লকডাউনে ব্যাংক কাউন্টারঃ একটি অভিজ্ঞতা/ শ্যামল কুমার সরকার

ছবিঃ শ্যামল কুমার সরকার

লকডাউন এর সাথে পেটের লক চললে খুবই ভালো হতো। কিন্তু তা যে হবার নয়। কবি সুকান্ত অনেক আগেই বলে গেছেন, ‘‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’’। এমন বাস্তবতা মেনে নিয়েই সরকার সকাল দশটা হতে বারোটা পর্যন্ত ব্যাংকিং লেনদেন চালু রাখেন। একজন ছাপোষা পেশাজীবি হিসেবে সম্প্রতি সকাল দশটায় দীর্ঘ লাইনে গ্রাহকদের দাড়ানো দেখে চেক নিয়ে ফিরে এসেছি। বাংলা বছরের শেষ দিনে (১৩ এপ্রিল ২০২০) মাসিক বেতন উত্তোলনের চেক নিয়ে সকাল ৮ টায় ব্যাংক শাখার গেটে নিয়ে হাজির। ভেবেছিলাম আজ আমিই প্রথম হবো। কিন্তু না। আমার রোল নম্বর হলো আট। জানলাম মেধা তালিকায় স্থানপ্রাপ্তরা এসেছেন সাতটার পরেই। সত্যিই উনারা মেধাবী। যা হোক, অপেক্ষা করতে থাকি। সময় আর কাটে না। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। স্বাস্থ্যবিধি মোতাবেক দূরত্ব বজায় রেখে চারজন করে ব্যাংকের ভেতরে প্রবেশ শুরু। সে হিসাব অনুযায়ী আমি দ্বিতীয় পর্যায়ে ভেতরে যাবো। আমার পেছনে আছেন প্রায় একশত মানুষ। সবাই সড়কে রোদে দাড়িয়ে আছেন পূর্ব-পশ্চিমে লাইন করে। এমন সময় হঠাৎ দেখি দু’জন মানুষ সিনা টান করে আমার পাশ দিয়ে ব্যাংকের দিকে যাচ্ছেন। আর দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য বলছেন, ম্যানেজারের সাথে দেখা করেই আপনারা চলে আসবেন। আমার বুঝতে একটুও ভুল হলো না যে, দু’জন প্রতারককে পুলিশ ভাই চিনতে ভুল করেছেন। আদতে উনারা দু’জনই বেতন তুলতে যাওয়া এমএ পাশ শিক্ষক।

আমি ব্যাংকের ভেতরে ঢোকার ঠিক আগে দু’ঠকবাজ টাকা তুলে বের হলেন। সবার নাক-মুখ মাস্ক দিয়ে ঢাকা। তবুও প্রতারকদের অন্তত একজনকে আমি বোঝাতে সক্ষম হলাম যে, আমি খেলাটা ধরে ফেলেছি। ওরা দীর্ঘ প্রতীক্ষায় থাকা নানা বয়সের এতজন মানুষকে ধোকা দিয়ে চলে গেলেন। লাইনে দাড়ানো মানুষগুলোর বেশির ভাগই এম এ পাস নন। অথচ কেউ-ই জানতে পারলেন না দু’জন উচ্চ শিক্ষিত (কুশিক্ষিত) ছদ্মবেশী ভন্ড শুধুমাত্র নিজেদের বিকৃত রুচির কারণে দেশের এমন দুর্যোগেও নিয়ম নীতির কোনো তোয়াক্কা করলেন না। আমি কী যে লজ্জা পেলাম। হার্টবিটও বেড়ে গেল। লাইনে থাকা অবস্থাতেই একবার মনে হয়েছিল প্রতারক দুটিকে পুলিশে সোপর্দ করি। লাইনের মানুষগুলোর কাছে ওদের মুখোশ খুলে দেই। কিন্তু পারলাম না। ওদের আচরনের কারণে কষ্ট পেলাম। কষ্ট পেলাম আমার এ না পারার কারণেও।

কেন পারলাম না ? একি শ্রেণি স্বার্থ ? বুর্জোয়া মনোভাব ? ওদেরকে গলা ধাক্কা দিতে দেখলে আমিও যে ছোট হতাম। ওরা যে আমারই জাত। কাকের মাংস কাকে খায় না। আমি মানুষ হয়ে কীভাবে আমার জাতের মাংস খাই? মনের এমন দুর্যোগের মধ্যেই আমার টাকা তোলা শেষে বেড়িয়ে এলাম। দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যকে দু’শঠের কাহিনী না বলে পারলাম না। তিনি তো হতভম্ব। তার প্রশ্ন, এ-ও কি সম্ভব ? পুলিশ ভাইয়ের পীড়াপিড়িতে নিজের পরিচয় না দিয়ে পারলাম না। তিনি বললেন, ‘‘বুঝতে পেরেছি আপনার মনের অবস্থা। স্যার, আমিও শিক্ষকের ছেলে’’। দেখলাম দেশ নিয়ে এ লোকটিও ভাবেন।

ভদ্রলোকের কাছ হতে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ত্রাণ চোরদের কথা ভেবে। মনে এলো বঙ্গবন্ধুর কথা। এক মহাদুর্যোগের সময় বঙ্গবন্ধু দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘‘আমার কম্বল কোথায়’’? আবার মনে এলো নেদারল্যান্ডস এর কথা। যে দেশে দুর্নীতিবাজদের ছবি দেশের পাবলিক টয়লেট ও ওয়াশরুমের ইউরিনালে (পুরুষদের দাড়িয়ে প্রস্রাব করার জায়গা) টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়। বছর জুড়ে দেশবাসী সেসব ইউরিনালে রক্ষিত দুর্নীতিবাজদের ছবির উপরে ধিক্কার জানিয়ে প্রস্রাব করেন! ভাবতে লাগলাম যদি এমনটি আমাদের দেশেও হতো। প্রথম দফায় অন্তত এম এ পাস দুর্নীতিবাজদের ছবি ইউরিনালে সেট করা হোক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একা পারবেন না। ভদ্রতাকে ওরা দুর্বলতা ভাবেন। ওরা বেহায়া। ইউরিনালই ওদের উপযুক্ত জায়গা।

শ্যামল কুমার সরকারঃ সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ঝিটকা খাজা রহমত আলী কলেজ, হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ।

Facebook Comments Box
ভাগ