়ে যেতে হল। এবার যেন সিদ্ধিয়া ঘাট ডাকবাংলোকে আমার আরও ভাল লাগল। অনেক দিন পরে রাতে খরের বাইরে আছি। কত কথাই না মনে পড়ল। ১৯৪৫ সালে এই জায়গায় সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে নিয়ে একরাত কাটিয়েছিলাম। (পৃ-১৮৯)।
ভূক্তি-৬৫৩ পরের মাসে আবার তারিখ পড়ল। আমি আগের মত থানায় ফিরে এলাম। বাড়ি থেকে যারা এসেছিল তাদের মধ্যে মেয়েরা মামার বাড়ি। আর পুরুষরা নৌকায় থাকতেন। রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, ‘‘জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন, আমার কেউই নাই। তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে?’’ কেঁদেই ফেলল। আমি রেনুকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তাতে ফল হল উল্টো। আরও কাঁদতে শুরু করল, হাচু ও কামাল ওদের মা’র কাঁদা দেখে ছুটে যেয়ে গলা ধরে আদর করতে লাগল। আমি বললাম, ‘‘খোদা যা করে তাই হবে, চিন্তা করে লাভ কি ?’’ পরের দিন ওদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মাকে বোঝাতে অনেক কষ্ট হল। (পৃ-১৯০, ১৯১)।
ভূক্তি-৬৫৪ ফরিদপুর জেলে ফিরে এলাম। দেখি চন্দ্র বাবু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, অবস্থা খুবই খারাপ। তাঁর হার্নিয়ার ব্যারাম ছিল। পেটে চাপ দিয়েছিল। হঠাৎ নাড়ি উল্টে গেছে। ফলে গলা দিয়ে মল পড়তে শুরু করেছে। যে কোন সময় মারা যেতে পারেন। সিভিল সার্জন সাহেব খুব ভাল ডাক্তার। তিনি অপারেশন করতে চাইলেন। আত্মীয়স্বজন কেউ নাই যে, তাঁর পক্ষে থেকে অনুমতিপত্র লিখে দিবে। চন্দ্র ঘোষ নিজেই লিখে দিতে রাজি হলেন। বললেন, ‘‘কেউ যখন নাই তখন আর কি করা যাবে! ’’(পৃ-১৯১)।
ভূক্তি-৬৫৫ সিভিল সার্জন সাহেব বাইরের হাসপাতাল নিতে হুকুম দিলেন। চন্দ্র ঘোষ তাঁকে বললেন, ‘‘আমাকে বাইরের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার তো কেউ নাই। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে একবার দেখতে চাই; সে আমার ভাইয়ের মত। জীবনে তো আর দেখা হবে না”। (পৃ-১৯১)।
ভূক্তি-৬৫৬ চন্দ্র ঘোষ স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন। দেখে মনে হল, আর বাঁচবেন না; আমাকে দেখে কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, ‘‘ভাই এরা আমাকে ‘‘সাম্প্রদায়িক” বলে বদনাম দিল; শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়। কোনোদিন হিন্দু মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নাই। সকলকে আমায় ক্ষমা করে দিতে বোলো। আর তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইল মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখ। মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য ভগবানও করেন নাই। আমার তো কেউ নাই, আপন ভেবে তোমাকেই শেষ দেখা দেখে নিলাম। ভগবান তোমার মঙ্গল করুক”। এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে, সুপারিনটেনডেন্ট, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার, ডাক্তার ও গোয়েন্দা কর্মচারী সকলের চোখেই পানি এসে গিয়েছিল। আর আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। বললাম, ‘‘চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ”। (পৃ-১৯১)।
ভূক্তি-৬৫৭ শহীদ সাহেব ছিলেন সাগরের মত উদার। যে কোন লোক তাঁর কাছে একবার যেয়ে হাজির হয়েছে, সে যত বড় অন্যায়ই করুক না কেন, তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। (পৃ-১৯৪)।
ভূক্তি-৬৫৮ ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে মাওলানা ভাসানী ও আমি যখন জেলে, সেই সময় জনাব লিয়াকত আলী খানকে রাওয়ালপিন্ডিতে এক জনসভায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। (পৃ-১৯৫)।
ভূক্তি-৬৫৯ খাজা সাহেব বিরাট ভুল করে বসলেন। প্রধানমন্ত্রী হয়ে কিছুদিন পরে তিনি পূর্ব বাংলায় আসেন। প্রথমবার তিনি কিছুই বলেন নাই। কিছুদিন পরে। বোধহয় ১৯৫১ সালের শেষের দিকে অথবা ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় তিনি বক্তৃতা করলেন। সেখানে ঘোষণা করলেন, ‘‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে”। তিনি ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যে ওয়াদা করেছিলেন, সে ওয়াদার খেলাপ করলেন। (পৃ-১৯৬)।
ভূক্তি-৬৬০ আমি জেলে এসেই মহিউদ্দিনকে সকল কথা বললাম। মহিউদ্দিনও রাজি হল অনশন ধর্মঘট করতে। আমরা দুইজনে সরকারের কাছে পহেলা ফেব্রুয়ারি দরখাস্ত পাঠালাম। যদি ১৫ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমাদের মুক্তি দেওয়া না হয় তাহা হলে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট করতে শুরু করব। দুইখানা দরখাস্ত দিলাম। আমাকে যখন জেল কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করল অনশন ধর্মঘট না করতে তখন আমি বলেছিলাম, ছাব্বিশ-সাতাশ মাস বিনাবিচারে বন্দি রেখেছেন। কোনো অন্যায়ও করি নাই।
ঠিক করেছি জেলের বাইরে যাব। হয় আমি জ্যান্ত অবস্থায় না হয় মৃত অবস্থায় যাব। ÔÔEither I will go out of the jail or my deadbody will go out.’’(c„-197)|
ভূক্তি-৬৬১ জনগনের আস্থা হারাতে শুরু করেছিল বলে আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল মুসলিম লীগ নেতারা। মুসলিম লীগ সরকার জনমত যাতে তাদের দিকে থাকে তার চেষ্টা না করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগ এবং বিরুদ্ধ মতবাদের কর্মী ও নেতাদের উপর। যে কোন অজুহাতে নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। (পৃ-১৯৮)।
ভূক্তি-৬৬২ সুবেদার পাকিস্তান হওয়ার সময় গোপালগঞ্জে ছিল এবং সে একজন বেলুচি ভদ্রলোক। আমাকে খুবই ভালবাসত এবং শ্রদ্ধা করত। আমাকে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতে দেখেছে। আমাকে দেখেই বলে বসল, ‘‘ইয়ে কেয়া বাত হ্যায়, আপ জেলখানা মে”। আমি বললাম, ‘‘কিসমত”। আর কিছুই বললাম না। আমাদের জন্য বন্ধ ঘোড়ার গাড়ি আনা হয়েছে। গাড়ির ভিতর জানালা উঠিয়ে ও দরজার কপাট বন্ধ করে দিল। (পৃ-১৯৯)।
ভূক্তি-৬৬৩ নারায়নগঞ্জের কর্মীদের ত্যাগ ও তিতিক্ষার কথা কোনো রাজনৈতিক কর্মী ভুলতে পারে না। তারা আমাকে বলল, ‘‘২১ শে ফেব্রুয়ারি নারায়নগঞ্জে পূর্ণ হরতাল হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তো আছেই, আপনাদের মুক্তির দাবিও আমরা করব”। এখানেও নেতারা আমাকে প্রশ্ন করল, ‘‘মহিউদ্দিনকে বিশ্বাস করা যায় কি না! আবার বাইরে এসে মুসলিম লীগ করবে না তো?’’ আমি বললাম, ‘‘আমাদের কাজ আমরা করি, তার কর্তব্য সে করবে। তবে মুসলিম লীগ করবে না। সে সম্বন্ধে কোনে সন্দেহ নাই। সে বন্দি, তার মুক্তি চাইতে আপত্তি কি! মানুষকে ব্যবহার, ভালবাসা ও প্রীতি দিয়েই জয় করা যায়, অত্যাচার, জুলুম ও ঘৃণা দিয়ে জন করা যায় না”। (পৃ-২০০)।
ভূক্তি-৬৬৪ রাত এগারটায় আমরা স্টেশনে আসলাম। জাহাজ ঘাটেই ছিল, আমরা উঠে পড়লাম। জাহাজ না ছাড়া পর্যন্ত সহকর্মীরা অপেক্ষা করল। রাত একটার সময় সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বললাম, ‘‘জীবনে আর দেখা না হতেও পারে। সকলে যেন আমাকে ক্ষমা করে দেয়। দুঃখ আমার নাই। একদিন মরতেই হবে, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যদি মরতে পারি, সে মরাতেও শান্তি আছে”। (পৃ-২০০)।
ভূক্তি-৬৬৫ আমরা জেলের দিকে রওয়ানা করছি, এমন সময় আওয়ামী লীগের এক কর্মী, তার নামও মহিউদ্দিন-সকলে মহি বলে ডাকে, তার সাথে দেখা। আমি যখন ফরিদপুরে ১৯৪৬ সালের ইলেকশনে ওয়ার্কার ইনচার্জ ছিলাম। তখন আমার সাথে সাথে কাজ করেছে। মহি সাইকেলে যাচ্ছিল, আমি তাকে দেখে ডাক দিলাম নাম ধরে, সে সাইকেল থেকে আমাকে দেখে এগিয়ে আসল। আইবি নিষেধ করছিল। আমি শুনলাম না; তাকে এক ধমক দিলাম এবং মহিকে বললাম, আমাদের ফরিদপুর জেলে এনেছে এবং আজ থেকে অনশন করছি সকলকে এ খবর দিতে। আমরা জেলগেটে চলে আসলাম, মহিও সাথে সাথে আসল। (পৃ-২০১)।
ভূক্তি-৬৬৬ আমাদের তাড়াতাড়ি ভিতরে নিয়ে যেতে বললেন। আমরা তাড়াতাড়ি ঔষধ খেলাম পেট পরিস্কার করার জন্য। তারপর অনশন ধর্মঘট শুরু করলাম। দুইদিন পর অবস্থা খারাপ হলে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। আমাদের দুইজনেরই শরীর খারাপ। মহিউদ্দিন ভুগছে প্লুরিসিম রোগে, আর আমি ভুগছি নানা রোগে। চার দিন পরে আমাদের নাক দিয়ে জোর করে খাওয়াতে শুরু করল। মহাবিপদ! নাকের ভিতর নল দিয়ে পেটের মধ্যে পর্যন্ত দেয়। তারপর নলের মুখে একটা কাপের মত লগিয়ে দেয়। একটা ছিদ্রও থাকে। সে কাপের মধ্যে দুধের মত পাতলা করে খাবার তৈরি করে পেটের ভিতর ঢেলে দেয়। এদের কথা হল, ‘‘মরতে দেব না”। (পৃ-২০১)।
ভূক্তি-৬৬৭ আমাদের শরীরও খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। পাঁচ-ছয় দিন পরে বিছানা থেকে উঠার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের ওজনও কমতে ছিল। বার বার সিভিল সার্জন সাহেব অনশন করতে নিষেধ করছিলেন। আমার ও মহিউদ্দিনের শরীর অতিশয় দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন আর বিছানা থেকে উঠাবার শক্তি নাই। আমার হার্টের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে বুঝতে পারলাম। প্যালপিটিশন হয় ভীষণ ভাবে। নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। ভাবলাম আর বেশি দিন নাই। একজন কয়েদিকে দিয়ে গোপনে কয়েক টুকরা কাগজ আনলাম। যদিও হাত কাঁপে তথাপি ছোট ছোট করে চারটি চিঠি লিখলাম। আব্বার কাছে একটা, রেণুর কাছে একটা, আর দুইটা শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবের কাছে। দু’একদিন পরে আর লেখার শক্তি থাকবে না। (পৃ-২০১)।
ভূক্তি-৬৬৮ ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম; রাতে সিপাহিরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা যেছে। ফরিদপুরে হরতাল হয়েছে; ছাত্র ছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেলগেটে এসেছিল। তারা স্লোগান দিচ্ছিল, ‘‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’’, “বাঙ্গালিদের শোষন করা চলবে না’’, ‘‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই”; ‘‘রাজবন্দিদের মুক্তিচাই” আরও অনেক স্লোগান। (পৃ-২০৩)
ভূক্তি-৬৬৯ আমাদের অবস্থা এমন পর্যায়ে এসেছে যে, যে কোনো মূহূর্তে মৃত্যুর শান্তি ছায়ায় চিরদিনের জন্য স্থান পেতে পারি। সিভিল সার্জন সাহেব দিনের মধ্যে পাঁচ-সাতবার আমাদের দেখতে আসেন। ২৫ তারিখ সকালে যখন আমাকে তিনি পরীক্ষা করছিলেন হঠাৎ দেখলাম, তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে। তিনি কোনো কথা না বলে, মুখ কালো করে বেরিয়ে গেলেন। আমি বুঝলাম, আমার দিন ফুরিয়ে গেছে। কিছু সময় পরে আবার ফিরে এসে বললেন, ‘‘এভাবে মৃত্যুবরণ করে কি কোনো লাভ হবে? বাংলাদেশ যে আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে”। (পৃ-২০৪)
ভূক্তি-৬৭০ ডেপুটি জেলার সাহেব বললেন, ‘‘কাউকেও খবর দিতে হবে কি না ?আপনার ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী কোথায়? আপনার আব্বার কাছে কোনো টেলিগ্রাম করবেন ? ’’ বললাম, ‘‘দরকার নাই”। আর তাদের কষ্ট দিতে চাই না”। আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি, হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। হার্টের দুর্বলতা না থাকলে এত তাড়াতাড়ি দুর্বল হয়ে পড়তাম না। একজন কয়েদি ছিল আমার হাত-পায়ে সরিষার তেল গরম করে মালিশ করতে শুরু করল। মাঝে মাঝে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। (পৃ-২০৪, ২০৫)।
ভূক্তি-৬৭১ মহিউদ্দিনের অবস্থাও ভাল না, কারণ প্লুরিসিম আবার অক্রমন শুরু করেছে। আমার চিঠি চারখানা একজন কর্মচারীকে ডেকে তাঁর কাছে দিয়ে বললাম, আমার মৃত্যুর পরে চিঠি চারখানা ফরিদপুরে আমার এক আত্বীয়ের কাছে পৌঁছে দিতে। তিনি কথা দিলেন আমি তাঁর কাছে থেকে ওয়াদা নিলাম। বার বার আব্বা, মা, ভাইবোনের চেহারা ভেসে আসছিল আমার চোখের সামনে। রেণুর দশা কি হবে ? তার তো কেউ নাই দুনিয়ায়। ছোট ছেলেমেয়ে দুইটার অবস্থাই বা কি হবে? তবে আমার আব্বা ও ছোট ভাই ওদের ফেলবে না। এ বিশ্বাস আমার ছিল। (পৃ-২০৫)।
ভূক্তি-৬৭২ ২৭ তারিখ রাত আটটার সময় আমরা দুইজন চুপচাপ শুয়ে আছি। কারও সাথে কথা বলার ইচ্ছাও নাই, শক্তিও নাই। দুইজনেই শুয়ে শুয়ে কয়েদির সাহায্যে ওজু করে খোদার কাছে মাপ চেয়ে নিয়েছি। ডেপুটি জেলার আমার কাছে এসে বসলেন এবং বললেন, ‘‘আপনাকে যদি মুক্তি দেওয়া হয়, তবে খাবেন তো ?’’ বললাম, ‘‘মুক্তি দিলে খাব, না দিলে খাব না। তবে আমার লাশ মুক্তি পেয়ে যাবে”। ডেপুটি জেলার সাহেব বললেন, ‘‘আমি পড়ে শোনাই, আপনার মুক্তির অর্ডার এসে গেছে রেডিওগ্রামে এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অফিস থেকেও অর্ডার এসেছে। দুইটা অর্ডার পেয়েছি”। তিনি পড়ে শোনালেন, আমি বিশ্বাস করতে চাইলাম না, মহিউদ্দিন শুয়ে শুয়ে অর্ডারটা দেখাল এবং বলল যে, তোমার অর্ডার এসেছে। আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। ডাক্তার সাহেব ডাবের পানি আনিয়েছেন। মহিউদ্দিনকে দুইজন ধরে বসিয়ে দিলেন। সে আমাকে বলল, ‘‘তোমাকে ডাবের পানির আমি খাইয়ে দিব”। দুই চামচ ডাবের পানি দিয়ে মহিউদ্দিন আমার অনশন ভাঙ্গিয়ে দিল। মহিউদ্দিনের কোনো অর্ডার আসে নাই এখনও। এটা আমার আরও পীড়া দিতে লাগল। ওকে ছেড়ে যাব কেমন করে ? রাত কেটে গেল। সকালে একটু খেলেও ডাব খেতে দিল। আমি অনেকটা সুস্থ বোধ করতে লাগলাম, কিন্তু মহিউদ্দিনকে ফেলে যাব কেমন করে ? দু’জন একসাথে ছিলাম। আমি চলে গেলে ওর উপায় কি হবে, কে দেখবে ? যদি ওকে না ছোড়ে !(পৃ-২০৫, ২০৬)।
ভূক্তি-৬৭৩ সকাল দশটার দিকে খবর পেলাম, আব্বা এসেছেন। জেলগেটে আমাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই কর্তৃপক্ষ তাঁকে ভিতরে নিয়ে আসলেন। আমাকে দেখেই আবার চোখে পানি এসে গেছে। আব্বার সহ্য শক্তি খুব বেশি। কোনোমতে চোখের পানি মুছে ফেললেন। কাছে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং বললেন, ‘‘তোমার মুক্তির আদেশ হয়েছে, তোমাকে আমি নিয়ে যাব বাড়িতে। আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম তোমার মা, রেণু, হাচিনা, ও কামালকে নিয়ে, দুই দিন বসে রইলাম, কেউ খবর দেয় নাই তোমাকে কোথায় নিয়ে গেছে। তুমি ঢাকায় নাই একথা জেলগেট থেকে বলেছে। যদিও পরে খবর পেলাম, তুমি ফরিদপুর জেলে আছ। তোমার মা ও রেণুকে ঢাকায় রেখে আমি চলে এসেছি। আব্বা আমাকে সান্ত¡না দিলেন এবং বললেন, তিনি খবর পেয়েছেন মহিউদ্দিনও মুক্তি পাবে তবে এক সাথে ছাড়বে না, একদিন পরে ছাড়বে। (পৃ-২০৬)।
