ফিরে দেখা অতীত, জীবন-৬ : মধুসূদন সাহা

ফিরে দেখা অতীত, জীবন-৬

মধুসূদন সাহা

পূর্ব দাশড়া গ্রাম হিন্দু অধ্যুষিত ও বিশাল বড় এলাকা। বেশিরভাগ বাড়িই আয়তনে বেশ বড় বড় যা বর্তমান কালে বিলুপ্ত। আর কিছুদিন পর তা রূপকথার গল্প গাঁথা হবে।

মাধব ঠাকুরের কথা, তার বাড়ির কথা, পরিবারের কথা গত সংখ্যায় ছিল। আসলে পূর্ব দাশড়ার যে চিত্র আমি কল্পনায় এঁকে যাচ্ছি তা পুরানো স্মৃতি থেকে। বর্তমানের বাস্তবতা আমার অজানা। মাধব ঠাকুরের বাড়ি যা ভূতের গলি থেকে লেহাজ ভূঁইয়ার বাড়ি পর্যন্ত একটা ডোবা সহ বিস্তৃত ছিল। তার পূর্বদিকে রাস্তার ওপার থেকে একটা গলিপথ মাধবদেও (পাইনা) বাড়ির মাঝখান দিয়ে নেমে রবি পাল, গজেন্দ্র সাহার বাড়ির মাঝখান দিয়ে খালে যেয়ে মিশেছে। এই গলি পথ ছিল আমাদের কালীখোলা ও বল্লভ বেপারীর পুকুরে স্নান করার পথ। এখান থেকে যদি ফিরে যাই বড় রাস্তার দিকে বাঁদিকের বাড়ি সম্প্রতি প্রয়াত রবি পালদের। প্রান্তিক পরিবার। উনারা তিন ভাই। অরুন পাল দীর্ঘদিন বাজার লোহার পুলের নিকট পিঁয়াজু বিক্রি করত। সুধীর বয়সে একটু বড় হলেও আমাদের খেলার সাথী ছিল। এদের বাবার নাম মনে নেই, কিন্তু উনিও স্কুলে স্কুলে বাড়িতে বানানো খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করত। এই বাড়ির উল্টোদিকে দুটি সাহা বাড়ি। গজেন্দ্র পাল ও অভিমাণ্য পাল। বাজারে পান বিক্রি করত।

একটু এগিয়ে বাদিকে টেপার মার বাড়ি। বিরাট বাড়ি। টেপার মা ছাড়া আর কাউকে দেখিনি। টেপা নাকি ভারত প্রবাসী ছিল। তবে এই বাড়ি আমাদের কাছে বিখ্যাত ছিল একটি বিশেষ কারণে। প্রতি বছর এই বাড়িতে কার্তিক পূজার পরদিন বাল্যসেবা হত নিয়ম করে। আমি এ রকম অনুষ্ঠান আর কোথাও দেখিনি বা শুনিনিও। ঐদিন দুপুরে গ্রামের সকল বালক বালিকারা উনার বিরাট উঠোনে বসে কলাপাতায় খিচুড়ি লাবড়া পায়েশ আস্বাদন করে খেতো। ধনী গরীবের কোন ভেদাভেদ ছিল না। লোকে লোকারণ্য থাকত বিকেল পর্যন্ত। প্রতি বছর যথা সময়ে আমরা ভাই বোনেরা বৈঠকে (মাটিতে সারি সারি বসে খাওয়া) বসে খেয়ে আসতাম।
এখানে আর একটা বিষয় উল্লেখ করার মত যে এই ধরনের বৈঠকে খাওয়ার শেষ দিকে বয়স্ক কিছু লোক ধ্বনি দিত সবাইকে নিয়ে। অনেকটা মিছিলে স্লোগানের মত। অনেকটা এ রকম তিনি জোর গলায় বলতেন, ‘সাধু সাবধান’। বৈঠকের সবাই চিৎকার দিয়ে বলত, ‘হেএএএএএ’। তারপর তিনি জোরগলায় সুর করে বলতেন, ‘চুকাও না, মিঠ্যা ও না, তার নাম দই- নামে নামে নাম মিলিলে তাকে বলে সই’। আমরা জোরে বলতাম, ‘হেএএএএ’।

