আমার জামাইবাবুর চলে যাওয়া ও কিছু স্মৃতিকথা/ শ্যামল কুমার সরকার

আমার জামাইবাবুর চলে যাওয়া ও কিছু স্মৃতিকথা

শ্যামল কুমার সরকার

সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার বাদল কুমার সরকার (২১ আগস্ট ১৯৫৬-৭ ডিসেম্বর ২০২৩) গত ৭ ডিসেম্বর ২০২৩ দুপুর ২টায় আমার দিদি, একমাত্র ভাগনে, ভাগ্নে বউ, দিদিভাই ও আমাদের সবাইকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন! আমাদের পরিবারের সাথে ৪২ বছরের জাগতিক সম্পর্কের অবসান হল!

সেই ১৯৮১ সালের কথা। তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। শুনলাম দিদির বিয়ে হবে। বাড়িতে লোকজন আসবে দিদিকে দেখতে। এসব কিছুই বুঝি না। তখন আমার সময় বয়ে যায় টুকটাক স্কুলে যাওয়া আর বিভিন্ন প্রজাতির পাখির সন্ধানে এ গ্রামে সে গ্রামে। উচু গাছে চড়তে পারা আমার সাথী ডুবলকে নিয়ে চষে বেড়াতাম বাড়ির পার্শবর্তী অঞ্চল। এমনি এক সময়ে হঠাৎ একদিন বাড়িতে অতিথি চলে এলেন। মুরুব্বীরা দিদিকে দেখে গেলেন। পরে পাড়ার ও বাড়ির মুরুব্বীদের (তাঁদের কেউ আর বেঁচে নেই) সাথে আমিও গেলাম পাত্রের বাড়িতে। সময়টাতে কিছুটা শীত শীত। আমন ধান কাটা চলছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা তখন একেবারেই অনুন্নত। গ্রাম থেকে মানিকগঞ্জ শহরে এসে সবাই বাসে বানিয়াজুড়ি নেমে পাত্রপক্ষের বাড়ি গাংডুবি যাই। পড়নে আমার হাফপ্যান্ট। গায়ে সোয়েটার। এক পর্যায়ে আমার হবু জামাইবাবু আমার হাফপ্যান্ট শরীরে ঠিকঠাক করে দিলেন। সে রাত সবাই ঐ গ্রামে কাটিয়ে পরের দিন বাড়িতে ফিরলাম। এর কিছুদিন পরেই দিদির বিয়ের দিন এলো। মনটা খারাপ হতে লাগলো। বরযাত্রীরা এলেন। হৈচৈ এর মধ্যে অগ্রহায়ন মাসে গ্রামের বাড়ি বাঙ্গালায় দিদির বিয়ে হলো। আগেই শুনেছিলাম জামাইবাবু দেখতে সুন্দর, ব্যাংকে চাকুরি করেন। সাক্ষাতে ভালো করে দেখলাম জামাইবাবু সত্যিই সুন্দর। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গোফ আছে। কম কথা বলেন। বিয়ে শেষে চলে এলো বিদায়ের করুণ বেলা। মা-বাবা-দিদি সহ অন্যরা কাঁদছে। আমিও হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। বরপক্ষ আমাদের শান্ত্বনা দিয়ে চলে গেলেন। আমরা যেন একেবারেই নিঃস্ব হয়ে গেলাম।

প্রাইমারিতে পড়ার সময় কিছুদিন দিদি আর আমি একই স্কুলে ছিলাম। দিদি আমার বছর তিনেকের বড়। ও আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতো, আর আমি সুযোগ বুঝে কখনো রাস্তা হতেই আবার কখনোবা স্কুলে হাজিরা দিয়েই পালাতাম। সে সময় দিদিকে নাম ধরে ‘দিপালী’ ডাকতাম। এজন্য মা-বাবার কাছে কম বেশি মারও খেয়েছি। পরে দিদি বলার অভ্যাস রপ্ত করেছি।

