সহজ জীবনের জাসদের আমৃত্যু কঠিন নেতা ইকবাল ভাই

সুরুয খান

আদি পিতা-মাতার নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের শাস্তিস্বরূপ সৃষ্টিকর্তা মৃত্যু নামক যে নাছোড়বান্দা বস্তুটি মানব জাতির জীবনের সাথে সন্নিবদ্ধ করে দিয়েছেন, তার হাত থেকে পরিত্রাণের কোন-ই উপায় নেই। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন: ‘মৃত্যু অমৃত করে দান।’

এই নিয়মের ধারাবহিকতায় গত ২৫ জুন ২০১৯ মানিকগঞ্জ জেলা জাসদের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল হোসেন খান মানিকগঞ্জবাসীকে কান্নার সাগরে ভাসিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চির বিদায় নেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।
মানিকগঞ্জের ইতিহাস, ঐতিহ্য যেমন সমৃদ্ধশালী তেমনি যুগে যুগে এ অঞ্চলে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ জন্মগ্রহণ করেছেন। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাদের অবদান অপরিসীম। এ তালিকায় অবশ্যই ইকবাল হোসেন খানের নাম অন্তর্ভুক্তি থাকবে।

ইকবাল হোসেন খানের জীবন চক্র মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব ও পরে ছাত্র রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, জাসদ রাজনীতি, গণবাহিনী,আওয়ামী লীগ সহ ৭৫ পরবর্তী বিভিন্ন সামরিক স্বৈর শাসকের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই, সামাজিক কর্মকান্ড ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিব্যপ্ত ছিল। তিনি তৎকালীন মানিকগঞ্জের অবিভক্ত ছাত্রলীগের সেক্রেটারী ও বিএলএফ এর ডিপুটি থানা কমান্ডার ছিলেন। যুবক বয়সে হকী খেলায়ও তার পারদর্শিতা ছিল উল্লেখ করার মত।
আমি ইকবাল ভাইকে প্রথম দেখি ১৯৭৭ সালে। তখন সবে ম্যাট্রিক পাস করে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তি হয়েছি। তার আগে আমি মানিকগঞ্জের বাসিন্দা ছিলাম না। পিতার সরকারি চাকরির কারণে আমাকেও বিভিন্ন স্থানে থাকতে হয়েছে। এখানে এসে আমি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মীও হয়ে উঠি। জাসদ অফিসে নিয়মিত যাওয়া শুরু করি। ইকবাল ভাইয়ের সাথে প্রায়ই দেখা হয়। কথা হয়। সাধারণ জীবন যাপনে তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। সব সময় পাজামা-পাঞ্জাবি পড়তেন। সেই সময় থেকে তিন দশকের বেশি সময় ধরে ইকবাল ভাইয়ের সাথে পথ চলেছি। সভা-সমাবেশ-মিছিল-বৈঠকে, আত্মগোপনে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত খুব কাছ থেকে দেখেছি তাকে।

বৈঠকি আলোচনায় ইকবাল ভাই ছিলেন তুলনাহীন। কদাচিৎ উচ্চ স্বরে বাক্যবিনিময় করতেন। কোন বিষয়টি উপস্থিত বৈঠকেই প্রভাবিত করে ফয়সালা করতে হবে আর কোন বিষয়গুলো পরবর্তী সময়ের জন্য রেখে দিতে হবে, সেই বিচারে তিনি ছিলেন বিচক্ষণ। তার বক্তৃতায় কখনো কখনো উত্তেজনা থাকলেও শ্রোতারা বিমোহিত হয়ে শুনতেন। ধৈর্যচ্যুতি ঘটতো না কারো। প্রায়ই রাজনৈতিক চিঠিপত্র ডিকটেশন দিয়ে আমাকে দিয়েই তিনি লেখাতেন।

