বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালী জাতির পিতা। আমি বাংলাদেশের নাগরিক। আমার জন্ম এ দেশে। সময়ের হিসেবে তখন এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তানের একটি প্রদেশ। আমার জন্মের বছর ১৯৬৬ সাল। এ বছর বঙ্গবন্ধু ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ৬ দফা হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয়তার অভ্যুদয়ের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল। শুরু হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান। ৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ও সকলকে মুক্তি সংগ্রামের আহ্বান। মুক্তিযুদ্ধে সকল বাংলাদেশীর অংশগ্রহণ। যার মহান নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফলশ্রুতিতে ডিসেম্বরে আমরা পেলাম বিজয় বিশে^র বুকে নতুন মানচিত্র, পতাকা এবং স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। একটি দেশ এবং জাতির জীবনে কিছু বছর থাকে যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। বাঙালীর জীবনে দুটি ব্যতিক্রম বছর ১৯২০ এবং ১৯৭৫। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। এটি উদযাপনের; ২০২০ মুজিব জন্মশতবর্ষ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হন। এটি মহা শোকের; একই বছর বঙ্গবন্ধুর ৪৫ তম শাহাদত বার্ষিকী জাতি পালন করছে।
ব্যক্তিজীবনে পিছনে তাকিয়ে দেখি ১৯৭৫ সাল। আমি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। মানিকগঞ্জ মডেল স্কুলের প্রাইমারি সেকশনে পড়ি। বাবার চাকুরির সুবাদে থাকি বেউথা সরকারি কোয়াটারে। তখনকার বেউথা এবং মানিকগঞ্জ টাউন বেশ দূরই বটে। আমরা চকের আলের রাস্তা, প্রশস্ত মূল সড়ক, স্টেডিয়ামের ভিতর দিয়ে যাতায়াত করি। কোয়াটার ক্যাম্পাসে দুটি ভবন। একটি একতলা দুটি ফ্ল্যাট, যেখান মহকুমা শহরের সরকারি অফিসারদের বাসভবন। অন্যটি দ্বিতল ভবন, আটটি ফ্ল্যাট, সরকারি কর্মচারীদের জন্য। আমরা দ্বিতল ভবনের পূর্ব দিকের নীচ তলায় থাকি।
টেলিভিশন ছিল না। রেডিও ছিল। রেডিওতে বাবা মা সংবাদটি শুনেছেন; আমিও শুনেছি। তখন তেমন বুঝতে পারিনি। আমার বন্ধু বাবু’র আব্বা ইউসুফ কাকা ছিলেন মহকুমা প্রশাসক অফিসের পেসকার। আমি এবং আমরা জাম গাছের নীচে পুকুর পাড়ে বসে আছি। সম্ভবত: ১৬ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখ হবে। ইউসুফ কাকা বাসায় ঢুকছেন। একটি খবরের কাগজ এনে বলছিলেন, বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবার আর নেই। বাকী একটি নাম বলেছিলেন, কলুষিত সেই ঘাতকের নাম আমি উচ্চারণ করতে চাই না।
বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমি ভয়াবহ এ বেদনা ও শোক বহন করছি। আমার দেশের অন্য সকল নাগরিকও এ শোকের বাইরে কেউ নয়। এতো বড় মহাপুরুষকে তুলে ধরার সাধ্য আমার নেই। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর রাজনৈতিক জীবন একটি মহাসমুদ্র। আমি কিছু তুলে ধরতে চেষ্টা করছি। বিশেষ করে তার কারাগারের জীবনের কিছু তথ্য। যদিও ইতোমধ্যে আমাদের হাতে পৌছে গিয়েছে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজনামচা। দেশের জন্য কারাগার, শহীদ, শাহাদাত এর উপর আর কি ত্যাগ থাকতে পারে, সেটা আমার জানা নেই।
১১ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়, সচিবালয়ের সামনে থেকে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালে তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। ২৬ এপ্রিল ১৯৪৯ সালে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অনশন ধর্মঘট পালনরত অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়। জানুয়ারি ১৯৫০ সালে ঢাকায় দুর্ভিক্ষবিরোধী মিছিলের নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় তাঁর দুই বছর জেল হয়েছিল। ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষার দাবি আদায়ের দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্তের সময় শেখ মুজিব জেলে বসে ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন করেছিলেন। ৩০ মে ১৯৫৪ সালে করাচি থেকে ঢাকায় ফেরার পথে বিমান বন্দরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১১ অক্টোবর ১৯৫৮ সালে সকল ধরনের রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধের কারণে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৪ মাস একটানা আটক থাকার পর তাঁকে মুক্তি দেয়া হলেও জেল গেট থেকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়। ০৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ সালে জননিরাপত্তা আইনে তাঁকে পুনরায় কারাগারে যেতে হয়। ১৯৬৪ সালে ফাতিমা জিন্নাহ এর নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পূর্বে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার এবং এক বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। উচ্চ আদালতের রায়ের পূর্বেই তিনি মুক্তি পান। ১৯৬৬ প্রথম তিন মাসের মধ্যেই সিলেট, ময়মনসিংহ এবং ঢাকা থেকে ৮ বার পুলিশের হাতে বন্দী হন। ০৮ মে ১৯৬৬ সালে নারায়নগঞ্জে পাট কারখানার শ্রমিকদের এক র্যালিতে অংশগ্রহণের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৮ সালের প্রথম দিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ঢাকা সেনানিবাসে অন্তরীণ করে রাখা হয়। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে অপারেশন সার্চ লাইট শুরু করে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ফয়সালাবাদের একটি জেলে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হয়। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে তিনি স্বাধীন, সার্বভৌম, বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন বড় বৈচিত্র্যময়। সেখানে শুধু দেশ এবং দেশের মানুষের বাইরে অন্য কিছু নেই। ছাত্র অবস্থায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কামাল উদ্দিন হোসেন এর লেখায় জানতে পারি চল্লিশের দশকে নেতাজি সুভাষ বসু যখন কুখ্যাত হলওয়েল স্তম্ভ অপসারণ আন্দোলন করেন, সেই আন্দোলনের অন্যতম কর্মী ছিলেন শেখ মুজিব। দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষ এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যেতেন ধান কাটতে এবং ধান ও তাদের মজুরী নিয়ে ফিরে আসতেন; প্রয়োজন হতো নৌকা; মহাজনদের নিকট হতে করতে হতো ধার দেনা। এসব কৃষকদের বলা হতো দাওয়াল। দাওয়ালদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ মুজিব আন্দোলন করেছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। এটি জানতে পারি আতিউর রহমানের এক লেখা থেকে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আজীবন বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরে তাঁর কর্মযজ্ঞ ইতোমধ্যে আমরা সবাই জানি। পৃথিবীতে এতো অল্প সময়ে কোন রাষ্ট্রের সংবিধান পাওয়া বিরল ঘটনা; আমেরিকারও অনেক বেশি সময় লেগেছিল সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, জাতিসংঘের সদস্য লাভ, জাতিসংঘে প্রথম বাংলায় ভাষণ। প্রতিবেশিসহ বিশ্ব পরিমন্ডলে নবীন রাষ্ট্রকে অন্তর্ভুক্তিকরণ। সব ক্ষেত্রেই সফলতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ এবং দেশের জনগণের আদর্শ। তাঁর স্বপ্ন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা। সেটি এখন আমাদের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। বাংলাদেশের জনগণ ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে সেটি অর্জন করেছে। আমরা বাংলাদেশ পৃথিবীতে একশ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে উন্নয়ন কার্যক্রম করছি। আমাদের হাতে এখন ডেল্টা ব-দ্বীপ মহাপরিকল্পনা। এতো সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা বিশ্বে কোন দেশ এখন পর্যন্ত করেনি। এটিও বিশ্ব ইতিহাসের অংশ। আমরা আশাবাদী মানুষ। এটি শিখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আমাদের মহান নেতা। হাজার বছরের বাঙালীর মুক্তির নেতা। পরাধীন জাতিকে দিয়েছেন স্বাধীনতা। বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ হতে উন্নত দেশের সোপানে অগ্রসর হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। অবশ্যই বাস্তবায়নে বাধা থাকবে। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অঙ্গীকার, আমরা সেসব বাধা অতিক্রম করে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করবোই।
জাতীয় শোক দিবস ও বঙ্গবন্ধুর শাহাদত বার্ষিকী’র শোকাবহ এ দিনে জ্ঞাপন করছি তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা জানাই তাঁর পরিবারের নিহত অন্য সদস্যদের প্রতিও। যারা জীবন দিয়ে আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, দেশকে তাঁরা কত ভালোবাসেন।
হে মহান নেতা, আপনার প্রতি নিবেদন আমার আমৃত্যু ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।