বিয়ের পর দিদি-জামাইবাবু আমাদের বাড়িতে আসার দিনগুলোতে আমি সাইকেল চালিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে অনেকটা পথ এগিয়ে যেতাম, কখনও কৈতরা পর্যন্ত বা ছাড়িয়ে। দিদি-জামাইবাবুর রিক্সা দেখেই চেচিয়ে উঠতাম। আনন্দে রিক্সার আগেপিছে সাইকেল চালিয়ে আগেই বাড়ি পৌঁছে দিদির আসার সংবাদ দিতাম। জামাইবাবু মিষ্টি নিয়ে আসতেন। ফল নিতেন। আনন্দে খেতাম। তখন মিষ্টি খাওয়া এখনকার মতো দৈনন্দিন ব্যাপার ছিল না। আমি মা’র কথামতো জামাইবাবুর জন্য পাশের পাড়ার মুসলমান বাড়িগুলো হতে মুরগির ডিম সংগ্রহ করতাম তখন হিন্দু বাড়িতে মুরগি পালন প্রায় হতই না। মাঝে মাঝে জামাইবাবু এজন্য আমার সাথে যেতেন। আমাদের বাড়ির কাছের ধাররার চকের খালে ঝাঁকি জাল দিয়ে জামাইবাবুসহ মাছ ধরেছি। একবার জামাইবাবু বেতিলার রাসের মেলা হতে আমার জন্য একটি লঞ্চ কিনে এনেছিলেন। বালতিতে জল ভরে কত আনন্দে যে সে লঞ্চটি চালিয়েছিলাম তা আজ আর হুবহু লিখতে পারবো না।

কলেজে পড়ার সময় দিদি-জামাইবাবুর মানিকগঞ্জের বাসায় কতবার খেয়েছি। দেবেন্দ্র কলেজের হোস্টেলের খাবার খেতে খুব কষ্ট হতো। যদিও হোস্টেলের হেড রাঁধুনি মনিদা (প্রয়াত মনিলাল সাহা, কলতা) আমাকে খুব আদর করতেন।

কলেজ জীবন শেষে চলে গেলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিশ অনার্স পড়তে। সেখানে বাড়ির সবাইকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হতো। তবুও সময় চলছিল ভালোই। অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা চলাকালে ছাত্রদের গন্ডগোলের কারণে হঠাৎ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। চলে এলাম বাড়িতে। দীর্ঘ বিচ্ছেদের জীবন শেষে তখন সবেমাত্র আমার মা, বাবা, ছোট বোন কবিতা আর আমি একসাথে মানিকগঞ্জে নতুন বাড়িতে থাকতে শুরু করেছি। আগে বাবা একা মানিকগঞ্জে থেকে শিক্ষকতা করতেন। কিন্তু আমাদের আর একসাথে থাকা হলো না। মাত্র এক সপ্তাহের জ্বরে বাবা ১৯৯১ সালের ২৩ আগস্ট হারিয়ে গেলেন চিরতরে। আমরা উদভ্রান্ত-দিশেহারা হয়ে পড়লাম। ছোট বোনের পড়াশুনা ও বিয়ে, আমার পড়াশুনা তখনো শেষ হয়নি। মুরুব্বীদের পরামর্শে এবং দিদি-জামাইবাবুর একান্ত আগ্রহে দিদি-জামাইবাবু তাঁদের ভাড়া বাসা বাদ দিয়ে মা, ছোটবোন এবং আমার দেখ-ভালোর জন্য এলেন। জামাইবাবু আমাদের সংসারের হাল ধরলেন। বাবার টাকা ব্যাংক হতে উঠাতে প্রয়োজন ওয়ারিশান সনদ। এজন্য কোর্টে আমার হাজিরাসহ যাবতীয় কাজ জামাইবাবু করেছেন। বাবার পেনশনের টাকা সহ অন্যান্য পাওনা সরকারের কাছ হতে উঠানোর সমস্ত কাজ জামাইবাবুর তদারকিতে হয়েছে। এ ব্যাপারে আমাকে প্রায় কিছুই করতে হয়নি। ছোট বোনের বিয়েতে (১৯৯৩) জামাইবাবু আমার বড় ভাইয়ের ভূমিকা পালন করেছেন। মার পেনশনের টাকা তোলা হতে শুরু করে দৈনন্দিন বাজার পর্যন্ত জামাইবাবু করেছেন আনন্দে ও দায়িত্ব নিয়ে। রাজশাহীতে নিয়মিত মানি অর্ডার করে আমার ঠিকানায় টাকা পাঠিয়েছেন। তখন মোবাইল ছিলনা। আমার সাথে নিয়মিত পত্র যোগাযোগ করেছেন। আমি অনেকটা নিশ্চিতে রাজশাহীতে পড়াশোনা করেছি। জামাইবাবুর সাথে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রেখেছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে দিদিমা (মার মা) মারা গেলে জামাইবাবু ছুটে গেছেন আমাকে আনতে। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় প্রভাষক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ২০০০ সালে মা’র হার্ট অ্যাটাক হলে জামাইবাবু চলে গেছেন আমার কাছে। দু’বারই জামাইবাবুর সাথে চলে এসেছি বাড়িতে। ২০০১ সালে মার হার্টের অপারেশনে জামাইবাবু আমার সাথে দিদিকে পাঠিয়েছিলেন কোলকাতায়। সেখানে আমরা এক মাস কাটিয়েছি। দিদির সমস্ত খরচ জামাইবাবু বহনের পাশাপাশি আরো খরচ করেছেন। চিকিৎসা শেষে ফেরার দিন জামাইবাবু রিজার্ভ প্রাইভেট কারে আমাদের সেই বেনাপোল সীমান্ত হতে নিয়ে এসেছিলেন।