ভূক্তি-৬৭৪ পরের দিন আব্বা আমাকে নিতে আসলেন। অনেক লোক জেলগেটে হাজির। আমাকে স্ট্রেচারে করে জেলগেট নিয়ে যাওয়া হল এবং গেটের বাইরে রেখে দিল, যদি কিছু হয় বাইরে হোক; এই তাদের ধারনা। (পৃ-২০৬)।
ভূক্তি-৬৭৫ পাঁচদিন পর বাড়ি পৌঁছালাম। মাকে তো বোঝানো কষ্টকর। হাচু আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, ‘‘আব্বা, রাষ্টভাষা বাংলা চাই; রাজবন্দিদের মুক্তি চাই”। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল, যা শুনেছে তাই বলে চলেছে। কামাল আমার কাছে আসল না, তবে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি খুব দুর্বল, বিছানায় শুয়ে রইলাম। গতকাল রেণু ও মা ঢাকা থেকে বাড়ি এসে আমার প্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছিল। এক এক করে সকলে যখন আমার কামরা থেকে বিদায় নিল, তখন রেণু কেঁদে ফেলল এবং বলল, ‘‘তোমার চিঠি পেয়ে আমি বুঝেছিলাম, তুমি কিছু একটা করে ফেলবা। আমি তোমাকে দেখবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাকে বলব নিয়ে যেতে, আব্বাকে বলতে পারিনা লজ্জায়। নাসের ভাই বাড়ি নাই। যখন খবর পেলাম খবরের কাগজে, তখন লজ্জা শরম ত্যাগ করে আব্বাকে বললাম। আব্বা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাই রওয়ানা করলাম ঢাকায়, সোজা আমাদের বড় নৌকায় তিনজন মাল্লা নিয়ে। কেন তুমি অনশন করতে গিয়েছিলে ? এদের কি দয়া মায়া আছে? আমাদের কারও কথাও তোমার মনে ছিল না? কিছু একটা হলে কি উপায় হত? আমি এই দুইটা দুধের বাচ্চা নিয়ে কি করে বাঁচতাম? হাচিনা, কামালের অবস্থা কি হত? তুমি বলবা, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট তো হত না? মানুষ কি শুধু খাওয়া পরা নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়? আর মরে গেলে দেশের কাজই বা কিভাবে করতা ?’’ আমি তাকে কিছুই বললাম না। তাকে বলতে দিলাম, কারণ মনের কথা প্রকাশ করতে পারলে ব্যথাটা কিছু কমে যায়। রেণু খুব চাপা, আজ যেন কথার বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। শুধু বললাম, ‘‘উপায় ছিল না”। বাচ্চা দুইটা ঘুমিয়ে পড়েছে। শুয়ে পড়লাম। সাতাশ-আঠাশ মাস পরে আমার সেই পুরানা জায়গায়, পুরানা কামরায়, পুরানা বিছানায় শুয়ে কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠের দিনগুলি কথা মনে পড়ল। ঢাকার খবর সবই পেয়েছিলাম। মহিউদ্দিনও মুক্তি পেয়েছে। পরের দিন সকালে আব্বা ডাক্তার আনলেন। ডাক্তার সকলকে বললেন, আমাকে যেন বিছানা থেকে উঠতে না দেওয়া হয়। (পৃ-২০৭)।
ভূক্তি-৬৭৬ একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘‘আব্বা” ‘‘আব্বা” বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি’’। আমি আর রেণু দু’জনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘‘আমি তো তোমারও আব্বা”। কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেকদিন না দেখলে ভুলে যায়। আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়-স্বজন ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় যঘন্য কাজ তা কে বুঝবে ? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। আজ দুইশত বৎসর পরে আমরা স্বাধীন হয়েছি। সামান্য হলেও কিছুটা আন্দোলন করেছি স্বাধীনতার জন্য। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস আজ আমাকে ও আমার সহকর্মীদের বছরের পর বছর জেল খাটতে হচ্ছে। আরও কতকাল খাটতে হয়, কেইবা জানে? একেই কি বলে স্বাধীনতা? (পৃ-২০৯)।
ভূক্তি-৬৭৭ গোপালগঞ্জ মাহকুমায় যে কেউ আসে, তাদের এক প্রশ্ন, ‘‘আপনাকে কেন জেলে নেয় ? আপনিই তো আমাদের পাকিস্তানের কথা শুনিয়েছেন”। আবার বলে, ‘‘কত কথা বলেছিলেন; পাকিস্তান হলে কত উন্নতি হবে। জনগন সুখে থাকবে, অত্যাচার জুলুম থাকবে না। কয়েক বছর হয়ে গেল দুঃখই তো আরও বাড়ছে; কমার লক্ষন তো দেখছি না। চাউলের দাম কত বেড়ে গেছে”। কি উত্তর দেব! এরা সাধারণ মানুষ। কি করে এদের বোঝাব ! (পৃ-২০৯)।
ভূক্তি-৬৭৮ ১৯৫২ সালে ঢাকায় গুলি হওয়ার পরে গ্রামে গ্রামে জনসাধারণ বুঝতে আরম্ভ করেছে যে, যারা শাসন করছে তারা জনগনের আপনজন নয়। খবর নিয়ে জানতে পারলাম, ২১ শে ফেব্রুয়ারি গুলি হওয়ার খবর বাতাসের সাথে সাথে গ্রামে গ্রামে পৌঁছে গেছে এবং ছোট ছোট হাট-বাজারে পর্যন্ত হরতাল হয়েছে। মানুষ বুঝতে আরম্ভ করেছে যে, বিশেষ একটা গোষ্ঠী (দল) বাঙ্গালিদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। (পৃ-২০৯)।
ভূক্তি-৬৭৯ মার্চ মাস পুরাটাই আমাকে বাড়িতে থাকতে হল। শরীরটা একটু ভাল হয়েছে, কিন্তু হার্টের দুর্বলতা আছে। আব্বা আমাকে ছাড়তে চান না। ডাক্তারও আপত্তি করে। রেণুর ভয় ঢাকায় গেলে আমি চুপ করে থাকব না, তাই আবার গ্রেফতার করতে পারে। আমার মন রয়েছে ঢাকায়, নেতারা ও কর্মীরা সকলেই জেলে। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা গোপনে সভা করতে যেয়ে সকলে একসাথে গ্রেফতার হয়ে গেছে। লীগ সরকার অত্যাচরের স্টিমরোলার চালিয়ে দিয়েছে। যা কিছুই হোক না কেন বসে থাকা চলবে না। (পৃ-২১০)।
ভূক্তি-৬৮০ এই সময় মানিক ভাইয়ের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। তিনি আমাকে অতিসত্বর ঢাকায় যেতে লিখেছেন। চিকিৎসা ঢাকায়ই করা হবে এবং ঢাকায় বসে থাকলেও কাজ হবে। আমি আব্বাকে চিঠিটা দেখালাম। আব্বা চুপ করে থাকলেন কিছু সময়। তারপর বললেন, যেতে চাও যেতে পার। রেণুও কোনো আপত্তি করল না। টাকা পয়সারও দরকার। খবর পেয়েছি, আমার বিছানা পত্র কাপড়চোপড় কিছুই নেই। আবার নতুন করে সকল কিছু কিনতে হবে। আব্বাকে বললাম, খাট, টেবিল-চেয়ার, বিছানাপত্র সকল কিছুই নতুন করে কিনতে হবে। আমার কিছু টাকার দরকার। কয়েক মাসের খরচও লাগবে। ঢাকা থেকে অবদুল হামিদ চৌধুরী ও মোল্লা জালাল উদ্দিন খবর দিয়েছে তাঁতীবাজারে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছে। আমি তাদের কাছে উঠতে পারব। ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে আর উঠতে চাই না। কারণ সেখানে এত লোক আসে যায় যে, নিজের বলতে কিছুই থাকে না। (পৃ-২১০)।
ভূক্তি-৬৮১ রেণুও কিছু টাকা আমাকে দিল গোপনে। আব্বার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা করলাম; এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। হাচিনা ও কামাল আমাকে ছাড়তে চায় না; ওদের উপর আমার খুব দুর্বলতা বেড়ে গেছে। রওয়ানা করার সময় দুই ভাই-বোন খুব কাঁদল। আমি বরিশাল হয়ে ঢাকায় পৌঁছালাম।
শামসুল হক সাহেব আওয়ামী লীগের অফিস নবাবপুর নিয়ে এসেছেন। এই বাড়ির দুইটা কামরায় মানিক ভাই তাঁর ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কিছুদিন ছিলেন। মানিক ভাই, আতাউর রহমান সাহেব ও আরও অনেকের সাথে দেখা করলাম। ডাক্তার নন্দীর কাছে যেয়ে নিজেকে দেখালাম। তিনি ঔষধ লিখে দিলেন। (পৃ-২১০, ২১১)।
ভূক্তি-৬৮২ শহীদ সাহেব যখন এসেছিলেন, তাঁর এক ভক্তের কাছ থেকে একটা টাইপ রাইটিং মেশিন নিয়ে অফিসের জন্য দিয়ে গিয়েছিলাম। এই সময় একজন এডভোকেট আমাদের অফিসে আসলেন। তিনি বললেন, ‘‘আমি আপনাদের দলের সভ্য হতে চাই। আমার দ্বারা বেশি কাজ পাবেন না, তবে অফিসের কাজ আমি বিকালে এসে করে দিতে পারি”। আমি খুব খুশিই হলাম। ভদ্রলোক আস্তে আস্তে কথা বলেন, আমার বয়সীই হবেন। আমার খুব পছন্দ হল। (পৃ-২১১)।
ভূক্তি-৬৮৩ যা হোক, দুই তিনিটা জেলা ছাড়া জেলা কমিটিও গঠন হয় নাই। প্রতিষ্ঠান গড়ার সুযোগ এসেছে। সহস করে কাজ করে যেতে পারলে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। কারণ, জনগন এখন মুসলিম লীগ বিরোধী হয়ে গেছে। আর, আওয়ামী লীগ এখন একমাত্র বিরোধী দল, যার আদর্শ আছে এবং নীতি আছে। তবে সকলের চেয়ে বড় অসুবিধা হয়েছে টাকার অভাব। (পৃ-২১২)।
ভূক্তি-৬৮৪ এদিকে মুসলিম লীগের কাগজগুলি শহীদ সাহেবের বিবৃতি এমনভাবে বিকৃত করে ছাপিয়েছে যে মনে হয় তিনিও উর্দ্ধুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হোক এটাই চান। আমি সাধারণ সম্পাদক হয়েই একটা প্রেস কনফারেন্স করলাম। তাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে এবং ২১ শে ফেব্রুয়ারি শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দান এবং যারা অন্যায় ভাবে জুলুম করেছে তাদের শাস্তির দাবি করলাম। (পৃ-২১২)।
ভূক্তি-৬৮৫ আমি যথাসময়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা সাহেবের সাথে দেখা করতে তাঁর অফিসে হাজির হলাম। আমাকে খাজা সাহেব তাঁর কামরায় নিজে এগিয়ে এসে নিয়ে বসলেন। যতেষ্ট ভদ্রতা করলেন, আমার শরীর কেমন? আমি কেমন আছি; কতদিন থাকব-এই সব জিজ্ঞাসা করলে। আমি তাঁকে অনুরোধ করলাম, ‘‘মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক, আবুল হাশিম সহ সমস্ত কর্মীকে মুক্তি দিতে। আরও বললাম, জুুডিশিয়াল ইনকোয়ারি বসতে, কেন গুলি করে ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছিল। তিনি বললেন, ‘‘এটা প্রাদেশিক সরকারের হাতে, আমি কি করতে পারি ? ‘‘আমি বললাম, ‘‘আপনি মুসলিম লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, আর পূর্ব বাংলায়ও মুসলিম লীগ সরকার, আপনি নিশ্চয়ই তাদের বলতে পারেন। আপনি তো চান না যে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হোক, আর আমরাও চাই না। আমি করাচি পর্যন্ত এসেছি আপনার সাথে দেখা করতে, এজন্য যে প্রাদেশিক সরকারের কাছে দাবি করে কিছুই হবে না। তারা যে অন্যায় করেছে সেই অন্যায়কে ঢাকবার জন্য আরও অন্যায় করে চলেছে’’। তিনি বিশ মিনিটের জায়গায় আমাকে এক ঘন্টা সময় দিলেন। আমি তাঁকে বললাম যে, ‘‘আওয়ামী লীগ বিরোধী পার্টি। তাকে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত। বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না। আপনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তা আমি জানি”। তিনি স্বীকার করলেন, আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দল। আমি তাঁকে বললাম, ‘‘আওয়ামী লীগ বিরোধী দল আপনি স্বীকার করে নিয়েছেন। একথা আমি খবরের কাগজে দিতে পারি কি না ?’’ তিনি বললেন, ‘‘নিশ্চয়ই দিতে পার”। তিনি আমাকে বললেন প্রদেশের কোন কাজে তিনি হস্তেক্ষেপ করেন না, তবে তিনি চেষ্টা করে দেখবেন কি করতে পারেন। আমি তাঁকে আদাব করে বিদায় নিলাম। তিনি যে আমার কথা ধৈর্য্য ধরে শুনেছেন এজন্য তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। দুই দিন পরে প্রেস কনফারেন্স করলাম। (পৃ-২১৩, ২১৪)।
ভূক্তি-৬৮৬ প্রায় দুই ঘন্টা প্রেস কনফারেন্স চলেছিল। পাকিস্তান টাইমস ও ইমরোজ খুব ভালভাবে ছাফিয়েছিল আমার প্রেস কনফারেন্সের জবাব গুলি। (পৃ-২১৪)
ভূক্তি-৬৮৭ আমি এই প্রথম করাচি দেখলাম; ভাবলাম এই আমাদের রাজধানী! বাঙ্গালিরা কয়জন তাদের রাজধানী দেখার সুযোগ পাবে! আমরা জন্ম গ্রহণ করেছি সবুজের দেশে, যেদিকে তাকানো যায় সবুজের মেলা। মরুভূমির এই পাষাণ বালু আমাদের পছন্দ হবে কেন? প্রকৃতির সাথে মুনষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মত উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির মানুষের মন ঐ রকমই নরম, ঐ রকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপন সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যই আমরা ভালবাসি। (পৃ-২১৪, ২১৫)।
ভূক্তি-৬৮৮ মঞ্জুর তার জিপে করে আমাকে নিয়ে হায়দ্রাবাদ চলল। কিছুদূর যাওয়ার পরই মরুভূমি চোখে পড়ল। অনেক মাইল পর্যন্ত বাড়িঘর নাই। মাঝে মাঝে দু’একটা ছোট ছোট বাজারের মত। দেখলাম, সামান্য কয়েকজন লোক বসে আছে। মঞ্জুরকে বললাম, ‘‘তোমরা এই মরুভূমিতে থাক কি করে?’’ উত্তর দিল, ‘‘বাধ্য হয়ে। মোহাজের হয়ে এসেছি; এই তো আমাদের বাড়িঘর, এখানেই মরতে হবে। দিল্লি তো তুমি দেখছ, এ রকম মরুভূমি তুমি দেখ নাই ? প্রথম প্রথম খারাপ লেগেছিল, এখন সহ্য হয়ে গেছে। আমরা মোহাজেররা এসেছি, ভবিষ্যতে আসলে দেখ করাচিকেও আমরা ফুলে ফলে ভরে ফেলব”। (পৃ-২১৫)।
ভূক্তি-৬৮৯ আমরা বিকালে পৌঁছালাম। মঞ্জুর নিজেই ড্রাইভ করছিল। সে চমৎকার গাড়ি চালাতে পারে। মঞ্জুরের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। অনেক উথ্যান-পতন হয়েছে, বন্ধুত্ব যায় নাই। পরে যতবার করাচি গিয়েছি, ছায়ার মত আমার কাছেই রয়েছে। যাহোক, সোজা ডাকবাংলোতে পৌঁছালাম। শহীদ সাহেব বাইরে গেছেন, রাতে ফিরবেন। রাত দশটায় তিনি ফিরলেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘‘খুব প্রেস কনফারেন্স করছ পশ্চিম পাকিস্তানের এসে”। বললাম, ‘‘কি আর করি!’’ আমি হায়দ্রাবাদ আসব তিনি জানতেন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত আলোচনা হল। তিনি পূর্ব বাংলার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। বললাম, রাষ্ট্রভাষা সম্বন্ধে তাঁর মতামত খবরের কাগজে বের হয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কি বের হয়েছে ? ’’ আমি বললাম, ‘‘আপনি নাকি কোন রিপোর্টারকে বলেছেন যে, উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত”। তিনি ক্ষেপে গেলেন এবং বললেন, ‘‘এ কথা তো আমি বলি নাই। উর্দু ও বাংলা দুইটা হলে আপত্তি কি? একথাই বলেছিলাম”। আরও জানালেন যে, গুলি ও অত্যাচারের প্রতিবাদও তিনি করেছেন। আমি তাঁকে জানালাম, ‘‘সে সব কথা কোনো কাগজে পরিস্কার করে ছাপান হয় নাই। পূর্ব বাংলার জনসাধারণ আপনার মতামত না পেয়ে খুবই দুঃখিত হয়েছে”। তিনি আমাকে পরের দিন বিকালে আসতে বললেন, কারণ সকালে কোর্ট আছে। ‘‘পিন্ডি ষড়যন্ত্র” মামলার বিচার হায়দ্রাবাদ জেলের ভিতরে হচ্ছে। (পৃ-২১৫)
