দুধের নৌকা
রুহুল ইসলাম টিপু
দাদার বাড়ি মান্তা। মানিকগঞ্জের দখিণাঞ্চল। পুটাইল ইউনিয়ন। ঘোস্তা মান্তা দিঘুলিয়া, মধ্যে আছে শিমুলিয়া। ছোট বেলার ছড়া। ঋতুর পরিবর্তনে মান্তার রূপ বদলায়। বর্ষায় চারিদিকে পানি। মাঝে ক্ষুদ্র দ্বীপের ন্যায় পাড়া বেষ্টিত ঘরবাড়ি। চলাচল নৌকায়। থৈ থৈ পানির কলোরব। মেঘ বৃষ্টির খেলা। রাতে জ্যোৎস্নালোক। চিক চিক মৃদু ঢেউ জল। জলমগ্নতায় মুক্তো বিছানো আলোকচ্ছটা। মাঝরাতে নক্ষত্রের ঝিকিমিকি খেলা। ভাটিয়ালি পল্লী গানের সুর। বাওয়া মন্দিরা ঠুমরির সাথে উদাসী বাঁশি। অগ্রহায়ণে নতুন ধানের পিঠাপুলি। ভেজা মাটি জেগে উঠা রবি ফসল। খেসারি কলই সরিষা। মৌসুমি শীতের সব্জি। সবুজ আর হলুদ চাদরের মাঝে মান্তা।

বাবার হাত ধরে চলে আসি বাড়ি। প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তির পূূর্বদিন। সংক্রান্তির দিন জেগে উঠে জয়নগর এবং মান্তা। শুরু হয় পলো বাইচ। মাছ ধরার মহোৎসব। ধর্ম জাল, ঝাঁকি জাল, টেটা, কুচ, টানা জাল, গামছা, পলো কত কি। যার যা আছে তাই নিয়ে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রথমে জয়নগরের জলাশয়ে। এরপর মান্তার সকল পুকুর ও ডুবায়। পৌষ মাঘের শীত। এর মধ্যে পানিতে নামা। ডুব দিয়ে মাছ ধরা। সকলের অংশগ্রহণ। সাজ সাজ রব। প্রাণের উচ্ছ্বাসে শীত সরে যায় দূরে। মুহুর্মূহ শব্দে চলে আসে ছন্দ। হে হে হেই সুর। সাথে পানির ছপাৎ ছপাৎ জলকেলির আওয়াজ। বাইচ এগিয়ে যায়। লাইন ধরে জয়নগরের পশ্চিম প্রান্ত থেকে শুরু হয় পলো বাইচ। শেষ হবে পূবে। বাইচ চলে আসবে মান্তায়। শুরু হয় দক্ষিণ পাড়া হতে। শেষ হবে বায়লারার উত্তর পাড়া পর্যন্ত। থর থর করে শীতে কেঁপে উঠি। শীতকে আলিঙ্গন করে বাইচের আনন্দভোগ। পলো বাইচ হতে নিজেকে সরিয়ে রাখা দায়। পলোর নীচে মাছ। হাত দিয়ে ধরতে, হতে হবে কৌশলী। আমি আনাড়ি। ধরি তো হারাই। পেয়ে হারানোর বেদনাই আমার সাথী। স্মৃতি বড়ই মধুর। মাঘের প্রথম দিন ঘোড়া-গরু দাবড়ানির মেলা। এর দুদিন পর মহান সাধক হযরত শাহ কানু প্রামানিক (রহঃ) এর বার্ষিক উরস। সকল আয়োজনে সামিল গ্রামের ছোট বড় আবাল বৃদ্ধ বণিতা। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে চলে আসেন ইষ্টি কুটুম। মেয়ে, জামাই, বিয়াই, বিয়াইন, তালই, তালই মা সকলকে নিয়ে মান্তা হয়ে উঠে সাজ সাজ কোলাহলমূখর পূর্ণতায়। এ সময় মান্তায় ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি জন সমাগম ঘটে। বিশেষ করে মান্তার পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা এবং যত্রতত্র পয়ঃনিস্কাশন। গ্রামবাসী হুমকিতে পড়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। তবে সানন্দে মান্তা গ্রহণ করে প্রতিকূল সকল কষ্ট। বার্ষিক ওরস এবং পৌষ সংক্রান্তির মেলাকে কেন্দ্র করে চলে আসেন প্রচুর সাধু সাধ্বী। পূণ্যতায় ভরে উঠে মান্তা। চলে বিচার গান, মুর্শিদী, মারফতি, ফকিরীসহ বিভিন্ন ভাব তত্ত্বগানের বিচিত্র পরিবেশনা। গ্রামবাসী ভুলে যায় খাওয়া দাওয়া, গোসল স্নান, স্বাভাবিক সকল কর্ম। মত্য হয়ে উঠেন অতিথি আপ্যায়নে এবং দেশের মানুষের তরে মান্তাকে তুলে ধরতে। নিজেদের সর্বোচ্চ ত্যাগকে উৎসর্গকে করেন। মান্তার উৎকর্ষ উপস্থাপনায়।