এক পর্যায়ে আমার রাজশাহীর পর্ব শেষ হলো। আমাদের অনেকটাই গুছিয়ে দিয়ে দিদি-জামাইবাবু চলে গেলেন আবার ভাড়া বাড়িতে। কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না দিদি-জামাইবাবু আর আমার ভাগ্নে সুজিতের চলে যাওয়া। ওদের আরো কিছুদিন থাকতে অনেক বলেছিলাম। যাওয়ার আগে ও পরে অনেক কেঁদেছিলাম। বাস্তবতার কাছে হার মানতে হয়েছিল আমাকে। বার বার মনে হচ্ছিল কেন আমি বড় হলাম (বয়সে)। ছোটই তো ভালো ছিলাম। জামাইবাবু-দিদি এখন নিজেদের তৈরি বাড়িতে থাকেন। আমরা একই পাড়াতে থাকি। খুবই কাছাকাছি। জামাইবাবু সোনালী ব্যাংকে সুনামের সাথে দীর্ঘকাল চাকুরী শেষে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে অবসর নিয়েছেন এবং দিদিকে নিয়ে একমাস তীর্থধাম করে এসেছেন ভারতে। পশু-প্রাণি ভালোবাসেন জামাইবাবু। বিড়ালের জন্য খরচ করেছেন হাজার হাজার টাকা। তিনজন গৃহকর্মীকে নিজ দায়িত্বে বিয়ে দিয়েছেন। ওরা এখন স্বাবলম্বী। তিন মেয়ে-জামাইকে নিমন্ত্রণ করে আনেন। মেয়ে-জামাইরাও জামাইবাবুকে মেসো বলে সম্মান করে। ফল-ফলাদি-মিষ্টি নিয়ে আসে। সামাজিক ও ধর্মীয় কাজে সাধ্যমতো আর্থিক অবদান রেখে চলেছেন জামাইবাবু। ডায়াবেটিস সহ আনুষঙ্গিক কিছু শারীরিক সমস্যা আছে জামাইবাবুর। হাটতে একটু সমস্যা হয়। এজন্য ভারতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি ডাক্তার ভাগ্নে সুজিত কুমার সরকার, বৌমা অনন্যা রায় আর দিদিকে নিয়ে আমার জামাইবাবুর বাকি জীবনটা যেন ভালো কাটে। জামাইবাবুর ঋণ শোধ করার যোগ্যতা আমার এ জীবনে হবে না। কথাটি শুধু বলার জন্যই বলা নয়। এটি আমার বিশ্বাসের কথা। কতবার কত প্রয়োজনে কত টাকা জামাইবাবুর কাছ থেকে নিয়েছি। কখনোই জামাইবাবু না করেননি। সব শোধ করতে পেরেছি বলেও মনে হয় না। মাঝে-মধ্যে জামাইবাবুর সাথে ছোট-খাটো ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। মান-অভিমানও হয়েছে। জামাইবাবু কষ্ট পেয়েছেন। তবে এসব হয়েছে আমার জীবনের গন্ডি বেড়ে যাওয়ার পর (২০০১)। এজন্য খারাপও লেগেছে। কিন্তু কখনোই আমরা হারিয়ে যাইনি। আমার জামাইবাবুর মতো (বাদল কুমার সরকার) জামাইবাবু খুব কমই আছেন।