ভূক্তি-৬৯০ দু’টার সময় আমি মালপত্র নিয়ে শহীদ সাহেবের কাছে চলে আসলাম। শহীদ সাহেব কয়েক খানা বিস্কুট ও হরলিক্স খেলেন। এই তাঁর দুপুরের খাওয়া। এক এডভোকেট পেশোয়ার থেকে এসেছিল, অন্য এক আসামীর পক্ষে। রাতে শহীদ সাহেব তাকে এবং আমাকে নিয়ে খানা খান। আমি বললাম, ‘‘এভাবে চলে কি করে ?’’ তিনি বললেন, ‘‘বিস্কুট, মাখন, রুটিও আছে, এই খেয়েই যায় দুপুর বেলা”। কোনো লোকজনও নাই। নিজেই সকল কিছু করেন। আমরা আবার আলাপ শুরু করলাম। তিনি বললেন, ‘‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কোনো এফিলিয়েশন নেয় নাই। আমি তো তোমাদের কেউ নই”। আমি বললাম, ‘‘প্রতিষ্ঠান না গড়লে কার কাছ থেকে এফিলিয়েশন নেব। আপনি তো আমাদের নেতা আছেনই। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ আপনাকে তো নেতা মানে, এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের জনগনও আপনাকে সমর্থন করে”। তিনি বললেন, ‘‘একটা কনফারেন্স ডাকব, তার আগে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এফিলিয়েশন নেওয়া দরকার”। (পৃ-২১৬)।
ভূক্তি-৬৯১ আমি বললাম, ‘‘আপনার হাতের লেখা থাকলে কেউই আর আপত্তি করবে না। মাওলানা সাহেবের সাথে জেলে আমার কথা হয়েছিল। তাতে আমাদের ম্যানিফেস্টো, নাম ও গঠনতন্ত্র মেনে নিলে এফিলিয়েশন নিতে তাঁর আপত্তি নাই”। আমি আর একটা অনুরোধ করলাম, তাঁকে লিখে দিতে হবে যে, উর্দু ও বাংলা দুইটাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে তিনি সমর্থন করেন। কারণ অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। মুসলিম লীগ ও তথাকথিত প্রগতিবাদীরা প্রপাগান্ডা করছেন তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি বললেন, ‘‘নিশ্চয়ই লিখে দেব, এটা তো আমার নীতি ও বিশ্বাস”। তিনি লিখে দিলেন। মামলা শেষ হলেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানে আসবেন, কথা দিলেন। বললেন, ‘‘একমাস থাকবেন এবং প্রত্যেকটা জেলায় একটা করে সভার ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘পিন্ডি ষয়যন্ত্র মামলা সত্য কি না ? আসামীদের রক্ষা করতে পারবেন কি না ? আর ষড়যন্ত্র করে থাকলে তাদের শস্তি হওয়া উচিত কি না ?’’ তিনি বললেন, ‘‘ওসব প্রশ্ন কর না, আমি কিছুই বলব না, কারণ এডভোকেটদের শপথ নিতে হয়েছে, কোন কিছু কাউকেও না বলতে এ মামলা সম্বন্ধে”। তিনি একটু রাগ করেই বললেন, আমি চুপ করে গেলাম। (পৃ-২১৬, ২১৭)
ভূক্তি-৬৯২ বিকালে করাচি রওয়ানা করলাম, শহীদ সাহেব নিজে গাড়ি চালালেন, আমি তাঁর পাশেই বসা। পিছনে আরও কয়েকজন এডভোকেট বসলেন। রাস্তায় এডভোকেট সাহেবরা আমাকে পূর্ব বাংলার অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। বাংলা ভাষাকে কেন আমরা রাষ্ট্রভাষা করতে চাই? আমি তাঁদের বুঝাতে চেষ্টা করলাম। শহীদ সাহেবও তাঁদের বুঝিয়ে বললেন এবং হিন্দুদের কথা যে সরকার বলছে, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা তা তিনিই তাঁদের ভাল করে বুঝিয়ে দিলেন। আমার কাছে তাঁরা নজরুল ইসলামের কবিতা শুনতে চাইলেন। আমি তাঁদের “কে বলে তোমায় ডাকাত বন্ধু”; ‘‘নারী”, “সাম্য, -আরও কয়েকটি কবিতার কিছু কিছু অংশ শুনালাম। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতাও দু’একটার কয়েক লাইন শুনালাম। শহীদ সাহেব তাঁদের ইংরেজি করে বুঝিয়ে দিলেন। আমাদের সময় কেটে গেল। আমরা সন্ধ্যারাতেই করাচি পৌঁছালাম। শহীদ সাহেব আমাকে ওসমানী সাহেবের বাড়িতে নামিয়ে দিলেন এবং সকালে ১১ নম্বর করাচি রোডে যেতে বললেন। (পৃ-২১৭)।
ভূক্তি-৬৯৩ তাঁর সাথে দেখা করতে গেলে তিনি বললেন, আমাকে লাহোর হয়ে ঢাকায় যেতে। তিনি লাহোরে খাজা আবদুর রহিম বার-এট-ল এবং রাজা হাসান আখতারকে টেলিগ্রাম করে দিবেন বললেন। লাহোরেও প্রেস কনফারেন্স করতে এবং কর্মীদের সাথে আলোচনা করতে বললেন। অনেক দিন হয়ে গেছে, দেরি না করে আমি লাহোরে রওয়ানা করলাম। খানা আবদুর রহিম পূর্বে আইসিএস দিলেন (তখন ওকালতি করেন), খুবই ভদ্রলোক। আমাকে তাঁর কাছে রাখলেন, ‘‘জাভেদ মঞ্জিলে”। তিনি জাভেদ মঞ্জিলে থাকতেন। ‘‘জাভেদ মঞ্জিল” কবি আল্লামা ইবালের বাড়ি। কবি এখানেই বসেই পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আল্লামা শুধু কবি ছিলেন না, একজন দর্শনিকও ছিলেন। আমি প্রথমে তাঁর মাজার জিয়ারত করতে গেলাম এবং নিজেকে ধন্য মনে করলাম। আল্লামা যেখানে বসে সাধনা করেছেন সেখানে থাকার সুযোগ পেয়েছি! (পৃ-২১৭)।
ভূক্তি-৬৯৪ খাজা সাহেব ও লাহোরের শহীদ সাহেবের ভক্তরা প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করলেন। আমার বক্তব্য পেশ করার পরে আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, আমি তাঁদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পেরেছিলাম। আমরা যে উর্দু ও বাংলা দু’টাই রাষ্ট্রভাষা চাই, এ ধারণা তাঁদের ছিল না। তাঁদের বল হয়েছে শুধু বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবী করছি আমরা। লাহোরের আওয়ামী লীগ নেতারা আমাকে অনেক ধন্যবাদ দিলেন। আমি তাঁদের বললাম, আমি মুখে যা বলি তাই বিশ্বাস করি। আমার পেটে আর মুখে এক কথা। আমি কথা চাবাই না, যা বিশ্বাস করি বলি। সে জন্য বিপদেও পড়তে হয়, এটা আমার স্বভাবের দোষও বলতে পারেন, গুনও বলতে পারেন। একটা কথা লাহোরে পরিস্কার করে বলে এসেছিলাম, ইলেকশন হলে খবর পাবেন মুসলিম লীগের অবস্থা। তারা এমনভাবে পরাজিত হবে যা অপনারা ভাবতেও পারবেন না। (পৃ-২১৭, ২১৮)।
ভূক্তি-৬৯৫ এক বিপদ হল, সাতদিন পরে একদিন প্লেন লাহোর থেকে ঢাকায় আসে। তিন দিন পরে যে প্লেন ছাড়বে সে প্লেনে যাওয়ার উপায় নাই। কাজ শেষ হয় নাই। পরের সপ্তাহেও প্লেন যাবে না, শুনলাম প্রায় সতের-আঠার দিন আমাকে লাহোরে থাকতে হবে। খাজা আবদুর রহিম ও রাজা হাসান আখতার রাওয়ালপিন্ডি ও মারী বেড়াতে যাবেন। আমাকেও যেতে বললেন। আমি রাজি হলাম। একদিন রাওয়ালপিন্ডিতে দেরি করে দেখে নিলাম আমাদের মিলিটারি হেডকোয়াটার্স, আরও দেখলাম সেই পার্ক- যে পার্কে লিয়াকত আলী খানকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। পরের দিন সকালে মারী পৌঁছালাম। মারীতে রীতিমত শীত। গরম কাপড় প্রয়োজন, রাতে কম্বলের দরকার হয়েছিল। রাওয়ালপিন্ডির গরমে আমার মুখ আগুনে পুড়লে যেমন গোটা গোটা হয়, তাই দু’একটা হয়েছিল। মারী পিন্ডি থেকে মাত্র ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে, কিন্তু কি সুন্দর অবহাওয়া ! বড় আরাম লাগল। পাহাড়ের উপর ছোট্ট শহর। পাঞ্জাবের বড় বড় জমিদার ও ব্যবসায়ীদের অনেকের নিজেদের বাড়ি আছে। গরমের সময় ছেলে মেয়ে নিয়ে মারীতে থাকেন। আমার খুব ভাল লাগল। সবুজে ঘেরা পাহাড়গুলি, তার উপর শহরটি। একদিন থাকলাম, ইচ্ছা হয়েছিল আরও কিছুদিন থাকি। পরের দিনই আমাদের চলে আসতে হল। লাহোরে পীর সালাহউদ্দিন আমার সাথী ছিলেন। তাঁকে নিয়ে ঘোরাফেরা করতাম। নওয়াই ওয়াক্ত, পাকিস্তান টাইমস, ইমরোজ ও অন্য কাগজে আমার প্রেস কনফারেন্সের বক্তব্য খুব ভালো ভাবে ছাপিয়েছিল। সরকার সমর্থক কাগজগুলো আমার বক্তব্যের বিরুদ্ধে সমালোচনাও করেছিল। আমি রাষ্ট্রভাষা বাংলা, রাজবন্দিদের মুক্তি, গুলি করে হত্যার প্রতিবাদ, স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক সমস্যার উপর বেশি জোর দিয়ে ছিলাম। (পৃ-২১৮)
ভূক্তি-৬৯৬ লাহোর থেকে প্লেনে ঢাকা আসলাম। তখন সোজা করাচি বা লাহোর থেকে প্লেনে আসত না। দিল্লি ও কলকাতা হয়ে প্লেন আসত। ঢাকা এসেই ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকলাম। মাওলানা সাহেবের সাথে যোগাযোগ করলাম। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মতামত সকলকে জানালাম। সকলেই এফিলিয়েশন নিতে রাজি হলেন। সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব নেওয়া হল। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক তখন খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। মানিক ভাই সর্বস্ব দিয়ে কাগজটি চালাচ্ছেন। আমি তাঁকে দরকার মত সাহায্য করছি। আতাউর রহমান সাহেবও সাহায্য করতে ক্রটি করেন নাই। (পৃ-২১৮, ২১৯)।
ভূক্তি-৬৯৭ এই সময় মাওলানা সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সরকার তাঁর কেবিন খরচ দিতে রাজি হল না। ওয়ার্ডে রাখতে রাজি আছে। মাওলানা ভাসানী বন্দি, টাকা পয়সা কোথায় পাবেন ? সরকারের খরচ দেওয়া উচিত তবুও দেবে না। কতটা নিচ হলে এ কাজ করতে পারে সরকার। আমাকে মাওলানা সাহেব খবর দিলেন। আমি মওলানা সাহেবকে কেবিনে যেতে বললাম এবং টাকার বন্দোবস্তে লাগলাম। আতাউর রহমান সাহেবও কিছু সাহায্য করবেন বললেন। তখন কর্মীরাই আওয়ামী লীগে টাকা দিয়ে কাজ চালাত। (পৃ-২১৯)।
ভূক্তি-৬৯৮ মাওলানা সাহেব যখন হাসপাতালে তখন আমি জেলায় জেলায় সভা করার জন্য প্রোগ্রাম করলাম। আতাউর রহমান খান ও আবদুস সালাম খানের মধ্যে তখন মনে মনে রেষারেষি চলছিল। (পৃ-২১৯)।
ভূক্তি-৬৯৯ ঢাকায় ফিরে এসে পূর্ব পাকিস্তান শান্তি কমিটির সভায় যোগদান করলাম। আতাউর রহমান খান সাহেব, সভাপতি। আমরা ‘যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই’ এই ¯োøগান আমাদের। সেপ্টেম্বর মাসের ১৫-১৬ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ গুলির প্রতিনিধিরা শান্তি সম্মেলনে যোগদান করবে। আমাদের যেতে হবে পিকিং-এ, দাওয়াত এসেছে। সমস্ত পাকিস্তান থেকে ত্রিশজন অমন্ত্রিত। পূর্ব বাংলার ভাগে পড়েছে মাত্র পাঁচজন, আতাউর রহমান খান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, উর্দু লেখক ইবনে হাসান ও আমি। সময় নাই, টাকা পয়সা কোথায়? পাসপোর্ট কখন করব? টিকিট অবশ্য পাওয়া যাবে যাওয়া-আসার জন্য শন্তি সম্মেলনের পক্ষ থেকে। (পৃ-২২১)।
ভূক্তি-৭০০ আমরা পাসপোর্টের জন্য দরখাস্ত করলাম, পাওয়ার আশা আমাদের খুবই কম। কারণ, সরকার ও তার দলীয় সভ্যরা তো ক্ষেপে অস্থির। কমিউনিস্ট না হলে কমিউনিস্ট চীনে যেতে চায়? শান্তি সম্মেলন তো না, কমিউনিস্ট পার্টির সভা, এমনি নানা কথা শুরু করে দিল। মিয়া ইফতিখার উদ্দিন সাহেব চেষ্টা করছেন করাচিতে, আমাদের পাসপোর্টের জন্য। পাসপোর্ট অফিসার বললেন, ‘‘আমি লিখে পড়ে সব ঠিক করে রেখেছি, হুকুম আসলেই দুই মিনিটের মধ্যে পেয়ে যাবেন’’। (পৃ-২২১)।
ভূক্তি-৭০১ জানলাম পিকিং এ ভীষণ শীত, গরম কাপড় লাগবে। কিন্তু গরম কাপড় আমার ছিল না। তবে হংকং থেকেও কিনে নেওয়া যাবে। খুব নাকি সস্তা। ২২-২৩ তারিখে আমরা আশা ছেড়ে দিলাম। বোধহয় ২৪ তারিখ একটা প্লেন ঢাকায় আসবে। সরকার থেকে খবর এসেছে আমাদের পাসপোর্ট দেওয়া হবে। আমরা বুঝলাম এটা দেয়া না, শুধু মুখ রক্ষা করা। পাসপোর্ট পেলাম একটায়। কখন বাড়িতে যাব, কাপড় আনব আর কখনই বা প্লেনে উঠব। আতাউর রহমান সাহেব টেলিফোন করলেন বিত্তএসি অফিসে, প্লেনের খবর কি ? তারা বলল, প্লেনের কোন খবর নাই। তবে কয়েক ঘন্টা লেট আছে। মনে আশা এলো, তবে বোধহয় যেতে পারব। মানিক ভাই বলতে শুরু করেছেন, তাঁর যাওয়া হবে না, কারণ ইত্তেফাক কে দেখবে ?টাকা কোথায়?ইত্তেফাকে লিখবে কে?কিছু সময় পরে খবর পেলাম চব্বিশ ঘন্টা প্লেন লেট। আগামী দিন বারটায় প্লেন আসবে। একটায় ছাড়বে। আমরা একটু আশ্বস্ত হলাম। খন্দকার ইলিয়াস আমার ব্যক্তিগত বন্ধু, যুগের দাবী সাপ্তাহিক কাগজের সম্পাদক। দুজনেই এক বয়সী, একসাথে থাকব ঠিক করলাম। মানিক ভাইকে নিয়ে বিপদ! কি যে করে বলা যায় না। (পৃ-২২২)
ভূক্তি-৭০২ সকালে প্রস্তুত হয়ে আমি মানিক ভাইয়ের বাড়িতে চললাম। তখন ঢাকায় রিকশাই একমাত্র সম্বল। সকাল আটটায় যেয়ে দেখি তিনি আরামে শুয়ে আছেন। অনেক ডাকাডাকি করে তুললাম। আমাকে বলেন, ‘‘কি করে যাব, যাওয়া হবে না; আপনারাই বেড়িয়ে আসেন”। আমি রাগ করে উঠলাম। ভাবীকে বললাম, ‘‘আপনি কেন যেতে বলেন না, দশ-পনের দিনে কি অসুবিধা হবে ? মানিকভাই লেখক, তিনি গেলে নতুন চীনের কথা লিখতে পারবেন, দেশের লোক জানতে পারবে। কাপড় কোথায় ? স্যুটকেস ঠিক করেন। আপনি প্রস্তুত হয়ে নেন। আপনি না গেলে আমাদের যাওয়া হবে না”। মানিক ভাই জানে যে, আমি নাছোড়বান্দা। তাই তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নিলেন। আমরা পৌঁছার কিছু সময় পরেই বিত্তএসি’র প্লেন এসে নামল। কিছু কিছু বন্ধুবান্ধব আমাদের বিদায় দিতে এসেছে। শান্তি কমিটির সেক্রেটারী আলী আসাদ কয়েকটা ফুলের মালাও নিয়ে এসেছে। প্লেন প্রথমে রেঙ্গুন পৌঁছাবে। রাতে রেঙ্গুনে আমাদের থাকতে হবে। আমরা অনেক সময় পাব। বিকাল ও রাতটা রেঙ্গুনে থাকতে হবে। (পৃ-২২২, ২২৩)।
ভূক্তি-৭০৩ আমরা রেঙ্গুন পৌঁছার পরেই বিত্তএসি’র বিশ্রামাগারে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল। ব্রম্মদেশ ও বাংলাদেশ এই রকমে ফুলেফুলে ভরা। ব্রম্মদেশে তখন ভীষন গোলমাল, স্বাধীনতা পেলেও চারদিকে অরাজকতা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জাপান ও চীনের কাছ থেকে জনসাধারণ অনেক অস্ত্র পেয়েছিল। নিজেদের ইচ্ছামত এখন তা ব্যবহার করতে শুরু করেছে। কমিউনিটি ও করেন’রা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। গৃহযুদ্ধে দেশটা শেষ হতে চলেছে। আইনশৃঙ্খলা বলে কোন জিনিস নাই। যে কোন সময় এমনকি দিনের বেলায়ও রেঙ্গুন শহরে রাহাজানি ও ডাকাতি হয়। সন্ধ্যার পরে সাধারনত মানুষ ভয়েতে ঘর থেকে বের হয় না। যাদের অবস্থা ভাল অথবা বড় ব্যবসায়ী তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। যে কোন মূহূর্তে তাদের ছেলে মেয়ে ধরে নিয়ে যেতে পারে। আর যে টাকা দুর্বৃত্তরা দাবি করবে, তা না দিলে হত্যা করে ফেলবে। প্রায়ই এই সকল ঘটনা ঘটছে। আমাদের হুশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে। কোথাও বের হলে বলে যেতে বলেছে। হোটেলকে রক্ষা করার জন্য রীতিমত সশস্ত্র সিপাহী রাখা হয়েছে। আমরা বিদেশী মানুষ, আমাদের আছেই বা কি ? আমাদের নিয়ে আমজাদ সাহেব বের হয়ে পড়লেন রেঙ্গুন শহর দেখাতে। বড় বড় কয়েকটা প্যাগোডা (বৌদ্ধ মন্দির) দেখলাম। একটার ভিতরেও আমরা যেয়ে দেখলাম। (পৃ-২২৩)।
ভূক্তি-৭০৪ আতাউর রহমান সাহেবের আর এক পরিচিত লোক আছেন, তিনিও পূর্ব বাংলার লোক। একবার মন্ত্রীও হয়েছিলেন। তাঁর বাড়িতে আমরা উপস্থিত হলাম। তিনি বাড়ি ছিলেন না, অনেকক্ষন ডাকাডাকির পরে উপর থেকে এক ব্রস্থ মহিলা মুখ বের করে বললেন, বাড়িতে কেউ নাই। দরজা খুলতে পারবেন না। কারণ, আমাদের চিনেন না। কাগজ চাইলাম। তিনি বললেন, ‘‘দরজা খুলব না, কাগজ বাইরেই আছে; লিখে জানালা দিয়ে ফেলে যান”। এই ব্যবহার কেন? আমজাদ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, ‘‘এই ভাবে গাড়িতে করে ব্যান্ডিটরা আসে। ব্যন্ডিটরা দরজা খুললেই হাত-মুখ বেঁধে বন্দুক ও পিস্তল দেখিয়ে সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়”।
