দেহ শ্রমিকের গল্প
অপূর্ব চৌধুরী
একসময়ে ঢাকা শহরে একটি পতিতালয় ছিল৷ নাম ইংলিশ রোড৷ এটি পুরান ঢাকায় ছিল৷ অনেক পুরোনো পতিতালয়৷ নব্বইয়ের পর জেহাদি জোশের কিছু এলাকাবাসী পতিতালয়টি ভেঙে দিলো৷ হয়তো একসময়ে তারাই খদ্দের ছিল।
বিপন্ন পতিতারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো শহরের এখানে-ওখানে৷ পেটের দায়ে রমনা পার্ক, সরোয়ার্দী উদ্যান কিংবা তৎকালীন গুলিস্তানে দশ টাকায়ও ঢাকা শহরের ভদ্র লোকেরা তাদের খরিদ্দার হতো৷
কিন্তু তাদের পতিতা বলতে চাই না। তাদের দেহ শ্রমিক বলি। গতর বিক্রি করে খায়। চুরি চামারি করে না। অথচ দুর্নীতিবাজ ঘুষখোর বদমাইশ গুলোকে সমাজ কুর্নিশ করে। লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, ডাক্তার, রাজনীতিক শয়তানগুলো এই দেহ শ্রমিকদের কাছে ঠিকই যায়। দিনের বেলা নিজেদের পেশার অহং-এ ঘুরে বেড়ায়, নিশি হলে দেহ শ্রমিকদের উরুর কাছে নাক ঘষে। দিন হলে পতিতা বলে গালি দেয়, রাত হলে সবিতা বলে বুকের উপকূলে বৈঠা টানে।
উপমহাদেশে রাজা জমিদারদের যৌন ক্ষুধা মেটাতো বাইজিরা৷ তারা একইসাথে সমাজের উঁচু স্তরের প্রতিনিধি করতো, আবার তাদের জন্যে আলাদা সংরক্ষিত ঘর বাড়ি ছিল, রাজা জমিদাররাই তাদের খরপোষ চালাতো৷
উপমহাদেশে বর্তমান আকারে পতিতালয় প্রথম চালু করে ব্রিটিশরা৷ রাষ্ট্রীয় ভাবে আইনের মাধ্যমে এটাকে বৈধতাও দেয় ৷ ‘ক্যান্টনমেন্ট এক্ট ১৮৬৫’ নামে পরিচিত এই আইন৷ এই আইনের আওতায় প্রতিটা ক্যান্টনমেন্টের পাশে একটা সংরক্ষিত এলাকা থাকতো, যেখানে বারো থেকে পনেরোজন নারী রাখা হতো, যাদের সাথে অবাধে ব্যারাকের সৈন্যরা সেক্স করতে পারতো৷ সংরক্ষিত এলাকাটিকে বলা হতো ‘চাখালা’৷ পরবর্তীতে ১৮৯৫-তে আরেকবার আইন পরিবর্তন করে পোর্ট গুলোতে সমুদ্রগামী নাবিকদের যৌন ক্ষুধা মেটাতে বন্দরে বন্দরে পতিতালয় খোলার লাইসেন্স দিলো৷ যা থেকে কলকাতার সোনাগাছি কিংবা নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের জন্ম ৷ নারায়ণগঞ্জ ছিল দেশের সবচেয়ে বড়ো অভ্যন্তরীণ নৌ বন্দর ।
এইসব সংরক্ষিত এলাকায় যৌনতা বেচা কেনার বৈধ সিস্টেম চালু করার পেছনে ব্রিটিশদের নিজস্ব চিন্তা ভাবনা, ইতিহাস জড়িত৷ সতেরো শতাব্দীর দিকে বাণিজ্য এবং যুদ্ধ করতে থাকা আটলান্টিক, ভারত মহাসাগর কিংবা ভূ মধ্যসাগরে ব্রিটিশ শিপগুলোতে দীর্ঘদিন ঘর ছাড়া পুরুষগুলোকে যৌন স্বাদ দেবার জন্যে শুধু মাত্র নারীদের বহনকারী কিছু ছোট ছোট জাহাজ থাকতো, তাদের বলা হতো ফ্লোটিং ব্রোথেল শিপ৷
উপমহাদেশে প্রথম পতিতালয় চালুর পিছনে দেুটো উদ্দেশ্য ছিল৷
এক : ব্রিটিশ সৈন্যরা যাতে দীর্ঘদিন ব্যারাকে থেকে সমকামী না হয়ে যায় ৷
দুই : লোকাল সৈন্যরা যাতে ব্যারাকের বাহিরে যেখানে সেখানে কিংবা আশেপাশের এলাকায় যৌন কাজ করে বিভিন্ন রোগকে না ছড়ায়৷ অথবা বাহির থেকে বিভিন্ন যৌন রোগকে ব্যারাকের ভিতর নিয়ে না আসে।
তখন সংরক্ষিত এলাকায় নারীদের রেখে তাদের প্রতি সপ্তাহে ডাক্তার দিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে সৈন্যদের জন্যে প্রস্তুত রাখা হতো৷
কালের চক্রে চাখালা এখন সমাজের বিভিন্ন জায়গায়। হোটেল, বাসাবাড়ি থেকে লঞ্চে। সৈন্যদের জন্যে ছিল বিজ্ঞানসম্মত প্রয়োজন, কিন্তু এখন তা সমাজের প্রয়োজন। যদিও নারীর দেহ বিক্রির কনসেপ্টটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো শ্রম, তার পক্ষে বিপক্ষে মত থাকতে পারে, কিন্তু মানুষগুলোকে অসম্মানের পক্ষে নই। নিজের রুচির বিপক্ষে হলেও মানুষগুলোর শ্রমের মর্যাদা দেয়া উচিত।
কতটা অসহায় হলে কেউ শরীর বিক্রি করে শরীরের খাবার যোগায়, তাদের অসম্মান মানবিকতার অসম্মান। এই উপলব্ধি না এলে বিদ্যা বুদ্ধির আড়ালে এক একজন কেবল মুখোশ বদমাশ ।
কড়চা/ এ সি