তারপর মনে হয় এই বলে শেষ দিত, ‘ঢিপ বলাইরে কানাই বলাই ঢিপ ঢিপ হুররে’। আমরা বলতাম, ‘হুরররে’। এতে নাকি আর একটু বেশি খেতে পারেন অতিথিরা। তাই এ ব্যবস্থা। এরকম এখন আর দেখি না।
এরপর ছিল ঘটু পালের বাড়ি। পাশে ছিল খাল পর্যন্ত বিস্তৃত শংকর স্যারের শ্বশুর পঞ্চানন্দ মাস্টারের বাড়ি। উনি দাশড়া গ্রামের অনেক প্রাচীন গৃহশিক্ষক। আজকের আশি উত্তীর্ণরাও উনার ছাত্র ছিলেন। আমরাও উনাকে বৃদ্ধ বয়সে দেখেছি। উনার বেশ কয়েকজন ছেলে মেয়ে ছিল। বড় মেয়ের বর হচ্ছেন শংকর চন্দ্র সরকার। তেরশ্রীর স্কুল শিক্ষক ছিলেন। পরে মত্ত স্কুলে শিক্ষকতা ও গৃহশিক্ষকের দাযয়িত্ব পালন করতেন। তারপর ছিলেন মানিকগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক সেকশনের শিক্ষক। উনি ছিলেন আমাদের সময়কার ও উনার শিক্ষকতা সময়ের মানিকগঞ্জের সবচেয়ে জনপ্রিয় গৃহশিক্ষক। আমরাও বাড়িতে তিনভাই বোন ও শংকর স্যারের ছোট শালী রুনী দিদি একসাথে আমাদের বারান্দায় দীর্ঘ সময় প্রাইভেট টিউশনি নিয়েছি। স্যারের বাড়িতে গিয়েও পড়েছি। আরও অনেক স্মৃতি ও ইতিহাস আছে স্যারকে নিয়ে অন্য জায়গায় বলার চেষ্টা করব। শংকর স্যারের লাগানো বাড়ি নারু কর্মকার (কামার) এর বাড়ি। এদের বাজারে কামারশালা ছিল। সড়কের সাথে লাগানো বাড়ি ছিল কানাই তেলী পালের। এরা অবস্থাপন্ন না হলেও পালেদের মধ্যে উঁচু শ্রেণির বলে শুনেছি। এরা শংকর পালদের আত্মীয় ছিল। কানাই পাল শহরে হাতে তৈরি খাবার বিক্রি করত। এর ছেলে পাগলা সারা শহর ঘুরে ঘুরে। বাড়িতে বানানো সন্দেশ বিক্রি করত। এদের পাশের বড় বাড়ি ছিল মাধব দে, কেশব দে দের। ছোট ঘর আর মাধব দে-কে আমরা দেখেছি। বাড়িতে একটা কালী মন্দির ছিল। মাধব দে বাজারে পান বিক্রি করত বলে মাধব পাইন্যা নামেই আমরা চিনতাম। প্রতিদিন ভোরে কালী মায়ের গান গাইতে গাইতে আমাদের বাড়ি আসত ফুল তুলতে। উনার ভাই কেশব দে মুদী মালের গাওয়াল করত। এদের বাড়ির দুই দিকে ডোবা ছিল। প্রতি বছর গরমের সময় এখানে গণ মাছধরা হত। অন্য সময় বড়শিতে কৈ, জিওল, মাগুর, শোল, টাকি মাছের জন্য বিখ্যাত ছিল। এদের পাশে ছিল প্রসন্ন দের বাড়ি। তার ছিল বাজারে বানিয়াতি ব্যবসা। এ বাড়িতে পরে নিতাই নামে একজন বসবাস করত, তারপর শওকত পেস্কার লিজ নিয়েছিল। তারপর শাহআলম।