রেঙ্গুন শহরের একদিন শ্রী ছিল। এখনও কিছুটা আছে; তবে লাবন্য নষ্ট হয়ে গেছে। খুব ভোরে আমাদের রওয়ানা করতে হল। আমরা ব্যাংকক পৌঁছালাম। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক; বেশ বড় এয়ারপোর্ট তাদের। এখানে চা-নাশতা খেলাম। এক ঘন্টা পরে হংকং রওয়ানা করলাম। সোজা হংকং, আর কোথাও প্লেন থামবে না। আমার প্লেনে কোনো কষ্ট হয় না। থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম ও দক্ষিন চীন সাগর পাড়ি দিয়ে বেলা একটায় হংকংয়ের কাইতেক বিমান ঘাঁটিতে পৌঁছালাম। ‘সিনহুয়া’ সংবাদ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা আমাদের অভ্যর্থনা করল। ইংরেজিতে ‘‘নিউ চায়না নিউজ এজেন্সি’ বলা হয় সংবাদ প্রতিষ্ঠানটিকে। কৌলুন হোটেলে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে। পরের দিন ভোরে আমাদের সভা হল, সভায় পীর মানকী শরীফকে নেতা করা হল। রাতে ও দিনে হংকং ঘুরে দেখলাম। হংকংয়ের নাম ইংরেজরা রেখেছে ‘‘ভিক্টোরিয়া”। নদীর এক পাড়ে হংকং অন্য পাড়ে কৌলুন। (পৃ-২২৪)।
ভূক্তি-৭০৫ আমাদের টাকা বেশি নাই, কিন্তু জিনিসপত্র খুব সস্তা। তবে সাবধান হয়ে কিনতে হবে। একটাকা দামের জিনিস পঁচিশ টাকা চাইবে, আপনাকে এক টাকাই বলতে হবে, লজ্জা করলে ঠকবেন। জানাশোনা পুরানা লোকের সাহায্য ছাড়া মালপত্র কেনা উচিত না। হংকংয়ের আরেকটা নাম হওয়া উচিত ছিল ‘‘ঠগবাজ শহর”। রাস্তায় হাটবেন পকেটে হাত দিয়ে, নইলে পকেট খালি। এত সুন্দর শহর তার ভিতরের রুপটা চিন্তা করলে শিউরে উঠতে হয়। এখন ইংরেজের কলোনী। অনেক চীনা অর্থশালী লোক পালিয়ে হংকং এসেছে। বাস্তুুহারা লোকরা পেটের দায়েও অনেক অসৎ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। পরে অনেকবার হংকং যেতে হয়েছে। হংকং এত পাপ সহ্য করে কেমন করে; শুধু তাই ভাবি! (পৃ-২২৫)।
ভূক্তি-৭০৬ বোধহয় হংকং থেকে ২৭ তারিখে রেলগাড়িতে ক্যান্টন পৌঁছালাম। সেনচু স্টেশন কমিউনিস্টি চীনের প্রথম স্টেশন। ব্রিটিশ এরিয়ার পরে আর ব্রিটিশ রেল যায় না। আমরা হেঁটে পুল পার হয়ে স্টেশনে পৌঁছালাম। শান্তি কমিটির স্বেচ্ছাসেবক ও স্বেচ্ছাসেবিকারা আমাদের সদর অভ্যর্থনা জানাল। কোনো চিন্তা নাই। মালপত্র সব কিছুর ভার তারা গ্রহণ করেছেন। আমাদের জন্য ট্রেনে খাবার ও থাকার সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে। দুই তিন জনের জন্য একজন করে ইন্টারপ্রেটার রয়েছে। এদের সকলেই প্রায় স্কুল, কলেজের ছেলে-মেয়ে। আমি ট্রেনের ভিতর ঘুরতে শুরু করলাম। নতুন চীনের লোকের চেহারা দেখতে চাই। ‘‘আফিং” খাওয়া জাত যেন হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। আফিং এখন আর কেউ খায় না, আর ঝিমিয়েও পড়ে না। মনে হল, এ এক নতুন দেশ, নতুন মানষ। এদের মনে আশা এসেছে, হতাশা আর নাই। তারা আজ স্বাধীন হয়েছে, দেশের সকল কিছুই আজ জনগণের। ভাবলাম, তিন বছরের মধ্যে এত বড় আলোড়ন সৃষ্টি এরা কি করে করল! ক্যান্টন পৌঁছালাম সন্ধ্যার পরে। শত শত ছেলে মেয়ে ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির। শান্তি কমিটির কর্মকর্তারা আমাদের বেলস্টেশনে অভ্যর্থনা করলেন। পার্ল নদীর পাড়ে এক বিরাট হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাতেই আবার ডিনার, শান্তি কমিটির পক্ষে থাকে। চীনের লোকেরা বাঙ্গালিদের মত বর্ক্তৃতা করতে আর বর্ক্তৃতা শুনতে ভালবাসে। খাবার শুরু হবার পূর্বে বর্ক্তৃতা হল। আমাদের পক্ষে পীর সাহেব বর্ক্তৃতা করলেন। হাততালি কথায় কথায়, আমাদেরও তালি দিতে হল। ভোরেই রওয়ানা করতে হবে পিকিং। আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে পৌঁছাতে। তাই কনফারেন্স বন্ধ রাখা হয়েছে। ক্যান্টন থেকে প্লেনে যেতে হবে দেড় হাজার মাইল। সকালে নাশতা খেয়ে আমরা রওয়ানা করলাম। (পৃ-২২৫)।
ভূক্তি-৭০৭ দিনের বেলা প্লেনে দেড় হাজার মাইল চীনের ভূখন্ডের উপর দিয়ে যাবার সময় সে দেশের সৌন্দর্য দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। (পৃ-২২৫, ২২৬)।
ভূক্তি-৭০৮ ক্যান্টন প্রদেশ বাংলাদেশের মতই সুজলা সুফলা। শত শত বছর বিদেশীরা এই দেশকে শাসন করেও এর সম্পদের শেষ করতে পারে নাই। নয়াচীন মনপ্রাণ দিয়ে নতুন করে গড়তে শুরু করেছে। বিকেবেলা আমরা পৌঁছালাম পিকিং এয়ারপোর্টে। আমাদের পরিচয় পর্ব শেষ করে পিকিং হেটেলে নিয়ে আসা হল। এই সেই পিকিং, চীনের রাজধানী। পূর্বে অনেক জাতি পিকিং দখল করেছে। ইংরেজ বা জাপান অনেক কিছু ধ্বংসও করেছে। অনেক লুটপাট করেছে, দখল করার সময়। এখন সমস্ত শহর যেন নতুন রুপ ধরেছে। পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেয়ে প্রাণভরে হাসছে। (পৃ-২২৬)।
ভূক্তি-৭০৯ আমাদের পিকিং হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করেছে। এই হোটেলটাই সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর। আতাউর রহমান সাহেব, মানিক ভাই এবং আমি এক রুমে। বড় ক্লান্ত আমরা। রাতে আর কোথাও বের হব না। আমাদের দলের নেতা পীর সাহেব বলে দিয়েছেন, কোনো মুসলমান হোটেলে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে। রাতে বাসে চড়ে সেখানে যেতে হবে খাবার জন্য। ভীষণ শীত বাইরে, তবুও উপায় নাই। প্রায় দুই মাইল দূরে এই হোটেলটা। মনে হল হোটেলের মালিক খুব খুশি হয়েছেন। চীনা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা তারা জানে না। ইন্টারপ্লেটার সাথেই আছে। খেতে শুরু করলাম, কিন্তু খাবার উপায় নাই। ভীষণ ঝাল। দু’এক টুকরা রুটি মুখে দিয়ে বিদায় হলাম। যা কিছু খেয়েছিলাম তার ধাক্কা চলল, পেটের ব্যাথা শুরু হল। রুমে আঙ্গুর ও অন্যান্য ফলফলাদি ছিল, তাই খেয়ে আর চা খেয়ে রাত কাটালাম। (পৃ-২২৬)।
ভূক্তি-৭১০ মানিক ভাই বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন, তিনি আর যাবেন না ঐ হোটেলে খেতে। পিকিং হোটেলেই সব কিছু পাওয়া যায়। যা খেতে চাইবেন, তাই দিবে। মানিক ভাই আর কয়েকজন পরের দিন দুপুরে পিকিং হোটেলে খেয়ে শুয়ে পড়লেন। পিকিং হোটেলে ভাত, তরকারি, চিংড়ি মাছ, মুরগি, গরুর মাংস, ডিম সবকিছুই পাওয়া যায়। আমাদের এখন আর কোনো অসুবিধা হয় না। কয়েকদিন পূর্বে কলকাতা থেকে বিখ্যাত লেখক বাবু মনোজ বসু এবং বিখ্যাত গায়ক ক্ষিতীশ বোস এসেছেন। তাঁরা বাঙ্গালি খানার বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন। তাঁদের সাথে আমাদের আলাপ হওয়ার পরে আরও সুবিধা হয়ে গেল। (পৃ-২২৬)।
ভূক্তি-৭১১ ১ল অক্টোবর নয়া চীনের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৪৯ সালের ১লা অক্টোবর এরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। চীন থেকে পালিয়ে চিয়াং কাইশেকের দল ফরমোজায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। (পৃ-২২৬)।
ভূক্তি-৭১২ শন্তি সম্মেলন শুরু হবে ২রা অক্টোবর থেকে। ভাবলাম, সম্মেলন শুরু হবার আগে দেখে নেই ভাল করে পিকিং শহরকে। পিকিং শহরের ভিতরেই আর একটা শহর, নাম ইংরেজিতে ‘‘ফরবিডেন সিটি”। স¤্রাটরা পূর্বে অমাত্যবর্গ নিয়ে এখানে থাকতেন। সাধারণ লোকের এর মধ্যে যাওয়ার হুকুম ছিল না। এই নিষিদ্ধ শহরে না আছে এমন কিছুই নাই। পার্ক, লেক, প্রাসাদ সকল কিছুই আছে এর মধ্যে। ভারতে লালকেল্লা, ফতেহপুর সিক্রি এবং আগ্রাকেল্লাও আমি দেখেছি। ফরবিডেন সিটিকে এদের চেয়েও বড় মনে হল। এখন সকলের জন্য এর দরজা খোলা; শ্রমিকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, পার্ক, লেক সবকিছুই আজ জনগনের সম্পত্তি। হাজার হাজার লোক আসছে, যাচ্ছে। দেখলাম ও ভাবলাম। রাজ-রাজড়ার কান্ড সব দেশেই একই রকম ছিল। জনগনের টাকা তাদের আরাম আয়েশের জন্য ব্যয় করতেন, কোনো বাধা ছিল না। (পৃ-২২৭)।
ভূক্তি-৭১৩ পরের দিন গ্রীষ্ম প্রাসাদ দেখতে গোলাম, যাকে ইংরেজিতে বলা হয়, ‘‘সামার প্যালেস”। নানা রকমের জীব জানোয়ারের মূর্তি। বিরাট বৌদ্ধ মন্দির, ভিতরে বিরাট লেক, লেকের মধ্যে একটা দ্বীপ। এটাকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রমোদ নগরী বলা চলে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল রেজা পিকিং হোটেলে আমাদের সাথে দেখা করতে এলেন। তাঁর কাছ থেকে গল্প শুনলাম অনেক। কালোবাজার বন্ধ, জনগন কাজ পাচ্ছে। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ হয়ে গেছে। কঠোর হাতে নতুন সরকার এইসব দমন করেছে। যে কোনে জিনিস কিনতে যান, এক দাম। আমি একাকি বাজারে সামান্য জিনিসপত্র কিনেছি। দাম লেখা আছে। কোনো দরকষাকষি নাই। রিকশায় চড়েছি। কথা বুঝতে পারি না। চীনা টাকা যাকে ‘‘ইয়েন” বলে, হাতে করে বলেছি, ‘‘ভাড়া নিয়ে যাও কত নেবা”। তবে যা ভাড়া, তাই নিয়েছে, একটুও বেশি নেয় নাই। (পৃ-২২৭)।
ভূক্তি-৭১৪ এবারের ১লা অক্টোবর তৃতীয় স্বাধীনতা দিবস। শান্তি সম্মেলনের ডেলিগেটদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের ঠিক পিছনে উঁচুতে মাও সে তুং, চ্যু তে, মাদাম সান ইয়েৎ সেন (সুং চিং লিং), চৌ এন লাই, লিও শাও চী আরও অনেক অভিবাদন গ্রহন করবেন। জনগন শোভাযাত্রা করে আসতে লাগল। মনে হল, মানুষের সমুদ্র। পদাতিক, নৌ, বিমান বাহিনী তাদের কুচকাওয়াজ ও মহড়া দেখলম। তরপরই শুরু হল, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, ইয়াং পাইওনিয়ারের মিছিল, শুধু লাল পতাকাসহ। একটা জিনিস আমার চোখে পড়ল। এত বড় শোভাযাত্রা কিন্তু শৃঙ্খলা ঠিকই রেখেছে। পাঁচ-সাত লক্ষ লোক হবে মনে হল। পরের দিন খবরের কাগজে দেখলাম, পাঁচ লাখ। বিপ্লবী সরকার সমস্ত জাতটার মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে নতুন চিন্তাধারা দিয়ে। (পৃ-২২৭)।
ভূক্তি-৭১৫ আমি মাহাবুবকে দূর থেকে দেখে ডাক দিলাম। হঠাৎ পিকিংয়ে নাম ধরে কে ডাকছে, একটু আশ্চর্যই হল বলে মনে হল। আমাকে দেখে খুবই খুশি হল। কাগজে দেখেছে আমি এসেছি। যে কয়দিন পিকিং এ ছিলাম, রাতে আমি ওদের সাথেই খেতাম। বাংলাদেশের খাবার না খেলে আমার তৃপ্তি কোনোদিনই হয় নাই। মাহাবুবের বেগম আমাকে একটা ক্যামেরা উপহার দিলেন। টাকার প্রয়োজন ছিল, তাই মাহাবুব কিছু টাকাও আমাকে দিল। বলল, হংকং থেকে কিছু জিনিস কিনে নিও, খুব সস্তা। আমার স্ত্রীর কথাও বলল, ‘‘কিছু দিতে পারলাম না তাকে। এই টাকা থেকে ভাবীর জন্য উপহার নিও”। বেগম মাহাবুব ও মাহাবুবের আপ্যায়নের কথা কোনেদিন ভুলতে পারি নাই। চীনের পাকিস্তান দুতাবাসে মাহাবুবই একমাত্র বাঙ্গালি কর্মচারী। (পৃ-২২৮)
ভূক্তি-৭১৬ শান্তি সম্মেলন শুরু হল। তিনশত আটাত্তর জন সদস্য আঁটাত্রিশটা দেশে থেকে যোগদান করেছে। আঁটত্রিশটা দেশের পতাকা উড়ছে। শান্তির কপোত এঁকে সমস্ত হলটা সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। প্রত্যেক টেবিলে হেডফোন আছে। আমরা পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা একপাশে বসেছি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান খান ও আমি বক্তৃতা করলাম। আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। আতাউর রহমান সাহেব ইংরেজি করে দিলেন। ইংরেজি থেকে চীনা, রুশ ও স্পেনিশ ভাষায় প্রতিনিধিরা শুনবেন। কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না ? ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করেছেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবি রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য। আমার বক্তৃতার পর মনোজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘‘ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে নাই। আর পারবেও না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছে আমরা বাংলা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের লোকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি”। (পৃ-২২৮, ২২৯)।
ভূক্তি-৭১৭ বক্তৃতার পর, খন্দকার ইলিয়াস তো আমার গলাই ছাড়ে না। ক্ষিতীশ বাবু পিরোজুরের লোক ছিলেন, বাংলা গানে মাতিয়ে তুলেছেন। সকলকে বললেন, বাংলা ভাষাই আমাদের গর্ব। কতগুলি কমিশনে সমস্ত কনফারেন্স ভাগ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন রুমে বসা হল। আমিও একটা কমিশনে সদস্য ছিলাম। মানিক ভাই কমিশনে বসতেন না বললেই চলে। তিনি বলতেন, প্রস্তাব ঠিক হয়েই আছে। বিভিন্ন ধর্মের লোকেরাও যোগদান করেছিল আলাদা আলাদা ভাবে শোভাযাত্র করে। চীনে কনফুসিয়াস ধর্মের লোকেরা সংখ্যায় বেশি। তার পর বৌদ্ধ, মুসলমানের সংখ্যাও কম না, কিছু খ্রিষ্টানও আছে। একটা মসজিদে গিয়েছিলাম, তারা বললেন, ধর্ম কর্মে বাধা দেয় না এবং সাহায্যও করে না। (পৃ-২২৯)।
ভূক্তি-৭১৮ ভারত বর্ষের প্রতিনিধিদের ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সাথে কাশ্মীর নিয়ে অনেক আলোচনা হওয়ার পরে একটা যুক্ত বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল। এতে কাশ্মির সমস্যা সমস্ত প্রতিনিধিদের সামনে আমরা তুলে ধরতে পেরেছিলাম। (পৃ-২২৯)।
ভূক্তি-৭১৯ আমরা ভারতের প্রতিনিধিদের খাবার দাওয়াত করেছিলাম। আমাদেরও তারা দাওয়াত করেছিল। রাশিয়ার প্রতিনিধিদেরও আমরা খাবার দাওয়াত করেছিলাম। এখানে রুশ লেখক অ্যাসিমডের সাথে আলাপ হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এই সম্মেলনেই আমি মোলাকাত করি তুরস্কের বিখ্যাত কবি নাজিম হিকমতের সাথে। বহুদিন দেশের জেলে ছিলেন। এখন তিনি দেশত্যাগ করে রাশিয়ায় আছেন। তাঁর স্থান নাই, যদিও বিশ্ববিখ্যাত কবি তিনি। ভারতের ড. সাইফুদ্দিন কিচলু, ডাক্তার ফরিদী ও আরও অনেক বিখ্যাত নেতাদের সাথেও আলাপ হয়েছিল। আমি আর ইলিয়াস সুযোগ বুঝে একবার মাদাম সান ইয়্যেৎ সেনের সাথে দেখা করি এবং কিছু সময় আলাপও করি। (পৃ-২২৯, ২৩০)।
ভূক্তি-৭২০ একটা জিনিস আমি অনুভব করেছিলাম, চীনের সরকার ও জনগণ ভারতবর্ষ বলতে পাগল। পিকিংয়ের মেয়র চেং পেংয়ের সাথেও ব্যক্তিগতভাবে আলাপ হয়েছিল আমার কিছু সময়ের জন্য। (পৃ-২৩০)।
ভূক্তি-৭২১ আমরা পে ইয়ং পার্ক ও স্বর্ণ মন্দির (টেম্পেল অব হেভেন) দেখতে যাই। চীন দেশের লোকেরা এই মন্দিরে পূজা দেয় যাতে ফসল ভাল হয়। এখন আর জনগন বিশ্বস করে না, পূজা দিয়ে ভাল ফসল উৎপাদন সম্ভব। কমিউনিস্ট সরকার জমিদারি বাজেয়াপ্ত করে চাষিদের মধ্যে জমি বিলি বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। ফলে ভূমিহীন কৃষক জমির মালিক হয়েছে। চেষ্টা করে ফসল উৎপাদন করছে, সরকার সাহায্য করছে। ফসল উৎপাদন করে এখন আর অকর্মন্য জমিদাদের ভাগ দিতে হয় না। কৃষকরা জীবনপন করে পরিশ্রম করছে। এক কথায় তারা বলে, আজ চীন দেশ কৃষক মজুরদের দেশ, শোষক শ্রেনী শেষ হয়ে গেছে। (পৃ-২৩০)।