শেষের দিনগুলি:
২০১৫ তে সোনালী ব্যাংক হতে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ২০১৮ তে পারকিনন্স (শরীর কাঁপা এবং চলাফেরার ক্ষমতা আনেকটাই কমে যাওয়া) ও ডিমেনশিয়া (স্মৃতিশক্তি মারাত্বকভাবে কমে যাওয়া) রোগে আক্রান্ত হন। দেশে ও ইন্ডিয়াতে কয়েকবার চিকিৎসার পরে অনেকটাই স্বস্তি এসেছিল। সবশেষে নভেম্বরের শেষ দিকে হঠাৎ অন্য একটি সমস্যা নিয়ে মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালের কেবিনে আমাকে ও দিদিকে বসেছিলেন, ‘‘এবার মহেশখালী যাব। বেড়াতে গেলে ভালো লাগে। ভেবেছিলাম অবসরের পরে বিভিন্ন জায়গায় রেড়াবো। জানিনা কতদিন হাসপাতালে থাকতে হবে’’। আমি বলেছিলাম, “আগের বার মহেশখালী যাওয়ার সময় সাগরের ঢেউ দেখে ভয় পেয়েছিলেন। সেখানে আবারো যাবেন ? আমি কিন্তু মহেশখালী যাব না, জামাইবাবু।” জামাইবাবু তাপসকে টিকিটের জন্য অগ্রীম জানাতে বলেছিলেন। আগে না বললে ভালো সিট পাবেন না। বলেছিলাম, “ঠিক আছে”। কিন্তু টিকিট আর কাটা হলো না ! এ কথাগুলো প্রায়ই মনে বিড় বিড় করে। আর শুনি অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকার একটি হাসপাতালে যাওয়ার সময় জামাই বাবুর অস্পষ্ট কিছু কথা। অবশেষে লিফ্টে জায়গা না হওয়ায় আমি বাইরে থেকে যাই। জামাইবাবু, দিদি, সুজিত লিফ্টে উঠে যায়। এই তো শেষ দেখা। এর মাত্র দু’দিন পরে ৭ ডিসেম্বর ২০২৩ দুপুরে জামাইবাবু চলে গেলেন অনেক দূরে, বহুদূরে !! যেখান থেকে আর কেউ ফিরে আসে না ! ১৯৮১ হতে ২০২৩। ৪২ বছরের আত্মিক সম্পর্ক ! দূর দূরান্তের বাজার থেকে ইচ্ছেমতো মাছ কেনা, মানুষকে আপ্যায়ন করা এবং বেড়ানো ছিল জামাইবাবুর খুব প্রিয় কাজ। কত সময়, কত কথা, কত স্মৃতি ! কীভাবে ভুলি ? শিশুসুলভ রাগ ছাড়া কখনও জামাইবাবুকে রাগতে দেখিনি। ছোট হিসেবে কখনো হেয়ালি করে আবার কখনোবা না বুঝেইে আপনাকে কষ্ট দিয়েছি। মাফ করে দিবেন, জামাইবাবু ! আর ছুটির দিনে আপনাকে নিয়ে হ্যালোবাইকে ঘুরে বেড়ানো হবে না ! হবে না চলতে চলতে চিপ্স খাওয়া ! জগতের সব কিছুই চলছে, চলবে, শুধু আপনি থাকবেন না !! এমনটা ভাবতেই দু’চোখ ঝাঁপসা হয়ে যায়…ভীষন কষ্ট হয়, জামাইবাবু !! ওপারে ভালো থাকবেন, জামাইবাবু !!!

শ্যামল কুমার সরকার
উপাধ্যক্ষ
এম এ রউফ কলেজ
কৌড়ী, হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ।

কড়চা/ এস কে এস

Facebook Comments Box
ভাগ