আমার বয়স বাড়ে। কৌতুহলের সীমা পরিসীমার বৃত্তও বাড়তে থাকে। বাবার নিকট হতে শুনেছি এ গ্রামের কয়েক শত বছরের ইতিহাস। পৌষ সংক্রান্তি মেলা এবং ওরস উভয়েই চলে আসছে শত-বর্ষ ধরে। ওরস শরীফে প্রচুর দুধ চলে আসে। ভক্ত আশেকান সকল ধর্মের মানুষ দুধ, চাল, মুরগী, ছাগল, ডাল নানাবিধ খাদ্য সামগ্রী যার যা মনে চায় তাই নিয়ে চলে আসেন। টাকা পয়সাও ঢুকানো হয় সিন্ধুকে। এতো যেমন তেমন বিষয় নয়, বেশ বড়ো সড় আয়োজন। এতো মানুষের আনাগুনা দেখে আমি বিস্মিত হয়ে পড়ি। মানুষকে দল বেঁধে সামাল দেওয়াও গ্রামবাসীর জন্য বৃহৎ এক চ্যালেঞ্জ। শীতের খেজুড়ের গুড়ের সমাহারের উচ্চতাও বেঁড়ে যায়। আমার একেক কাকা একেক স্থানে দায়িত্বপ্রাপ্ত। বাবাকেও দেখি তদারকির কর্তব্যে নিযুক্ত হতে। চাচাতো ভাইয়েরাও ওরসকে সফল করতে কাজে যোগ দেন বিভিন্ন অংশে। এভাবেই সকল গ্রামবাসী নিজেদের আত্ম উৎসর্গ করেন এ কর্মে।

ছোট স্কুল পড়ুয়া আমি শুধুই তাকিয়ে থাকি। সবই হচ্ছে নির্ধারিত নিয়মে। অবাক করা শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে মানুষ মাঝার জিয়ারত এবং শিরনী গ্রহণ করেন। ক্ষীর রান্না হচ্ছে বড় বড় পাত্রে। খাবার দেওয়া হয় কলা পাতায়। নিজ গ্রাম ছাড়াও বিভিন্ন গ্রাম হতে কলা পাতা সংগ্রহ করা হয়। ক্ষীর রাখা হয় মাটির বড় বড় পাত্রে। কলা পাতায় তুলে দেওয়া হয় মাটির হাতা দিয়ে। সেসব যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করা হয় বেশ পূর্ব হতে। আয়োজন চলে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি। এমনকি রাতেও আসতে থাকে মানুষের ঢল। গ্রামের সকল সরু পথ আজকের দিনের জন্য হয়ে যায় মান্তামূখী। গ্রামবাসীর বুদ্ধিমত্তা এবং দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যাবতীয় বাঁধা দূর করে এ আয়োজনকে সফল করা হয়। মাঠে পূর্বেই দাগ কেটে রাখা হয়। মানুষ সারিবদ্ধভাবে বসে পড়েন। এরপর সারাদিন ব্যাপী পরিবেশন করা হয় খেজুড়ের গুড়ের ক্ষীর। দুধ চলে আসে প্রচুর পরিমাণে। সাধারণ পাত্রে রাখা সম্ভব হয়ে উঠে না। গ্রামবাসী পূর্বাহ্নেই বেশ কিছু নৌকা ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে রাখেন। নৌকার মধ্যে দুধ। সারি সারি নৌকা। উপরে পাটাতন নেই। নীচে খোল। পুরো নৌকায় দুধ। এ এক অভিনব দৃশ্য। জ্ঞান হওয়ার পর এ দৃশ্য দেখছি। নিজ গ্রামে এমন দুধের নৌকা দেখে হয়েছি অভিভূত। খুঁজেছি অন্যত্র। পৃথিবীর কোথাও পাইনি। দুধের নৌকা। সে তো আছে শুধুই মান্তায়।
মান্তার ঐতিহ্য সংস্কৃতি ধরে রাখার অগ্রজ অনেকেই আজ অতীত। বাবাও আজ নেই। বাবার বন্ধুরা নেই। মান্তার চেনা মুখ। যাদের হাত ধরে চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখেছি। তাঁদেরকে হারিয়ে এখন আমরা পাগলপ্রায়। মান্তার দুধের নৌকার জায়গায় স্থান পেয়েছে ভিন্ন ধরনের বড় রকমের পাত্র। ভুলতে পারিনি, বিস্মৃত হইনি। স্মৃতিতে অম্লান। আমাদের প্রিয় গ্রাম। বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম অধ্যায় মান্তার দুধের নৌকা।
কড়চা/ আর আই টি