ভূক্তি-৭২২ এগার দিন সম্মেলন হওয়ার পরে দেশে ফিরবার সময় হয়েছে। শান্তি কমিটি আমাদের জানালেন ইচ্ছা করলে আমরা চীন দেশের যেখানে যেতে চাই বা দেখতে চাই তারা দেখাতে রাজি আছেন। খরচপাতি শান্তি কমিটি বহন করবে। আতাউর রহমান খান সাহেব ও মানিকভাই দেশে ফিরবার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন। তাঁরা বিদায় নিলেন। ইলিয়াস ও আমি আরও কয়েকটা জায়গা দেখে ফিরব ঠিক করলাম। পীর মানকী শরীফ ও পাকিস্তানের কয়েকজন নেতার সাথে আমার দুইজনে যোগ দিলাম। (পৃ-২৩০)।
ভূক্তি-৭২৩ পিকিং থেকে বিদায় নিয়ে প্রথমে তিয়েন শিং বন্দরে এলাম। পীর সাহেবকে নিয়ে এক বিপদই হল, তিনি ধর্ম মন্দির, প্যাগোডা আর মসজিদ, এইসব দেখতেই বেশি আগ্রহশীল। আমরা শিল্প কারখানা, কৃষকদের অবস্থা, সাংস্কৃতিক মিলনের জায়গা ও মিউজিয়াম দেখার জন্য ব্যস্ত। তিনি আমাদের দলের নেতা, আমাদের তাঁর প্রোগ্রামই মানতে হয়। তবুও ফাঁকে ফাঁকে আমরা দুইজন এদিক ওদিক বেড়াতে বের হতাম। আমাদের কথাও এরা বোঝে না, এদের কথাও আমরা বুঝি না। একমাত্র উপায় হল ইন্টারপ্রেটার। (পৃ-২৩০)।
ভূক্তি-৭২৪ তিয়েন শিং সামুদ্রিক বন্দর। এখানে আমরা রাশিয়ান দেখতে পাই। রাতে আমাদের জন্য যে খাবার বন্দেবস্ত করেছিল সেখানে একজন ইমাম সাহেব ও কয়েকজন মুসলমানকে দাওয়াত করা হয়েছিল। মুসলমানরা ও ইমাম সাহেব জানালেন তারা সুখে আছেন। ধর্মে-কর্মে কোনো বাধা কমিউনিস্ট সরকার দেয় না। তবে ধর্ম প্রচার করা চলে না। (পৃ-২৩১)।
ভূক্তি-৭২৫ দুই দিন তিয়েন শিং থেকে আমরা নানকিং রওয়ানা করলাম। গাড়ির প্রাচুর্য বেশি নাই। সাইকেল, রিকাশা আর দুই চারখানা বাস। মোটরগাড়ি খুবই কম। কারণ, নতুন সরকার গাড়ি কেনার দিকে নজর না দিয়ে জাতি গঠন কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। (পৃ-২৩১)।
ভূক্তি-৭২৬ আমার অভ্যাস, নিজে দাড়ি কাটা। নাপিত ভাইদের বোধয় দাড়ি কাটতে কোনোদিন পয়সা দেয় নাই। ব্লেড কিনতে গেলে শুনলাম, ব্লেড পাওয়া যায় না। বিদেশ থেকে ব্লেড আনার অনুমতি নাই। পিকিংয়েও চেষ্টা করেছিলাম পাই নাই। ভাবলাম, তিয়েন শিং-এ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। এত বড় শিল্প এলাকা ও সামুদ্রিক বন্দর! এক দোকানে বহু পুরানা কয়েকখানা ব্লেড পেলাম, কিন্তুু তাতে দাড়ি কাটা যাবে না। আর এগুলো কেউ কিনেও না। চীন দেশে যে জিনিস তৈরি হয় না; তা লোকে ব্যবহার করবে না। পুরানা আমলের ক্ষুর দিয়ে দাড়ি কাটা হয়। আমার আর উপায় রইলা না; শেষ পর্যন্ত হোটেলের সেলুনেই দাড়ি কাটতে হল। এরা শিল্প কারখানা বানানোর জন্যই শুধু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে। আমাদের দেশে সেই সসময়ে কোরিয়ার যুদ্ধের ফলস্বরুপ যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছিল তার অধিকাংশ ব্যয় হল জাপানি পুতুল, আর শৌখিন দ্রব্য কিনতে। দৃষ্টিভঙ্গিরে কত তফাৎ আমাদের সরকার আর চীন সরকারের মধ্যে! এদেশে একটা বিদেশী সিগারেট পাওয়া যায় না। সিগারেট তারা তৈরী করছে নিকৃষ্ট ধরনের, তাই বড় ছোট সকলে খায়। আমরাও বাধ্য হলাম চীনা সিগারেট খেতে। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হয়েছিল কড়া বলে, আস্তে আস্তে রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। (পৃ-২৩১)।
ভূক্তি-৭২৭ নানকিং অনেক পুরানা শহর। অনেক দিন চীনের রাজধানী ছিল। এখানে সান ইয়েৎ সেনের সমাধি। আমরা প্রথমেই সেখানে যাই শ্রদ্ধা জানাতে। পীর সাহেব ফুল দিলেন, আমরা নীরবে দাড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম এই বিপ্লবী নেতাকে। সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি ও চীনের মাঞ্চু রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন এবং বিপুল ত্যাগ স্বীকার করেছেন। রাজতন্ত্রকে খতম করে দুনিয়ায় চীন দেশের মর্যাদা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিও বুঝতে পেরেছিল চীন জাতিকে বেশি দিন দাবিয়ে রাখা যাবে না, আর শোষণও করা চলবে না।(পৃ-২৩১)
ভূক্তি-৭২৮ নানকিং থেকে আমরা সাংহাই পৌছালাম। এটা দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর ও ব্যবসা কেন্দ্র। বিদেশী শক্তিগুলি বার বার একে দখল করেছে। নতুন চীন সৃষ্টির পূর্বে এই সাংহাই ছিল বিদেশী শক্তির বিলাসীদের আরাম, আয়েশ ও ফুর্তি করার শহর। হংকংয়ের মতই এর অবস্থা ছিল। নতুন চীন সরকার কঠোর হস্তে সেসব দমন করেছে। সাংহাইতে অনেক শিল্প কারখানা আছে। সরকার কতগুলি শিল্প বাজেয়াপ্ত করেছে। যারা চিয়াং কাইশেকের ভক্ত ছিল, অনেকে পালিয়ে গেছে। আমাদেরকে দুনিয়ার অন্যতম বিখ্যাত টেক্সটাইল মিল দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এটা তখন জাতীয়করণ করা হয়েছে। শ্রমিকদের থাকার জন্য অনেক নতুন নতুন দালান করা হয়েছে। তাদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুল করা হয়েছে, চিকিৎসার জন্য আলাদা হাসপাতাল করা হয়েছে। বিরাট এলাকা নিয়ে কলোনি গড়ে তুলেছে। আমি কিছু সময় পীর সাহেবের সাথে সাথে দেখতে লাগলাম। পরে ইলিয়াসকে বললাম, ‘‘এগুলো তো আমাদের দেখাবে, আমি শ্রমিকদের বাড়িতে যাব এবং দেখব তারা কি অবস্থায় থাকে। আমাদের হয়ত শুধু ভাল জিনিসই এরা দেখাবে, খারাপ জিনিস দেখাবে না’’। ইলিয়াস বলল, ‘‘তাহলে তো ওদের বলতে হয়”। বললাম, ‘‘আগেই কথা বল না, হঠাৎ বলব এবং সাথে সাথে এক শ্রমিকের বাড়ির ভিতরে যাব”। (পৃ-২৩২)
ভূক্তি-৭২৯ পীর সাহেব তাঁর পছন্দের অন্য কিছু দেখতে গেলেন। আমরা ইন্টারপ্রেটারকে বললাম, ‘‘এই কলোনির যে কোন একটা বাড়ির ভিতরটা দেখতে চাই। এদের ঘরের ভিতরের অবস্থা আমরা দেখব”। আমাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে চলে গেল ইন্টারপ্রেটার এবং পাঁচ মিনিটের ভিতরেই এক ফ্ল্যাটে আমাদের নিয়ে চলল। আমরা ভিতরে যেয়ে দেখলাম, এক মহিলা আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমাদের অভ্যর্থনা করলেন, ভিতরে নিয়ে বসতে দিলেন। দুই তিনটা চেয়ার একটা খাট, ভাল বিছানা- এই মহিলাও শ্রমিক। মাত্র এক মাস পূর্বে বিবাহ হয়েছে, স্বামী মিলে কাজ করতে গেছে। বাড়িতে একলাই আছে- স্বামী ফিরে আসলে তিনিও কাজ করতে যাবেন। তিনি বললেন, ‘‘খুবই দুঃখিত, আমার স্বামী নাই, খবর না দিয়ে এলেন, আপনাদের আপ্যায়ন করতে পারলাম না, একটু চা খান”। তাড়াতাড়ি চা বসিয়ে আসলেন। চীনের চা দুধ চিনি ছাড়াই আমরা খেলাম। ইন্টারপ্রেটার আমাদের বললেন, ‘‘ভেতরে চলুন, দুইখানা কামরাই দেখে যান”। আমরা দুইটা কামরাই দেখলাম। এতে একটা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি ভালভাবে বাস করতে পারে। আসবাবপত্রও যা আছে তাতে মধ্যবিত্ত ঘরের আসবাবপত্র বলতে পারা যায়। একটা পাকের ঘর ও একটা গোসলকানা ও পায়খানা। আবার ফিরে এসে বসলাম। ইলিয়াসকে বললাম, ‘‘এদের বাড়ি দেখতে এসে বিপদে পড়লাম। সামান্য কয়েকদিন পূর্বে ভদ্রমহিলার বিবাহ হয়েছে, আমাদের সাথে কিছুই নাই, যে উপহার দেই। এরা মনে করবে কি ? আমাদের দেশের বদনাম হবে”। ইলিয়াস বলল, ‘‘কি করা যায়, আমি ভাবছি”। হঠাৎ আমার হাতের দিকে নজর পড়ল, হাতে আংটি আছে একটা। আংটি খুলে ইন্টারপ্রেটারকে বললাম, ‘‘আমরা এই সামান্য উপহার ভদ্রমহিলাকে দিতে চাই। কারণ, আমার দেশের নিয়ম কোনো নতুন বিবাহ বাড়িতে গেলে বর ও কনেকে কিছু উপহার দিতে হয়”। ভদ্রমহিলা কিছুতেই নিতে রাজি নয়, আমরা বললাম, ‘‘না নিলে আমরা দুঃখিত হব। বিদেশীকে দুঃখ দিতে নাই। চীনের লোক তো অতিথিপরায়ন শুনেছি, আর দেখছিও”। আংটি দিয়ে বিদায় নিলাম। পীর সাহেবের কাছে হাজির হলাম এবং গল্পটি বললাম। পীর সাহেব খুব খুশি হলেন আংটি দেওয়ার জন্য। (পৃ-২৩২, ২৩৩)।
ভূক্তি-৭৩০ পরের দিন সকালে শ্রমিক মহিলা আর তার স্বামী কিংকং হোটেলে আমার সাথে দেখা করতে আসেন। হাতে ছোট্ট একটা উপহার। চীনের লিবারেশন পেন। আমি কিছুতেই নিতে চাইলাম না; কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিতে হল। এটা নাকি তাদের দেশের নিয়ম। সাংহাইয়ের শান্তি কমিটির সদস্যরা তখন উপস্থিত ছিল। (পৃ-২৩৩)।
ভূক্তি-৭৩১ দুইদিন সমানে চলল ঘোরাফেরা। যদিও সাংহাইয়ের সে শ্রী নাই, বিদেশীরা চলে যাওয়ার পরে। তবুও যেটুকু আছে তার মধ্যে কৃত্তিমতা নাই। সমুদ্রগামী জাহাজও কয়েকখানা দেখলাম। নতুন নতুন স্কুল, কলেজ গড়ে উঠেছে চারদিকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ভার সরকার নিয়েছে। চীনের নিজস্ব পদ্ধতিতে লেখাপড়া শুরু করা হয়েছে। (পৃ-২৩৩)।
ভূক্তি-৭৩২ সাংহাই থেকে হ্যাংচোতে আসলাম। হ্যাংচো পশ্চিম হৃদের পাড়ে। একে চীনের কাশ্মীর বলা হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ফুলে ফুলে ভরা এই দেশটা। লেকের চারপাশে শহর। আমাদের নতুন হোটেলে রাখা হয়েছে, লেকের পাড়ে। ছোট ছোট নৌকায় চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে চীন দেশের লোকেরা। তারা এখানে আসে বিশ্রাম করতে। লোকের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মধ্যে দ্বীপ আছে। হ্যাংচো ও ক্যান্টন দেখলে মনে হবে যেন পূর্ব বাংলা। সবুজের মেলা চারিদিকে। আমি ও ইলিয়াস কেটে পড়লাম। নৌকায় চড়ে লেকের চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। নৌকা ছাড়া বর্ষাকালে এখানে চলাফেরার উপায় নাই। বড়, ছোট সকল অবস্থার লোকেরই নিজস্ব নৌকা আছে। আমি নৌকা বাইতে জানি, পানির দেশের মানুষ। আমি লেকে নৌকা বাইতে শুরু করলাম। (পৃ-২৩৩)।
ভূক্তি-৭৩৩ এক দ্বীপে আমরা আসলাম, সেখানে চায়ের দোকান আছে। আমরা চা খেয়ে লেকে ভ্রমণ শেষ করলাম। হ্যাংচো থেকে ক্যান্টন ফিরে এলাম। ক্যান্টন থেকে হংকং হয়ে দেশে ফিরব। এবার ক্যান্টনকে ভালোভাবে দেখবার সুযোগ পেলাম। চীন দেশের লোকের মধ্যে দেখলাম নতুন চেতনা। চোখে মুখে নতুন ভাব ও নতুন আশায় ভরা। তারা আজ গর্বিত যে তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক। এই ক্যান্টনেই ১৯১১ সালে সান ইয়েৎ সেনের দল আক্রমন করে। ক্যান্টন প্রদেশের লোক খুবই স্বাধীনতাপ্রিয়। (পৃ-২৩৩, ২৩৪)।
ভূক্তি-৭৩৪ আমরা চীন দেশের জনগণকে ও মাত্ত সে তুং-এর সরকারকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ইতিহাস বিখ্যাত চীন দেশ থেকে বিদায় নিলাম। আবার হংকং ইংরেজ কলোনি, কৃত্রিম সৌন্দর্য ও কৃত্তিম মানুষ, চোরাকারবারিদের আড্ডা। দুই-তিন দিন এখানে থেকে তারপর দেশের দিকে হাওয়াই জাহাজে চড়ে রওয়ানা করলাম। ঢাকায় পৌঁছলাম নতুন প্রেরণা ও নতুন উৎসাহ নিয়ে। বিদেশে না গেলে নিজের দেশকে ভালভাবে চেনা কষ্টকর। (পৃ-২৩৪)।
ভূক্তি-৭৩৫ আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে আর চীন স্বধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে আজ যেন তা ঝিমিয়ে গেছে। সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মারার চেষ্টা করেছে। আর চীনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাঁদের সাথে আমাদের পার্থক্য হল, তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এই দেশ এবং এদেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের দেশের জনগন বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তাঁরা যেন কেউই নন। একটা মাত্র পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল সাদা চামড়ার জায়গায় কালা চামড়ার আমদানি হয়েছে। (পৃ-২৩৪)।
ভূক্তি-৭৩৬ চীনের জনগণ সরকারের কাজে সাহায্য করছে এটা বুঝতে কষ্ট হল না। জনমত দেখলাম চীন সরকারের সাথে। চীন সরকার নিজেকে ‘‘কমিউনিস্ট সরকার” বলে ঘোষণা করে নাই, তাঁরা তাঁদের সরকারকে ‘‘নতুন গণতন্দ্রের কোয়ালিশন সরকার” বলে থাকে। কমিউনিস্ট ছাড়া অন্য মতাবলম্বী লোকও সরকারের মধ্যে আছে। যদিও আমার মনে হল কমিউনিস্টরা নিয়ন্ত্রণ করছে সকল কিছুই। আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পূজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ^াস করি না। একে আমি শোষনের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পূঁজিপাতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পূঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ^যুদ্ধ লাগাতে বন্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগনের কর্তব্য বিশ^শান্তির জন্য সংঘবন্ধ ভাবে চেষ্টা করা। যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে যারা আবদ্ধ ছিল, সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি যাদের সর্বস্ব লুট করেছে- তাদের প্রয়োজন নিজের দেশকে গড়া ও জনগনের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুুক্তির দিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। বিশ্ব শান্তির জন্য জনমত সৃষ্টি করা তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। (পৃ-২৩৪)।
ভূক্তি-৭৩৭ আমি ঢাকায় এসে পার্টির কাজে আত্বনিয়োগ করলাম। মাওলানা ভাসানী ও আমার সহকর্মীদের অনেকে আজও জেল থেকে মুক্তি পান নাই। বন্দি মুক্তি আন্দোলন জোরদার করা কর্তব্য হয়ে পড়েছে। পল্টন ময়দানে সভা দিলাম। আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে এক বিরাট সভা হল। আমি সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলাম। (পৃ-২৩৪)।
ভূক্তি-৭৩৮ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানকে গড়ার কাজে আত্বনিয়োগ করলাম। সোহরাওয়াদী সাহেবকে খবর দিলাম, পূর্ব বাংলায় আসবার জন্য। আমি প্রোগ্রাম করে তাঁকে জানালাম। সমস্ত জেলা হেড কোয়ার্টারে একটা করে সভা হবে এবং বড় বড় কতগুলি মাহকুমায়ও সভার বন্দোবস্ত করা হল। তিনি ঢাকায় আসলেন, ঢাকায় জনসভায়ও বক্তৃতা করলেন। শহীদ সাহেব পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলায় ঘুরে ঘুরে প্রতিষ্ঠান গড়তে সাহায্য করতে লাগলেন। (পৃ-২৩৫)।
ভূক্তি-৭৩৯ ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠন হলেও আজ পর্যন্ত কোন কাউন্সিল সভা হতে পারে নাই, কারণ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সকলকেই প্রায় কারাগারে দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ গড়ে উঠবার পূর্ব পর্যন্ত একমাত্র ছাত্রলীগই সরকারের অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত এবং জনগণ ও ছাত্রদের দাবী দাওয়া তুলে ধরত। মুসলিম লীগ সরকার ছাত্র লীগ প্রতিষ্ঠানকে খতম করার জন্য চেষ্টার ক্রটি করে নাই। (পৃ-২৩৬)।