এ বাড়ির পাশে হিরু মিস্ত্রি (কাঠ মিস্ত্রি) বসবাস করত পরিত্যক্ত বাড়িতে। অনেক দিন লেহাজ ভূঁইয়ার বাড়ির উল্টোদিকের এই বাড়িতে ছাত্রাবাস ছিল। মত্তের চরের অনেক ছেলে এখানে থাকত। পরে বকজুরি মনুরুদ্দিন মেম্বারের ছেলে পাটা সালাম লিজ নিয়েছিল বলে শুনেছি। এবাড়ির উল্টোদিকে বর্তমান লেহাজ ভুঁইয়ার বাড়ি। ওটা ছিল ছয়ের দশকে আমাদের খেলার মাঠ। তখন কাঁচা সড়কপথ ছিল। সড়ক থেকে অনেকটাই নীচু জায়গা ছিল। বর্ষায় ডোবা হয়ে থাকত কার্তিক মাস অবধি। ভরে থাকত নানান প্রজাতির দেশীয় মাছ ও শাপলা শালুক। জলে শুকালে সবাই মিলে মাঠ পরিস্কার করা হত। তারপর চলতে বিভিন্ন খেলার আয়োজন। সবচেয়ে স্মৃতিমেদুর ঘটনা হচ্ছে স্বাধীনতার বেশ কয় বছর আগে মাঠ পরিস্কার করতে নেমে দেখলাম উওর কোনায় অপেক্ষাকৃত ঢালু জায়গায় এক ফুট পরিমাণ জল আছে। লতাগুল্মে ঢাকা থাকায় বুঝতে পারিনি। একটু পরিষ্কার করতেই ঐ স্বল্প জলে এক কেজির কাছাকাছি রুই কতলার অবিশ্বাস্য লাফালাফি শুরু হলো। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম মাছ ধরার আনন্দে। অপেক্ষাকৃত বড়রা পটাপট ধরতে লাগলো। অনেক কষ্টে আমিও একটা ধরলাম ভ্যাটকা, কাতল আরকি। তারপর মাছ নিয়ে দৌড়ে বাড়িতে। রেখে আবার আসলাম একটা টুকরি (বাঁশের পাত্র) নিয়ে। ততক্ষণে মানুষের মেলা। রাস্তার পাশে হওয়ায় পথচলতি মানুষও নেমে পড়েছে গন্তব্য ভুলে। এ হলো গ্রাম বাংলার সহজাত সংস্কৃতি। কোন ডোবা জলাশয়ে বড় মাছ ধরার পর ছোট মাছ ধরা হত। টুকরি দিয়ে বেশ কিছু ছোট মাছ ধরে অবশেষে বাড়ির পথ ধরলাম। এই জায়গাটা ছিল জীতেন সাহাদের। সুদেব বাবুদের আত্মীয়। এ স্মৃতি এখনও আমার কাছে জ্বল জ্বল করে। মাঠ পরিস্কার এর পর আগামী বর্ষার আগ পর্যন্ত ওখানে ছিল পুরো পাড়ার বাচ্চাদের খেলার কেন্দ্র। এর সাথে ছিল মাধব ঠাকুরের উঠোন। কোথাও গোল্লাছুট, ছিবুড়ি, আমপাক্কি, সাতচাড়া, কিং কং, দাড়িয়াবান্ধা, জাম্বুরার ফুটবল, রুমাল চোর সহ আরও কত কি! আর বড়রা খেলত ব্যাডমিন্টন। এখানে ব্যাডমিন্টন খেলত আমার জেঠাতুতো কলেজ পড়ুয়া দাদা সতীশচন্দ্র সাহা, বাবলু দা, ঐ সময় বুয়েটের ছাত্র পাল বাড়ির প্রকাশ দা, শীল বাড়ির নারু দা, বজলু ভাই ও জামান মঞ্জিলের জামান ভাই সহ আরও অনেকে। তখন এটা বনেদী খেলাই ছিল। রাস্তায় অনেক লোক দাঁড়িয়ে যেত খেলা দেখতে। আমরা অপেক্ষা করতাম কখন উনাদের কর্ক বাতিল হয়। তাছাড়া মাঠের বাইরে কর্ক গেলে আমরা দ্রুত সংগ্রহ করে ফিরিয়ে দিতাম। তারপর আমাদের কোট ছাড়াই কোথাও দড়ি বেঁধে ছোটব্যাটের ব্যাডমিন্টন খেলা চলত। ঐ রকম আনন্দের বিকেল ছিল আমাদের স্বাধীনতা পূর্ব কালীন কিশোর জীবন। ফিরে কি আসবে আর কোনদিন? তাই আর আসে না। ওটা কল্পনা বিলাস। সয়য় সময়ের পথেই রয়। কারুর জন্য অপেক্ষা করার সময়ের সময় নেই।