ভূক্তি-৭৪০ ১৯৫৩ সালের প্রথম দিক থেকে রাজনৈতিক ও ছাত্রকর্মীরা মুক্তি পেতে শুরু করল। শামসুল হক সাহেবও মুক্তি পেলেন, তখন তিনি অসুস্থ। তাঁর যে কিছুটা মস্তিস্ক বিকৃতি হয়েছে কারাগারের বন্দি থেকে, তা বুঝতে কারও বাকি রইল না। ১৯৪৩ সাল থেকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানকে জমিদার, নবাবদের দালানের কোঠা থেকে বের করে জনগনের পর্ণকুটিরে যাঁরা নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শামসুল হক সাহেব ছিলেন অন্যতম। একেই বলে কপাল, কারণ সেই পাকিস্তানের জেলেই শামসুল হক সাহেবকে পাগল হতে হল। (পৃ-২৩৬)।
ভূক্তি-৭৪১ ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে জনাব আবুল হালিম পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়। (পৃ-২৩৮)।
ভূক্তি-৭৪২ এর পূর্বে আমরা লাহোরে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কনফারেন্স যোগদান করি। সেখানে জমিদারি প্রথা বিলোপ এবং অন্যান্য প্রোগ্রাম নিয়ে নবাব মামদোদের সাথে একমত হতে না পারায় নবাব সাহেব আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরাট প্রভেদ রয়েছে। সেখানে রাজনীতি করে সময় নষ্ট করার জন্য জমিদার, জায়গিরদার ও বড় বড় ব্যবসায়ীরা রয়েছে। আর পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতি করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। (পৃ-২৩৯)।
ভূক্তি-৭৪৩ খাজা সাহেবের আমলে পাঞ্জাবে এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। তাতে হাজার হাজার লোক মারা যায়। লাহোরে মার্শাল ল’ জারি করা হয়। আহমদিয়া বা কাদিয়ানি বিরোধী আন্দোলন থেকে এই দাঙ্গা শুরু হয়। কয়েকজন বিখ্যাত আলেম এতে উসকানি দিয়েছিলেন। ‘‘কাদিয়ানিরা মুসলমান না”- এটাই হল এই সকল আলেমদের প্রচার। (পৃ-২৪০)।
ভূক্তি-৭৪৪ মোহাম্মদ আলীর (গুড়া) মধ্যে কোনো রাজনৈতিক চেতনা ছিল না। তাঁর মধ্যে কোনো গভীরতাও ছিল না। শুধু আমেরিকা থেকে তিনি আরেরিকানদের মত কিছু হাবভাব ও হাঁটাচলা আর কাপড় পরা শিখে এসেছিলেন। গোলাম মোহাম্মদ যা বলেন, তাতেই তিনি রাজি। আর আমেরিকানরা যে বুদ্ধি দেয় সেইটাই তিনি গ্রহণ করে চলতে লাগলেন। প্রথমে তিনি শহীদ সাহেবকে তাঁর ‘‘রাজনৈতিক পিতা” বলে সম্বোধন করলেন, পরে তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করতে লাগলেন। (পৃ-২৪৩)।
ভূক্তি-৭৪৫ এরপর আমি হক সাহেবের (এ. কে. ফজলুল হক) সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে আওয়ামী লীগে যোগদান করতে অনুরোধ করলাম। চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের এক সভায় তিনি যোগদানও করলেন। সেখানে ঘোষণা করলেন, ‘‘যাঁরা চুরি করবেন তাঁরা মুসলিম লীগে থাকুন, আর যাঁরা ভাল কাজ করতে চান তাঁরা আওয়ামী লীগে যোগদান করুন”। আমাকে ধরে জনসভায় বললেন, ‘‘মুজিব যা বলে তা আপনারা শুনুন। আমি বেশি বক্তৃতা করতে পারব না বুড়া মানুষ” এ বক্তৃতা খবরের কাগজেও উঠেছিল। (পৃ-২৪৪)।
ভূক্তি-৭৪৬ শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব পরিস্কার ভাষায় বলে দিলেন, যদি ফজলুল হক সাহেব আওয়ামী লীগে আসেন তাঁকে তাঁরা মাথা পেতে গ্রহণ করবেন এবং পূর্ব বাংলায় প্রধানমন্ত্রী বানাবার চেষ্টা করবেন। শহীদ সাহেব আমাকে বলেছিলেন, ‘‘বৃদ্ধ নেতা, বহু কাজ করেছেন জীবনে, শেষ বয়সে তাঁকে একবার সুযোগ দেওয়া উচিত দেশ সেবা করতে”। (পৃ-২৪৯)।
ভূক্তি-৭৪৭ আতাউর রহমান সাহেবও আমাদের সাথে প্রথমে একমত ছিলেন যে, যুক্তফ্রন্ট করা উচিত হবে না। দুঃখের বিষা, তাঁর নিজের কোনো মতামত বেশি সময় ঠিক থাকে না। যে যা বলে, তাতেই তিনি হ্যাঁ, হ্যাঁ করেন। এক কথায়, ‘‘তাঁর হাত ধরলে, তিনি না বলতে পারেন না”। (পৃ-২৫১)।
ভূক্তি-৭৪৮ মাওলানা ভাসানী সাহেবকে অনেক কষ্ট করে ঢাকায় আনলাম। তিনি এসই আবার বাইরে চলে যেতে চাইলেন। আমরা তাঁকে সব কথা বললাম। তিনি উত্তর দিলেন, ‘‘ঐ সমস্ত লোকের সাথে কি করে কাজ করা যায়, আমি এর ধার ধারি না। তোমাদের যুক্তফ্রন্ট মানি না। আমি চললাম”। আমার সাথে খুবই কথা কাটাকাটি হল। (পৃ-২৫৩)।
ভূক্তি-৭৪৯ টাকায় কুলাবে না, জনমত আমার পক্ষে। আমি যে গ্রামেই যেতাম, জনসাধারণ শুধু আমাকে ভোট দেওয়ার ওয়াদা করতেন না, আমাকে বসিয়ে পানদানের পান এবং কিছু টাকা আমার সামনে নজরানা হিসাবে হাজির করত এবং না নিলে রাগ করত। তারা বলত, এ টাকা নির্বাচনের খরচ বাবদ দিচ্ছি। (পৃ-২৫৫)।
ভূক্তি-৭৫০ আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, ‘‘বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে”। আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, ‘‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই”। আমার চোখে পানি এলো। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে, সেই পয়সার সাথে আরও কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, ‘‘তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না”। টাকা সে নিল না, আমার মাথায় মুখে হাত দিয়ে বলল, ‘‘গরিবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা”। নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেইদিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ‘‘মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না”। এ রকম আরও অনেক ঘটনা ঘটেছিল। আমি পায়ে হেঁটেই এক ইউনিয়ন হতে অন্য ইউনিয়নে যেতাম। আমাকে রাস্তায় রাস্তায়, গ্রামে গ্রামে দেরি করতে হত। গ্রামের মেয়েরা আমাকে দেখতে চায়। আমি ইলেকশনে নামার পূর্বেই জানতাম না, এ দেশের লোক আমাকে কত ভালবাসে। আমার মনের একটা বিরাট পরিবর্তন এই সময় হয়েছিল। (পৃ-২৫৫, ২৫৬)।
ভূক্তি-৭৫১ গোপালগঞ্জে আমার নিজ ইউনিয়নে পূর্ব বাংলার এক বিখ্যাত আলেম মাওলানা শামসুল হক সাহেব জন্মগ্রহণ করেছেন। আমি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করতাম। তিনি ধর্ম সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। আমার ধারনা ছিল, মাওলানা সাহেব আমার বিরুদ্ধাচারণ করবেন না। কিন্তু এর মধ্যে তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করলেন এবং আমার বিরুদ্ধে ইলেকশনে লেগে পড়লেন। ঐ অঞ্চলের মুসলমান জনসাধারণ তাকে খুবই ভক্তি করত। মাওলানা সাহেব ইউনিয়নের পর ইউনিয়নে স্পিডবোট নিয়ে ঘুরতে শুরু করলেন এবং এক ধর্ম সভা থেকে ফতোয়া দিলেন আমার বিরুদ্ধে যে, ‘‘আমাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে”। সাথে শর্ষিনার পীর সাহেব, বরগুনার পীর সাহেব, শিবপুরের পীর সাহেব; রহমতপুরের শাহ সাহেব সকলেই আমার বিরুদ্ধে নেমে পড়লেন এবং যত রকম ফতোয়া দেওয়া যায় তাহা দিতে কৃপনতা করলেন না। (পৃ-২৫৬)।
ভূক্তি-৭৫২ নির্বাচনে দেখা গেল ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব প্রায় দশ হাজার ভোটে পরাজিত হয়েছেন। জনসাধারণ আমাকে শুধু ভোটই দেয় নাই, প্রায় পাঁচ হাজার টাকা নজরানা হিসাবে দিয়েছিল নির্বাচনে খরচ চালানোর জন্য। আমার ধারণা হয়েছিল, মানুষকে ভালবাসলে মানুষও ভালবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবনও দিতে পারে। (পৃ-২৫৭)।
ভূক্তি-৭৫৩ নির্বাচনে মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। নির্বাচনের কিছুদিন পূর্বে শহীদ সাহেব বিবৃতির মারফত বলেছিলেন, ‘‘মুসলিম লীগ নয়টির বেশি সিট পেলে আমি আশ্চর্য হব”। তিনশতের মধ্যে মুসলিম লীগ নয়টা আসনই পেয়েছিল। দুনিয়ার ইতিহাসে একটা ক্ষমতাসীন দলের এভাবে পরাজয়ের খবর কোনোদিন শোনা যায় নাই। বাঙ্গালিরা রাজনীতির জ্ঞান রাখে এবং রাজনৈতিক চেতনাশীল। এবারও তারা তার প্রমাণ দিল। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান ইস্যুর উপর সাধারণ নির্বাচনেও তাঁরা তা প্রমাণ করেছিল। (পৃ-২৫৭)।
ভূক্তি-৭৫৪ একুশ দফা দাবি জনগনের সার্বিক কল্যাণের জন্য পেশ করা হয়েছে। তা জনগণ বুঝতে পেরেছে। কারণ, আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ সাল থেকে বাংলাদেশে এর অনেকগুলো দাবি প্রচার করেছে। আওয়ামী লীগ ও তাঁর কর্মীরা যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতা ঘৃণা করে। আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক নেতা ও কর্মী আছে যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে; এবং তারা জানে সমাজতন্ত্রের পথই একমাত্র জনগণের মুক্তির পথ। ধনতন্ত্রবাদের মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করা চলে। যারা সামজতন্ত্রে বিশ^াস করে, তাঁরা কোনোদিন কোনো রকমের সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করতে পারে না। তাদের কাছে মুসলমান, হিন্দু, বাঙ্গালি, অবাঙ্গালি সকলেই সমান। শোষক শ্রেণীকে তাঁরা পছন্দ করে না। (পৃ-২৫৮, ২৫৯)।
ভূক্তি-৭৫৫ নির্বাচনের ফলাফল বের হওয়ার পরে আমি ঢাকা আসলাম। আমাকে রেলষ্টেশনে বিরাট ভাবে অভ্যর্থনা করা হয়েছিল। শোভাযাত্রা করে আমাকে আওয়ামী লীগ অফিসে নিয়ে আসা হল। শহীদ সাহেব আমার জন্য চিন্তায় ছিলেন। যদিও আমার গ্রামের বাড়িতে বসে আমাকে বলে এসেছিলেন, ‘‘তোমার চিন্তার কোনো কারণ নাই, আমি যা দেখলাম তাতে তোমার জয় সুনিশ্চিত”। (পৃ-২৫৯)।
ভূক্তি-৭৫৬ আমি যখন আমার বাড়ি টুঙ্গিপাড়া থেকে নির্বাচনের পরে ফিরে আসি, শহীদ সাহেব আমাকে একাকী ডেকে বললেন, ‘‘তুমি মন্ত্রিত্ব নেবা কি না ?’’ আমি বললাম, ‘‘আমি মন্ত্রিত্ব চাই না। পার্টির অনেক কাজ আছে, বহু প্রার্থী আছে দেখে শুনে তাদের করে দেন”। শহীদ সাহেব আর কিছুই আমাকে বলেন নাই। (পৃ-২৫৯)।
ভূক্তি-৭৫৭ হক সাহেব শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবকে বলেছেন, ‘‘আমি শেখ মুজিবকে আমার মন্ত্রিত্বে নিব না”। তার উত্তরে শহীদ সাহেব বলেছিলেন, ‘‘আওয়ামী লীগের কাকে নেওয়া হবে না হবে সেটা তো আমি ও ভাসানী সাহেব ঠিক করব; আপনি যখন বলেছেন নান্না মিয়াকে ছাড়া আপনার চলে না, তখন আমরাও তো বলতে পারি শেখ মুজিবকে ছাড়া আমাদের চলে না। সে আমাদের দলের সেক্রেটারি। মুজিব তো মন্ত্রীত্বের প্রার্থী না। এ সকল কথা বললে পাটি থেকে বলতে পারে”। (পৃ-২৬০)।
ভূক্তি-৭৫৮ আমি শহীদ ও ভাসানী সাহেবকে বললাম, ‘‘আমাকে নিয়ে গোলমাল করার প্রয়োজন নাই। আমি মন্ত্রী হতে চাই না। আমাকে বাদ দিলে যদি পুরা মন্ত্রিত্ব গঠন করতে রাজি হয়, আপনারা তাই করেন”। (পৃ-২৬০)।
ভূক্তি-৭৫৯ কর্মী হিসাবে তাঁর মত কর্মী এ দেশে খুব কম জন্ম গ্রহণ করেছেন। রাতদিন সমানভাবে পরিশ্রম করতে পারতেন। তাঁকে অনেকে Evil Genius বলে থাকেন। যদি ভাল কাজে তাঁর বুদ্ধি ও কর্মশক্তি ব্যবহার করতেন তাহলে সত্যিকারের দেশের কাজ করতে পারতেন। – (ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) সাহেব। (পৃ-২৬১)।
ভূক্তি-৭৬০ আমি ও মাওলানা সাহেব জনসভা করতে মফস্বলে বের হয়ে গেছি। আমাদের প্রোগ্রাম জানা ছিল অফিসের। হক সাহেব আতাউর রহমান সাহেব ও মানিক ভাইকে বলেছেন যে, আমাকে মন্ত্রী করতে চান। মাওলানা সাহেব ও আমি টাঙ্গাইলে এক কর্মী সম্মেলনে বক্তৃতা করছিলাম। এই সময় টাঙ্গাইলের এসডিও একটা রেডিওগ্রাম নিয়ে সভায় হাজির হলেন। আমাকে জানালেন, প্রধানমন্ত্রী আমাকে ঢাকায় যেতে অনুরোধ করে রেডিওগ্রাম পাঠিয়েছেন। আমি মাওলানা সাহেবের সাথে পরামর্শ করলাম। মাওলানা সাহেব বললেন, ‘‘দরকার হলে তোমাকে মন্ত্রিসভায় যোগদান করতে হবে। তবে শহীদ সাহেবের সাথে পরামর্শ করে নিও- এসময় এইভাবে মন্ত্রিত্বের যাওয়া উচিত হবে কি না ? বোধ হয় হক সাহেবের দল কোনো মুশকিলে পড়েছে, তাই ডাক পড়েছে। (পৃ-২৬২)।
ভূক্তি-৭৬১ আমি সন্ধার দিকে ঢাকায় ফিরে এলাম। বাসায় যেয়ে দেখি রেণু ছেলে মেয়ে নিয়ে গত কাল ঢাকায় এসেছে। সে এখন ঢাকায়ই থাকবে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বন্দোবস্ত হওয়া দরকার। আমি খুশিই হলাম, আমি তো মোসাফিরের মত থাকি। সে এসে সকল কিছু ঠিকঠাক করতে শুরু করেছে। আমার অবস্থা জানে, তাই বাড়ি থেকে কিছু টাকাও নিয়ে এসেছে। আমি হক সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি বললেন, ‘‘তোকে মন্ত্রী হতে হবে। আমি তোকে চাই, তুই রাগ করে ‘না’ বলিস না। তোরা সকলে বসে ঠিক কর কাকে কাকে নেওয়া যেতে পারে”। আমি তাঁকে বললাম, ‘‘আমাদের তো আপত্তি নাই। শহীদ সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাঁর অনুমতি দরকার। আর মাওলানা সাহেব উপস্থিত নাই, তাঁর সাথেও আলোচনা করতে হবে”। (পৃ-২৬২, ২৬৩)।
ভূক্তি-৭৬২ ১৯৫৪ সালের মে মাস। আমরা সকলে শপথ নিতে সকাল নয়টায় লাটভবনে উপস্থিত হলাম। আমাদের যখন মন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়া শেষ হল, ঠিক সেই সময় খবর এল আদমজী জুট মিলে বাঙ্গালি ও অবাঙ্গালি শ্রমিকদের মধ্যে ভীষণ দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু হয়েছে। আমরা যখন শপথ নিচ্ছি ঠিক সেই মুহূর্তে দাঙ্গা শুরু হওয়ার কারণ কি ? বুঝতে বাকি রইল না, এ এক অশুভ লক্ষণ! হক সাহেব আমাদের নিয়ে সোজা রওয়ানা করলেন আদমজী জুট মিলে। (পৃ-২৬৩)।
ভূক্তি-৭৬৩ ড্রাইভাররা ভাগতে চেষ্টা করছিল। আমি হুকুম দিলম, ভাগতে চেষ্টা করলেই গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দিব। আমার মেজাজ দেখে তারা ভয় পেয়ে গেল। ঢাকায় টেলিফোন করা হয়েছে, এ্যাম্বুলেন্স পাঠাবার জন্য। মোহন মিয়া ও আমি সকাল এগারটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় তিনশতের মত আহত লোককে হাসপাতালে পাঠাতে পেরেছিলাম। সন্ধ্যার একটু পূর্বে আমি সমস্ত এলাকা ঘুরে মৃত লাশের হিসাব করলাম একটা একটা করে গণনা করে, তাতে পাঁচশতের উপর লাশ আমি স্বচক্ষে দেখলাম। আরও শ’খানেক পুকুরের মধ্যে আছে, তাতে সন্দেহ নাই। (পৃ-২৬৪)।
ভূক্তি-৭৬৪ সামান্য একটা ঘটনা নিয়ে এই দাঙ্গা শুরু হয়। তিনি দিন পূর্বে এক অবাঙ্গালি দারোয়ানের সাথে এক বাঙ্গালি শ্রমিকের কথা কাটাকাটি ও মারামারি হয়। তাতে বাঙ্গালি শ্রমিকের এক আঘাতে হঠাৎ দারোয়ানটা মারা যায়। এই নিয়ে উত্তেজনা ও ষড়যন্ত্র শুরু হয়। দারোয়ানরা সবাই অবাঙ্গালি। আর কিছু সংখ্যক শ্রমিকও আছে অবাঙ্গালি। এই ঘটনা নিয়ে বেশ মনকষাকষি শুরু হয়। মিল কর্তৃপক্ষ অবাঙ্গালিদের উসকানি দিতে থাকে। মিল অফিসে কালো পতাকা ওড়াতে অনুমতি দেয়। (পৃ-২৬৪)।
ভূক্তি-৭৬৫ ঢাকায় যেয়ে দেখি কি হয়েছে! চিফ মিনিস্টার নিশ্চয়ই মত দিয়েছেন। আমরা সোজা চিফ মিনিস্টারের বাড়িতে পৌঁছালাম। যেয়ে শুনতে পারলাম, তিনি আমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। চিৎকার করে সকলের সাঙ্গে রাগারাগি করছেন, আমাকে কেন দাঙ্গা এরিয়ায় রেখে সকলে চলে এসেছে। আমি তাঁর কাছে গেলে তিনি আমাকে খুব আদর করলেন। আমাকে বললেন, ‘‘ক্যাবিনেট মিটিং এখনই হবে, তুমি যেও না”। রাত সাড়ে দশটায় ক্যাবিনেট মিটিং বসল। অবদুল লতিফ বিশ্বাস সাহেব মিলিটারিকে কেন ভার দেওয়া হয়েছে তাই নিয়ে চিৎকার করছেন। হক সাহেব আসলেন। এরপর ক্যবিনেট আলোচনা শুরু হল। অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়, সে কথা আমার পক্ষে বলা উচিত না কারণ ক্যাবিনেটে মিটিংয়ের খবর বাইরে বল উচিত না। (পৃ-২৬৫)।
ভূক্তি-৭৬৬মিটিং শেষ হবার পর যখন বাইরে এলাম, তখন রাত প্রায় একটা। দেখি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ভক্ত কলকাতার পুরানা মুসলিম লীগ কর্মী রজব আলী শেঠ ও আরও অনেক অবাঙ্গালি নেতা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁরা আমাকে বললেন, এখনই ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বের হতে। খবর রটে গেছে যে, বাঙ্গলিদের অবাঙ্গালিরা হত্যা করেছে। যে কোনো সময় অবাঙ্গালিদের উপর আক্রমন হতে পারে। তাড়াতাড়ি রজব আলী শেঠ ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে আমি বেড়িয়ে পড়লাম। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিড় জমে আছে তখন পর্যন্ত। আমি গাড়ি থেকে নেমে বক্তৃতা করে সকলকে বুঝাতে লাগলাম এবং অনেকটা শান্ত করতে সক্ষম হলাম। রাত চার ঘটিকায় বাড়িতে পৌঁছালাম। শপথ নেওয়ার পরে পাঁচ মিনিটের জন্য বাড়িতে আসতে পারি নাই। আর দিনভর কিছু পেটেও পড়ে নাই। দেখি রেণু চুপটি করে না খেয়ে বসে আছে, আমার জন্য। (পৃ-২৬৬)।
ভূক্তি-৭৬৭ যুগ যুগ ধরে পুঁজিপতিরা তাদের শ্রেণী স্বার্থে এবং রাজনৈতিক কারণে গরিব শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গাহাঙ্গামা, মারামারি সৃষ্টি করে চলেছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আদমজী মিলের মালিক গুল মোহাম্মদ আদমজী এসব জানতেন কি না সন্দেহ! (পৃ-২৬৬)।
ভূক্তি-৭৬৮ পরের দিন আবার আমি আদমজী জুটমিলে যাই এবং যাতে শ্রমিকদের খাবার ও থাকার কোন কষ্ট না হয় তার দিকে নজর দিতে সরকারি কর্মচারীদের অনুরোধ করি। সেক্রেটারিয়েটে যেয়ে চিফ সেক্রেটারিকে ডেকে তাঁর সঙ্গে আলাপ করলাম। ঐদিকে কাকে কোন মন্ত্রণালয় দেওয়া হবে তাই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সেখানেও ষড়যন্ত্র আরম্ভ হয়েছে। আওয়ামী লীগারদের যেন ভাল দপ্তর দেওয়া না হয় সে চেষ্টা চলছে। (পৃ-২৬৬)।
ভূক্তি-৭৬৯ মোহন মিয়া সাহেবই হক সাহেবের সাথে পরামর্শ করে উল্টাপাল্টা করতে লাগলেন। আমি হক সাহেবকে বললাম, ‘‘এ সমস্ত ভাল লাগে না, দরকার হয় মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে যাব”। পরের দিন দফতর ভাগ করা হল। আমাকে কো-অপারেটিভ ও এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট দফতর দেওয়া হল। এগ্রিকালচার আবার আলাদা করে অন্যকে দিল। জনাব সোবহান সিএসপি, দফতর ভাগ বাটোয়ারা করতে মোহন মিয়াকে পরামর্শ দিতেছিল। আমি তাঁকে ডেকে বললাম, ‘‘আপনি আমাকে জানেন না, বেশি ষড়যন্ত্র করবেন না”। (পৃ-২৬৭)।
ভূক্তি-৭৭০ আমি হক সাহেবের কাছে আবার হাজির হয়ে বললাম, ‘‘নানা, ব্যাপার কি ?এ সমস্ত কি হচ্ছে, আমরা তো মন্ত্রি হতে চাই না। আমাদের ভিতরে এনে এ সমস্ত ষড়যন্ত্র চলছে কেন? ’’ তিনি আমাকে ডেকে বলবেন, ‘‘করবার দে, আমার পোর্টফলিও তোকে দিয়ে দেব, তুই রাগ করিস না, পরে সব ঠিক করে দেব”। (পৃ-২৬৭)।
ভূক্তি-৭৭১ বৃদ্ধলোক, তাঁকে আর কি বলব, তিনি আমাকে খুব ¯েœহ করতে শুরু করেছেন। দরকার না হলেও আমাকে ডেকে পাঠাতেন। তিনি খবরের কাগজের প্রতিনিধিদের বলেছেন, ‘‘আমি বুড়া আর মুজিব গুড়া, তাই ওর আমি নানা ও আমার নাতি’’। আমি সকলের চেয়ে বয়সে ছোট। আর হক সাহেব সকলের চেয়ে বয়সে বড়। তিনি আমাকে যে কাজই করতে বলতেন, আমি করতে লাগলাম। তাঁর মনটা উদার ছিল, যে কারনে তাঁকে আমি ভক্তি করতে শুরু কলাম। যড়যন্ত্রকারীরা যখন তাঁর কাছে না থাকত তখন তিনি উদার ও অমায়িক। খুব বেশি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, তাই এদের উপর তার নির্ভর করতে হত। কিন্তু যেভাবে তিনি আমাকে স্নেহ করতে অরম্ভ করেছিলেন আমার বিশ্বাস হয়েছিল এদের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করা যাবে। আমি অফিসে যেয়ে ঐ ডিপার্টমেন্ট কি বুঝতে চেষ্টা করলাম, কারণ ডিপার্টমেন্ট সম্বন্ধে আমার বিশেষ কোনো ধারণা ছিল না। এই সময়ে মন্ত্রীরা সরকারি বাড়িতে উঠে এল, আমিও ঢাকার মিন্টো রোডে সরকারি ভবনে ছেলেমেয়ে নিয়ে উঠলাম। (পৃ-২৬৭)।
ভূক্তি-৭৭২ দু’একদিন পরই হক সাহেব আমাকে বললেন, ‘‘করাচি থেকে খবর এসেছে, আমাকে যেতে হবে। তুই ও আতাউর রহমান আমার সাথে চল। নান্না, মোহন মিয়া ও আশরাফউদ্দিন চৌধুরীও যাবে, বেটাদের হাভভাব ভাল না”। আমি প্রস্তুত ছিলাম, কারণ আমাকে যেতেই হত। শহীদ সাহেব অসুন্থ হয়ে আছেন, তাঁকে দেখতে। আমরা করাচি পৌঁছালাম। (পৃ-২৬৭)।
ভূক্তি-৭৭৩ কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটের সাথে আলোচনা হওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া আমাদের তাঁর রুমে নিয়ে বসতে দিলেন। হক সাহেবও আছেন সেখানে। মোহাম্মদ আলী বেয়াদবের মত হক সাহেবের সাথে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করছিল। এমন সময় মোহাম্মদ আলী আমাকে বললেন, ‘‘কি মুজিবর রহমান, তোমার বিরুদ্ধে বিরাট ফাইল আছে আমার কাছে”। এই কথা বলে, ইয়াংকিদের মত ভাব করে পিছন থেকে ফাইল এনে টেবিলে রাখলেন, আমি বললাম, ‘‘ফাইল তো থাকবেই, আপনাদের বদৌলতে আমাকে তো অনেক জেল খাটতে হয়েছে। আপনার বিরুদ্ধে একটা ফাইল প্রাদেশিক সরকারের কাছে আছে”। তিনি বললেন, ‘‘এর অর্থ”। আমি বললাম, ‘‘যখন খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেব ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন তখন আপনাকে মন্ত্রী করেন নাই। আমরা যখন ১৯৪৮ সালে প্রথম বাংলা ভাষার আন্দোলন করি, তখন আপনি দুইশত টাকা চান্দা দিয়েছিলেন, মনে আছে আপনার? পুরানা কথা অনেকেই ভুলে যায়”। হক সাহেব ও সৈয়দ আজিজুল হক সাহেব দেখলেন হাওয়া গরম হয়ে উঠেছে। তখন বললেন, ‘‘এখন আমরা চলি, পরে আবার আলাপ হবে”। আমি এক ফাঁকে হক সাহেবের সাথে যে সে বেয়াদবের মত কথা বলেছিল, সে সম্বন্ধেও দু’এক কথা শুনিয়ে দিয়েছিলাম। (পৃ-২৬৮)।
ভূক্তি-৭৭৪ আমি অসুস্থ সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে দেখতে গেলাম। শহীদ সাহেব বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না, কথা বলতেও কষ্ট হয়। ডাক্তার বাইরের লোকের সাথে দেখা করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। আমাকে দেখে তিনি খুব খুশি হলেন। বেবী (শহীদ সাহেবের একমাত্র মেয়ে) আমাকে বলে দিয়েছিল, রাজনীতি নিয়ে আলাপ যেন না করি। তিনি আস্তে আস্তে আমার কাছে রাজনীতি বিষয়েই জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। আমি দু’এক কথা বলেই চুপ করে যাই। তিনি শেষ পর্যন্ত বললেন, ‘‘বিরাট খেলা শুরু করেছে মোহাম্মদ আলী ও মুসলিম লীগ নেতারা”। (পৃ-২৬৮)।
ভূক্তি-৭৭৫ হক সাহেব আমাকে বললেন, ‘‘গভর্ণর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ তাঁর সাথে আমাদের দেখা করতে অনুরোধ করেছেন”। আমরা বড়লাটের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। তিনি যে কামরায় শুয়ে শুয়ে দেশ শাসন করতেন, সেই ঘরেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হল। তিনি খুবই অসুস্থ। হাত-পা সকল সময়ই কাঁপে। কাথাও পরিস্কার করে বলতে পারেন না। তিনি হক সাহেবের সাথে আলাপ করলেন। আমার নাম ধরে জিজ্ঞাসা করলেন, উপস্থিত আছি কি না ! হক সাহেব আমাকে দেখিয়ে দিলেন। আমি আদাব করলাম। তিনি আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বসালেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘লোকে বলে, আপনি কমিউনিস্ট, একথা সত্য কি না ? আমি তাঁকে বললাম, ‘‘যদি শহীদ সাহেব কমিউনিস্ট হন, তাহলে আমিও কমিউনিস্ট। আর যদি তিনি অন্য কিছু হন তবে আমিও তাই”। তিনি হেসে দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, ‘‘আপনি এখনও যুবক, দেশের কাজ করতে পারবেন। আমি আপনাকে দোয়া করছি। আপনাকে দেখে আমি খুশি হলাম”। (পৃ-২৬৮)।
ভূক্তি-৭৭৬ আমরা পরের দিনই খবর পেলাম পূর্ব বাংলায় গভর্ণর শাসন দিবে; মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিবে, এই নিয়ে আলোচনা চলছে। কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলা সরকারের চিফ সেক্রেটারি জনাব ইসহাক সাহেবকে আদেশ দিয়েছে, যাতে আর পূর্ব বাংলায় আসতে না পারি- যাতে আমাদের প্লেনের টিকিট করতে না দেওয়া হয়। তিনি অঙ্গীকার করলেন এই বলে যে, ‘‘এখনও তাঁরা মন্ত্রী। আইনত তিনি আমাদের আদেশ মানতে বাধ্য”। এটা না করার ফল হিসাবে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং অনেক দিন পর্যন্ত ছুটি ভোগ করতে বাধ্য করেছিল। (পৃ-২৬৯)।
ভূক্তি-৭৭৭ আমি ও আতাউর রহমান সাহেব এ খবর পেয়েছিলাম। তাই হক সাহেবকে যেয়ে বললাম, ‘‘আমরা আজই ঢাকা রওয়ানা করব। কারণ, আজ যেতে না পারলে আরও কয়েকদিন থাকতে হবে। প্লেনের টিকিট পাওয়া যাবে না”। (পৃ-২৬৯)।
ভূক্তি-৭৭৮ আমরা টিকিট করতে হুকুম দিয়ে শহীদ সাহেবের কাছে উপস্থিত হলাম। তাঁকে কিছু কিছু বললাম। তিনি অতি কষ্টে আমাকে বললেন, ‘‘দু’একদিনের মধ্যে চিকিৎসার জন্য আমাকে জুরিখ যেতে হবে, টাকার অভাব হয়ে পড়েছে”। আমি বললাম, ‘‘ঢাকা যেয়ে কিছু টাকা বেবীর কাছে পাঠিয়ে দিব”। মনে মনে দুঃখ করলাম, আর ভাবলাম, যে লোক হাজার হাজার টাকা উপার্জন করে গরিবকে বিলিয়ে দিয়েছেন আজ তাঁর চিকিৎসার টাকা নাই, একেই বলে কপাল! (পৃ-২৬৯)
ভূক্তি-৭৭৯ বোধহয় ২৯ শে মে হবে, আমরা রাতের প্লেনে রওয়ানা করলাম। দিল্লি কলকাতা হয়ে ঢাকা পৌঁছাবে বিত্তএসি প্লেন। আমাদের সাথে চিফ সেক্রেটারী হাফিজ ইসহাক ও আইজিপি শামসুদ্দৌহা সাহেব ঢাকা রওয়ানা করলেন। দোহা সাহেব কেন এবং কার হুকুমে করাচি গিয়েছিলেন আমার জানা ছিল না। হক সাহেব পরে আমাকে বলেছেন, তিনিই হুকুম দিয়েছেন। কলকাতা পৌঁছাবার কিছু সময় পূর্বে জনাব দোহা হক সাহেবকে যেয়ে বললেন, ‘‘স্যার আমার মনে হয় আপনার আজ কলকাতা থাকা উচিত। কি হয় বলা যায় না, এদের হাভভাব ভাল দেখলাম না। রাতেই ইস্কান্দার মির্জা এবং এন এম খান ঢাকায় মিলিটারি প্লেনে রওয়ানা হয়ে গেছেন। ঢাকা এয়ারপোর্ট কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যদি কোনো কিছু না হয়, তবে আগামীকাল প্লেন পাঠিয়ে আপনাদের নেওয়ার বন্দোবস্ত করব”। হক সাহেব সবই বুঝতেন, তিনি নান্না মিয়াকে ও আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘ওদের সাথে আলাপ করুন’’। আমার কাছে দোহা সাহেব এসে ঐ একই কথা বললেন। আমি তাঁকে পরিস্কার বলে দিলাম, ‘‘কেন কলকাতায় নামব ? কলকাতা আজ আলাদা দেশ। যা হয় ঢাকায়ই হবে”। নান্না মিয়াও একই জবাব দিলেন। আমার বুঝতে বাকি রইল না, কেন তিনি গায়ে পড়ে এই পরামর্শ দিতে এসেছেন। তিনি যে এই পরামর্শ দিচ্ছিলেন তা করাচি থেকেই ঠিক করেই এসেছেন। পাকিস্তানি শাসকচক্র দুনিয়াকে দেখাতে চায়, ‘‘হক সাহেব দুই বাংলাকে এক করতে চান, তিনি পাকিস্তানের দুশমন, তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী। আর আমরা তাঁর এই রাষ্ট্রদ্রোহী কাজের সাথী”। (পৃ-২৬৯, ২৭০)।
ভূক্তি-৭৮০ কলকাতা নামবার সাথে সাথে খবরের কাগজের প্রতিনিধিরা হক সাহেবকে ঘিরে ফেলল এবং প্রশ্ন করতে শুরু করল। তিনি মুখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর মুখ বন্ধ, আর আমাকে দেখিয়ে দিলেন। (পৃ-২৭০)।
ভূক্তি-৭৮১ প্রতিনিধিরা আমার কাছে এলে, আমি বললাম, ‘‘এখানে আমাদের কিছুই বলার নাই। যদি কিছু বলতে হয়, ঢাকায় বলা যাবে”। কলকাতা এয়ারপোর্টে আমাদের প্রায় একঘন্টা দেরি করতে হল। আবার দোহা সাহেব এসে বললেন, ‘‘টেলিফোনে করে খবর পেলাম, সমস্ত ঢাকা এয়ারপোর্ট মিলিটারি ঘিরে রেখেছে। চিন্তা করে দেখেন, কি করবেন?’’ আমি তাঁকে বললাম, ‘‘ঘিরে রেখেছে ভাল, আমাদের তাতে কি, আমরা ঢাকায়ই যাব। বিদেশে এক মুহূর্তও থাকব না”। প্লেনে উঠে ভাবলাম, দোহা সাহেব পুলিশে চাকরি করেন, তাই নিজেকে খুবই বুদ্ধিমান মনে করেন। আমরা রাজনীতি করি, তাই এই সামান্য চালাকিটাও বুঝতে পারি না! (পৃ-২৭০)।
ভূক্তি-৭৮২ ঢাকায় এসে দেখলাম, বিরাট জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা সকলের সঙ্গে দেখা করে যার যার বাড়ির দিকে রওয়ানা করলাম। (পৃ-২৭০)।
ভূক্তি-৭৮৩ বাসায় এসে দেখালম রেণু এখনও ভাল করে সংসার পাততে পারে নাই। তাকে বললাম, ‘‘আর বোধহয় দরকার হবে না। কারণ, মন্ত্রিত্ব ভেঙ্গে দিবে, আর আমাকেও গ্রেফতার করবে। ঢাকায় কোথায় থাকবা, বোধহয় বাড়িই চলে যেতে হবে। আমার কাছে থাকবা বলে এসেছিলা, ঢাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ হবে, তা বোধহয় হল না। নিজের হাতের টাকা পয়সাগুলিও খরচ করে ফেলেছ”। রেণু ভাবতে লাগল, আমি গোসল করে ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম করছিলাম। বেলা তিনটায় টেলিফোন এল, কেন্দ্র্রীয় সরকার ৯২ (ক) ধারা জারি করেছে। মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করা হয়েছে। মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে পূর্ব বাংলার গভর্ণর, আর এন. এম খানকে চিফ সেক্রেটারি করা হয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে আতাউর রহমানের বাড়িতে এসে তাঁকে অনুরোধ করলাম ক্যাবিনেট মিটিং ডাকতে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই অন্যায় আদেশ আমাদের মানা উচিত হবে না এবং এটাকে অগ্রাহ্য করা উচিত। তিনি বললেন, কি হবে বুঝতে পারছি না, অন্যদের সাথে পরামর্শ কর। (পৃ-২৭০)।