তারপর ওখানে মাটি ভরাট করে বাড়ি হল, পাশে মাধব ঠাকুরের ভিটে বিক্রি হয়ে বাড়ি হয়ে গেল। আস্তে আস্তে আমাদের বিশাল গলিপথ সংকীর্ণ হল, দুই পাশের দেওয়ালে একটু হাঁটার পথ থাকল। সম্প্রতিক অতীতে সেটা ভূতের গলিতে রূপলাভ করেছে। আজকালকার কিশোর যুবাদের ঘরকুনো বলা হয়। মোবাইল এডিকটেড বলা হয়, কথাটা সত্যি হলেও এটা ভেবে দেখার দরকার যে ওদের খেলে বেড়াবার জায়গাটা কোথায়?
লেহাজ ভূঁইয়া অনেক পরে এ বাড়ি ক্রয় করেন। উনার খুব দুর্নাম থাকলেও উনার পরিবারের সাথে আমাদের খুব সুসম্পর্ক ছিল। উনার ছোটভাই কাইয়ুমও আমার ক্লাসমেট ছিল। জাসদ করত।

এই বাড়ির পশ্চিমে এক বিশিষ্ট হালুইকর ছিল। পরে বাড়িটা পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। এরপর চামারপাড়া সোজা খালপাড় পর্যন্ত একটা ফাঁকা জমি ছিল যোগেন ডাক্তারদের। লেহাজ ভূঁইয়ার বাড়ির পাশে ছিল শশী ডাক্তারের বাড়ি। কি রকম ডাক্তার আমার মনে নেই। উনার থেকে কখনও চিকিৎসা নিয়েছি বলেও মনে পড়ে না। তবে উনি শহরে বসতেন রসরাজ মেডিক্যাল হলে আরেক ডাক্তার রসরাজ সেনের সাথে। বিশাল বড় ঔষধের দোকান ছিল। উল্টোদিকে ছিল নিউ মেডিকেল হল। ওটাও বড় ঔষধের দোকান। ডানদিকে হালুই পট্টি। কমবেশি সবাই মিষ্টির দোকানি ও কারিগর ছিল। তারপর কুমোর পালদের কয়েক ঘর। পেশায় অবশ্য মিষ্টি ব্যবসায়ী ছিলেন। এবাড়ির অনেক ছেলেই শিক্ষিত ছিলেন। এর সাথেই ছিল অনাথ বন্ধুপালের বাড়ি। উনাদের আতশ বাজীর ব্যবসা ছিল। বেনুদা অবশ্য ভাল মোটর মেকানিক্স ছিলেন। এ বাড়ি কাটাখালির পাশে রাস্তার ধার ধরে লেহাজ ভূঁইয়ার বাড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই বাড়ির পূবদিকে রাস্তার ওপারে ছিল ঝোপঝাড়ের মধ্যে দাসু শীলের বিরাট বাড়ি। জমিজমাও ছিল প্রচুর। তবে উনি জাতি ব্যবসা করতেন না। প্রথম জীবনে বাদল সাহার ঘরের ম্যানেজার ছিল। পরে পাশেই পাটির দোকান করতেন। সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছিলেন। তবে কাটাখালির পুল থেকে আমাদের বাড়ির গলি, আজকে ভূতের গলি পর্যন্ত রাস্তা খুবই নির্জন ছিল। তখন কারেন্ট ছিল না। দাশু শীলের বাড়ির দক্ষিণে ঝোপঝাড়ে পূর্ণ ছিল। বিশাল একটা বটগাছ পরিবেশকে ভৌতিক করে তুলেছিল। ওখানে শিয়ালের বাসা ছিল। কোন কারণে সন্ধ্যা হলে এই রাস্তাটা পার হওয়ার জন্য পথসাথীর অপেক্ষা করতাম। অনেকে রাত্রি বেলায় হ্যারিকেন নিয়ে যাতায়াত করত। টর্চ লাইট কাদাচিৎ। সেই আলোতে এই পথটুকু যাতায়াত করতাম। নইলে অজ্ঞাত ভূতের ভয়ে হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ বলে এক দৌড়ে বাড়ি! আমাদের গলিপথও ছিল আরও নির্জন। দাশু শীলের বাড়িতে এই জঙ্গলে একটা বিশাল নারিকেল গাছ ছিল। একটু বড় বেলায় ওখানে আমাদের অনধিকার যাতায়াত ছিল। এতবড় নারিকেল সচরাচর দেখা যায় না। শুধু ওখানে নয় দাশড়া গ্রামের প্রায় সব নারিকেল গাছেই আমার খুব পরিচিত ছিল। (চলবে)

কড়চা/ এম এস

Facebook Comments Box
ভাগ