ভূক্তি-৭৮৪ মন্ত্রীদের পাওয়া গেল না, হক সাহেব দোতলায় বসে রইলেন। আতাউর রহমান সাহেবকে বললাম, ‘‘আপনি দেখেন, সকলকে ডেকে আনতে পারেন কি না ? আমি আওয়ামী লীগ অফিস থেকে কাগজপত্রগুলি সরিয়ে নিয়ে আসি। অফিস তালা বন্ধ করে দিতে পারে”। আমি আওয়ামী লীগ অফিসে যেয়ে দরকারি কাগজপত্র সরিয়ে বের হওয়ার সাথে সাথে অন্য পথ দিয়ে পুলিশ অফিসে এসে পাহাড়া দিতে আরম্ভ করল। (পৃ-২৭১)।
ভূক্তি-৭৮৫ বাড়িতে ফোন করে জানালাম সেখানেও গিয়েছিল। আমি রেণুকে বললাম, ‘‘আবার আসলে বলে দিও শ্রীঘ্র আমি বাড়িতে পৌছাব”। বিদায় নেওয়ার সময় অনেককে বললাম, ‘‘আমি তো জেলে চললাম, তবে একটা কথা বলে যাই, আপনারা এই অন্যায় আদেশ নীরবে মাথা পেতে নেবেন না। প্রকাশ্যে এর বাধা দেওয়া উচিত। দেশবাসী প্রস্তুত আছে, শুধু নেতৃত্ব দিতে হবে আপনাদের। জেলে অনেকের যেতে হবে, তবে প্রতিবাদ করে জেল খাটাই উঁচিত’’। (পৃ-২৭১)।
ভূক্তি-৭৮৬ আমি সরকারি গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রিকশা ভাড়া করে বাড়ির দিকে রওয়ানা করলাম। আমি রিকশায় পৌঁছালাম, তারা বুঝতে পারে নাই। রেণু আমাকে খেতে বলল, খাবার খেয়ে কাপড় বিছানা প্রস্তুত করে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব এহিয়া খান চৌধুরীকে ফোন করে বললাম, ‘‘আমার বাড়িতে পুলিশ এসেছিল, বোধহয় আমাকে গ্রেফতার করার জন্য। আমি এখন ঘরেই আছি গাড়ি পাঠিয়ে দেন”। তিনি বললেন, ‘‘আমরা তো হুকুমের চাকর। গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনি প্রস্তুত হয়ে থাকুন। আপনাকে গ্রেফতার করার জন্য বার বার টেলিফোন আসছে”। আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন ছেড়ে দিলাম। রেণু আমার সকল কিছু ঠিক করে দিল এবং কাঁদতে লাগল। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওদের ওঠাতে নিষেধ করলাম। রেণুকে বললাম, ‘‘তোমাকে কি বলে যাব, যা ভাল বোঝ কর, তবে ঢাকায় থাকলে কষ্ট হবে, তার চেয়ে বাড়ি চলে যাও”। (পৃ-২৭১)।
ভূক্তি-৭৮৭ বন্ধু ইয়ার মোহাম্মদ খানকে বলে গিয়েছিলাম, যদি রেণু বাড়ি না যায় তা হলে একটা বাড়ি ভাড়া করে দিতে। ইয়ার মোহাম্মদ খান ও আল হেলাল হোটেলের মালিক হাজী হোলাল উদ্দিন রেণুকে বাড়ি ভাড়া করে দিয়েছিল এবং তখন দেখাশোনাও করেছিল। কিছুদিন পরই ইয়ার মোহাম্মদ খান রেনুকে নিয়ে জেলগেটে আমার সাথে দেখা করতে আসলে তাঁকেও জেলগেটে গ্রেফতার করে। (পৃ-২৭১)
ভূক্তি-৭৮৮ আধা ঘন্টা পরে গাড়ি এসে হাজির। অনেক লেকেই বাড়িতে ছিল, গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে অনেকেই পালিয়ে গেছে। আমি গাড়িতে উঠে রওনা করলাম। গোপালগঞ্জের অল্প বয়সের এক কর্মী শহিদুল ইসলাম গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছিল। আমি গাড়ি থেকে নেমে তাঁকে আদর করে বুঝিয়ে বললাম, ‘‘কেন কাঁদিস, এই তো আমার পথ। আমি একদিন তো বের হব, তোর ভাবীর দিকে খেয়াল রাখিস”। (পৃ-২৭১, ২৭২)।
ভূক্তি-৭৮৯ শতকরা সাতানব্বই ভাগ জণসাধারণ যেখানে যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিল ও সমর্থন করল, শত প্রলোভন ও অত্যাচারকে তারা ভ্রুক্ষেপ করল না- সেই জনগণ নীরব দর্শকের মত তাকিয়ে রইল! কি করা দরকার বা কি করতে হবে, এই অত্যাচার নীরবে সহ্য করা উচিত হবে কি না, এই সম্বন্ধে নেতৃবৃন্দ একদম চুপচাপ। (পৃ-২৭৩)।
ভূক্তি-৭৯০ একমাত্র আতাউর রহমান খান কয়েকদিন পরে একটা বিবৃতি দিয়েছিলেন। ৯২ (ক) ধারা জারি হওয়ার কয়েকদিন পূর্বে মওলানা ভাসানী বিলাতে গিয়েছেন। শহীদ সাহেব অসুস্থ হয়ে জুরিখ হাসপাতালে, আর আমি তো কারাগারে বন্দি। নীতিবিহীন নেতা নিয়ে অগ্রসর হলে সাময়িকভাবে কিছু ফল পাওয়া যায়, কিন্তু সংগ্রামের সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। দেড় ডজন মন্ত্রীর মধ্যে আমিই একমাত্র কারাগারে বন্দি। যদি ৬ ই জুন সরকারের অন্যায় হুকুম অমান্য করে (হক সাহেব ছাড়া) অন্য মন্ত্রীরা গ্রেফতার হতেন তাহলেও স্বতঃস্ফূর্তবাবে আন্দোলন শুরু হয়ে যেত। দুঃখের বিষয়, একটা লোকও প্রতিবাদ করল না। এর ফল হল ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝতে পারল যে, যতই হৈচৈ বাঙ্গালিরা করুক না কেন, আর যতই জনসমর্থন থাকুক না কেন, এদের দাবিয়ে রাখতে কষ্ট হবে না। পুলিশের বন্দুক ও লাঠি দেখলে এর পালিয়ে গর্তে লুকাবে। এই সময় যদি বাধা পেত তবে হাজার বার চিন্তা করত বাঙ্গালিদের উপর ভবিষ্যতে অত্যাচার করতে। (পৃ-২৭৩)।
ভূক্তি-৭৯১ এই দিন থেকেই বাঙ্গালিদের দুঃখের দিন শুরু হল। অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনো দিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জণগনের সর্বনাশই বেশি হয়। (পৃ-২৭৩)।
ভূক্তি-৭৯২ আইয়ূব খানকে প্রধান সেনাপতি ও ইস্কান্দার মির্জাকে মন্ত্রী করে দেশটাকে আমলাদের হাতে তুলে দেওয়া হল। আইয়ূব খানের মনে উচ্চাকাঙ্খার সৃষ্টি পূর্বেই হয়েছিল। তার প্রমান আইয়ূব খানের আত্বজীবনী ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স’ । তিনি এই বইতে স্বীকার করেছেন যে, ১৯৫৪ সালের ৪ঠা আক্টোবর লন্ডনের হোটেলে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে তাঁর মতামত লিখেছেন। কেন তিনি শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে লিখতে গেলেন? (পৃ-২৭৯)।
ভূক্তি-৭৯৩ মোহাম্মদ আলী ঢাকায় এসে গোপনে হক সাহেবের দলের সাথে বোঝাপড়া করে ফেলেছেন যে, আওয়ামী লীগকে না নিলে তাঁর দলকে পূর্ব বাংলায় সরকার গঠন করতে দিবে এবং শহীদ সাহেব যে কেউই নয় যুক্তফ্রন্টের, একথা ঘোষণা করতে হবে। তা হলেই শহীদ সাহেবকেও দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হবে। মোহাম্মদ আলী জানতেন শহীদ সাহেবই একমাত্র লোক যে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর পদের দাবিদার হতে পারেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে শহীদ সাহেব এত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন যে জনগণ তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চায়। চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা জানতেন, হক সাহেবের দলের সাথে আপোস করলে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বয়ত্বশাসন না দিয়েও পারা যাবে। তবে আওয়ামী লীগ স্বায়ত্বশাসন ছাড়া আপোস করবে না। (পৃ-২৮২, ২৮৩)।
ভূক্তি-৭৯৪ আমি নিজে কিছুতেই তাঁর আইনমন্ত্রী হওয়া সমর্থন করতে পারলাম না। এমনকি মনে মনে ক্ষেপে গিয়াছিলাম। অনেকে আমাকে অনুরোধ করেছিল শহীদ সাহেব রোগমুক্ত হয়ে এসেছেন দেশে, তাঁকে টেলিগ্রাম করতে। আমি বলে দিলাম ‘‘না” কোন টেলিগ্রাম করব না, আমার প্রয়োজন নাই। (পৃ-২৮৩)।
ভূক্তি-৭৯৫ রেণু টেলিগ্রাম পেয়েছে। আব্বার শরীর খুবই খারাপ, তাঁর বাঁচবার আশা কম। ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে রওনা করবে আব্বাকে দেখতে। একটা দরখাস্তও করেছে সরকারের কাছে। টেলিগ্রামটা সাথে নিয়ে। নয়টার সময় আমাকে মুক্তি দেওয়া হল। সহকর্মীদের বিশেষ করে ইয়ার মোহাম্মদ খানকে, ভিতরে রেখে বাইরে যেতে কষ্ট হল। আমি বিদায় নিবার সময় বলে গেলাম, ‘‘হয় তোমরা মুক্তি পাবা, নতুবা আবার আমি জেলে আসব”। (পৃ-২৮৩, ২৮৫)।
ভূক্তি-৭৯৬ জাহাজ ছাড়ার পনের মিনিট পূর্বে আমি নারায়নগঞ্জ ঘাটে পৌঁছালাম। আমাকে দেখে রেণু আশ্চর্য হয়ে গেল। বাচ্চারা ঘুমিয়েছিল। রেণু তাদের ঘুম থেকে তুলল। হাচিনা ও কামাল আমার গলা ধরল, অনেক সময় পর্যন্ত ছাড়ল না, ঘুমালও না, মনে হচ্ছিল ওদের চোখে আজ আর ঘুম নাই। (পৃ-২৮৫)।
ভূক্তি-৭৯৭ মুক্তির আনন্দ আমার কোথায় মিলিয়ে গেছে। কারণ, আব্বার চেহারা চোখে ভেসে আসছিল। শুধু একই চিন্তা। দেখতে পারব কি পারব না ? বেঁচে আছেন, কি নাই !বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়লে রেণু আর আমি অনেকক্ষণ আলাপ করেছিলাম। ভোর রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ি। (পৃ-২৮৫)।
ভূক্তি-৭৯৮ পরের রাতে বাড়িতে পৌছে শুনলাম, আব্বাকে গোপালগঞ্জ নিয়ে গিয়েছে। আব্বা আরোগ্যের দিকে। আব্বা আমাকে পেয়ে আরও ভাল বোধ করতে লাগলেন। পরের দিনই টেলিগ্রাম পেলাম, শহীদ সাহেব আমাকে শীঘ্র করাচিতে ডেকে পাঠিয়েছেন। আতাউর রহমান সাহেব টেলিগ্রাম করেছেন। পরের দিন রাতে আমি খুলনা, যশোর হয়ে প্লেনে ঢাকা পৌঁছালাম। ঢাকা থেকে করাচি রওয়ানা হয়ে গেলাম। আমি মনকে কিছুতেই সান্ত¡না দিতে পারছি না। কারণ, শহীদ সাহেব আইনমন্ত্রী হয়েছেন কেন? রাতে পৌঁছে আমি তাঁর সাথে দেখা করতে যাই নাই। দেখা হলে কি অবস্থা হয় বলা যায় না! আমি তাঁর সাথে বেয়াদবি করে বসতে পারি। পরের দিন সকাল নয়টায় হোটেল মেট্রোপোলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘‘গত রাতে এসেছ শুনলাম, রাতেই দেখা করা উচিত ছিল”। আমি বললাম, ‘‘ক্লান্ত ছিলাম, আর এসেই বা কি করব, আপনি তো এখন মোহাম্মদ আলী সাহেবের আইনমন্ত্রী”। তিনি বললেন, ‘‘রাগ করছ, বোধহয়’’। বললাম, ‘‘রাগ করব কেন স্যার, ভাবছি সারা জীবন আপনাকে নেতা মেনে ভুলই করেছি কি না ?’’ তিনি আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘‘বুঝেছি, আর বলতে হবে না, বিকাল তিনটায় এস, অনেক কথা আছে”। (পৃ-২৮৫, ২৮৬)
ভূক্তি-৭৯৯ আমি বিকাল তিনটায় যেয়ে দেখি তিনি একলা বিশ্রাম করছেন। স্বাস্থ্য এখনও ঠিক হয় নাই; কিছুটা দুর্বল আছেন। আমি তাঁর কাছে বসলাম। অনেকক্ষণ আলাপ করলেন, তার সারাংশ হল গোলাম মোহাম্মদ জানিয়ে দিয়েছেন যে, মন্ত্রিসভায় যোগাদান না করলে তিনি মিলিটারিকে শাসনভার দিয়ে দেবেন। আমি বললাম, ‘‘আমার মনে হয় আপনাকে ট্র্যাপ করেছেন। ফল খুব ভাল হবে না, কিছুই করতে পারবেন না। যে জনপ্রিয়তা আপনি অর্জন করেছিলেন, তা শেষ করতে চলেছেন”। তিনি আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন এবং বললেন, ‘‘কিছু না করতে পারলে ছেড়ে দেব, তাতে কি আসে যায়!’’ আমি বললাম, “এই ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে আপনার যোগদান করা উচিত হয় নাই। আপনি বুঝতে পারবেন”। তিনি আমাকে পূর্ব বাংলায় কখন যাবেন তার প্রোগ্রাম করতে বললেন। আমি বললাম, ‘‘ভাসানী সাহেব দেশে না এলে এবং রাজনৈতিতক বন্দিদের মুক্তি না দিয়ে আপনার ঢাকায় যাওয়া উচিত হবে না”। তিনি রাগ করে বললেন, ‘‘তার অর্থ তুমি আমাকে পূর্ব বাংলায় যেতে নিষেধ করছ”। আমি বললাম, ‘‘কিছুটা তাই”। তিনি অনেক্ষণ চক্ষু বন্ধ করে চুপ করে রইলেন। পরে আমাকে বললেন, আগামীকাল আসতে, ঠিক বিকাল তিনটায়। আমি থাকতে থাকতে দেখলাম, আবু হোসেন সরকার সাহেবকে হক সাহেবের নমিনি হিসাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বে গ্রহণ করা হয়েছে। শহীদ সাহেব কিছুই জানেন না। এবার তিনি কিছুটা বুঝতে পারলেন যে খেলা শুরু হয়েছে। (পৃ-২৮৬)।
ভূক্তি-৮০০ হক সাহেব লাহোরে এক খবরের কাগজের প্রতিনিধির কাছে বলেছেন, সোহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্টের কেউই নন, আমিই নেতা। অথবা আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ যুক্তফ্রন্টে। হক সাহেব কেএসপি’র দলের নেতা। (পৃ-২৮৬)।
ভূক্তি-৮০১ যদিও শহীদ সাহেবের সাথে তাঁর মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করার ব্যাপার নিয়ে একমত হতে পারি নাই, তবু অন্য কেউ তাঁকে অপমান করুক এটা সহ্য করা আমার পক্ষে কষ্টকর ছিল। আমি শহীদ সাহেবকে বললাম, ‘‘যখন হক সাহেব প্রকাশ্যে বলে দিয়েছেন আপনি যুক্তফ্রন্টের কেউই নন, তখন বাধ্য হয়ে প্রমাণ করতে হবে আপনিও যুক্তফ্রন্টের কেউ। কেএসপি ও নেজামে ইসলামী যুক্তফ্রন্টে থাকে থাকুক। আমরা অনাস্থা দেব হক সাহেবের বিরুদ্ধে। তাতে অন্তত আওয়ামী লীগের নেতা হিসাবে তো কথা বলতে পারবেন এবং আওয়ামী লীগ পার্টি পূর্ব বাংলার আইসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠ। আওয়ামী লীগ ছাড়া কারো পূর্ব বাংলায় সরকার চালাবার ক্ষমতা নাই। (পৃ-২৮৭)
ভূক্তি-৮০২ শহীদ সাহেব বললেন, ‘‘যতদিন আওয়ামী লীগ যুক্ত ফ্রন্টে আছে ততদিন তো সত্যিই আমি কেউই নই। হক সাহেব যুক্তফ্রন্টের নেতা, তিনি আওয়ামী লীগ, কেএসপি ও নেজামে ইসলাম পার্টির পক্ষ থেকে কথা বলতে পারেন”। (পৃ-২৮৭)।
ভূক্তি-৮০৩ আমি ঢাকায় ফিরে এসে আতাউর রহমান সাহেব, আবুল মনসুর আহমদ ও মানিক ভাইকে নিয়ে বৈঠকে বসলাম এবং সকল কথা তাঁদের বললাম। শহীদ সাহেবের মতামতও জানালাম। ভাসানী সাহেব কলকাতা এসে পৌঁছেছেন খবর পেয়েছি; কিন্তু কোথায় আছেন জানি না। আতাউর রহমান সাহেব, আবুল মনসুর আহমদ, মানিক ভাই ও আমি অনেকক্ষণ আলাপ-আলোচনা করলাম। হক সাহেবের নেতৃত্বে অনাস্থা দেওয়া হবে কি হবে না, এ বিষয়ে। হক সাহেবের চেয়েও তাঁর কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গই বেশি তৎপর মুসলিম লীগের সাথে কোনো নীতি, আদর্শ ছাড়াই মিটমাট করার। কোথায় গেল একুশ দফা, আর কোথায় গেল জনতার রায়। তিনজনই প্রথমে একটু একটু অনিচ্ছা প্রকাশ করছিলেন। পারা যাবে কি যাবে না এ প্রশ্ন তুলেছিলেন। আমি বললাম, না পারার কোনো কারণ নাই। নীতি বলেও তো একটা কথা আছে। শেষ পর্যন্ত সবাই রাজী হল আমি ওয়াকিং কমিটির সভা অহবান করলাম। (পৃ-২৮৭, ২৮৮)।
ভূক্তি-৮০৪ আমি ও আতাউর রহমান সাহেব বের হয়ে পড়লাম এমএলএদের দস্তখত নিতে। সতের দফা চার্জ গঠন করলাম। হক সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে কে অনাস্থা প্রস্তাব প্রথমে পেশ করবে, সে প্রশ্ন হল। অনেকেই আপত্তি করতে লাগলেন, আমার নিজেরও লজ্জা করতে লাগল। তাঁকে তো আমিও সম্মান ও ভক্তি করি। ঠিক হল, আমিই প্রস্তাব আনব আর জনাব আবদুল গনি বার এট ল’ সমর্থন করবেন। আমরা তাঁর কাছে সভা ডেকে অনাস্থা প্রস্তাব মোকাবেলা করার জন্য অনুরোধ করলাম। তিনিও সভা ডাকতে রাজি হলেন। আমরা আওয়ামী লীগের প্রায় একশত তেরজন সদস্যের দস্তখত নিলাম। তাতেই আমাদের হয়ে গেল। (পৃ-২৮৮)।
নোটঃকিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তাতে কোনো কাজ হয়নি। কারণ, অনাস্থার পক্ষে একশত তেরজন সদস্যের দস্তখত থাকা সত্বেও ফজলুল হকের বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। আওয়ামী লীগের পঁয়ত্রিশজন সদস্য সালাম খানের নেতৃত্বে অনাস্থা প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেন, অপর দিকে অনেকটাই অপ্রত্যাশিত বাবে কৃষক শ্রমিক পার্টি ও নেজামে ইসলামী দলের সদস্যরা জোটবদ্ধ ভাবে ফজলুল হককে সমর্থন করেন। অনাস্থা প্রস্তাব তাই পরাজিত হয়।
(সূত্র: এস.এ.করিম, শেখ মুজিবঃ ট্টায়াম্ফ এ্যান্ড ট্র্যাজেডি, ২য় সংস্করণ, ইউপিএল, ঢাকা, ২০০৯, পৃ-৬৩)।