ইকবাল ভাইয়ের বাস্তবতাবোধ যে গভীর ছিল, নানা ক্ষেত্রেই এর অভিপ্রকাশ ঘটত। প্রতিটি কাজের ছোটখাটো খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে তাঁর মনোযোগ ছিল। ছোট-বড় ঘটনা, সেটা রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বা অন্য যা কিছুই হোক না কেন, তা সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দরভাবে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তার ছিল অসাধারণ দক্ষতা। তিনি ছিলেন অতুলনীয় সংগঠক। কর্মীদের শক্তি-দুর্বলতা, সামর্থ্য-ঘাটতি ইত্যাদির হিসাব তার নখদর্পণে থাকত। কর্মীদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও খোঁজখবর রাখতেন। একটি বড় কাজের জন্য তিনি একটি কর্মী টিম গড়ে তুলে সেই টিমকে উদ্বুদ্ধ করে কাজে নামিয়ে দিতে পারতেন। কখন কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে, তা সংশ্লিষ্ট কর্মীকে ডেকে নিয়ে বলে দিতেন অথবা নির্দেশমূলক চিঠি দিয়ে জানাতেন। এভাবে ইকবাল ভাই হয়ে উঠতেন সেই কাজের নেপথ্য নায়ক।
রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণেও তিনি ছিলেন অনন্য প্রতিভার অধিকারী। পার্টির অভ্যন্তরে অথবা বাইরে সর্বত্রই তার এই দক্ষতার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যেত। রাজনৈতিক, সাংগঠনিক সব বিষয়কে তিনি যেমন সময়ের মাপকাঠিতে বিচার করতেন, তেমনি সময়ের আরও বিস্তৃত ক্যানভাসে বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে তিনি কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারতেন। দূরের দিকে দৃষ্টি রেখে তিনি বর্তমানের কাজের স্বরূপ নির্ধারণ করতেন এবং কাজের কৌশল এমনভাবে গ্রহণ করতেন, যাতে নির্ধারিত দূরবর্তী লক্ষ্যাভিমুখে কাজের গতিমুখিনতা থাকে। আর সেই গতিমুখিনতার স্টিয়ারিংটি ধরা থাকত তাঁর নিজের হাতে।

রাজনীতিতে বা সংগঠনের কাজে কোনো বিশেষ পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কাকে কখন কোন কথা বলতে হবে, কাকে দিয়ে কখন কোন কাজ করাতে হবে, কার মাধ্যমে কোন কথা কার কাছে পৌঁছাতে হবে, যৌথ বৈঠকে একটি মনমতো সিদ্ধান্ত বের করে আনার জন্য আগেই কীভাবে এবং কাকে কাকে নিয়ে মতামতের সপক্ষে অনুকূল একটা চক্র গড়ে তুলতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে নিখুঁত পরিকল্পনা করে পদক্ষেপ নিতে তিনি অসাধারণ পারদর্শী ছিলেন। শক্তির বিন্যাস কীভাবে কতটা অনুকূলে নিয়ে আসা যায়, সে সম্পর্কে তার হিসাব-নিকাশ করার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। কোথায় কার সঙ্গে কোন প্রশ্নে আপোষ করে যথাসম্ভব অনুকূল আপাত ফল বের করে আনা যেতে পারে, তিনি সেটা খুব ভালোভাবে হিসাব করে পদক্ষেপ নিতে পারতেন।

গণ-আন্দোলনের গতিধারা সম্পর্কে ইকবাল ভাইয়ের অসাধারণ প্রায়োগিক জ্ঞান ছিল। কখন এগোতে হবে আর কখন পেছাতে হবে, কিংবা কখন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে আর কখন সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে এসব বিষয়ে তার প্রায়োগিক জ্ঞান অসাধারণ ছিল। গণ-আন্দোলনের প্রক্রিয়াকে চালনা করে নেওয়ার অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শনে তিনি সক্ষমতার প্রমাণ রাখতে পেরেছিলেন।

ইকবাল ভাই ভেতরে-ভেতরে খুবই রোমান্টিক মনের মানুষ ছিলেন। ছিলেন অনুভূতিপ্রবণ ও গভীরভাবে সংবেদনশীল। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে তিনি ভালোবাসতেন। প্রচুর সিগারেট খেতেন। জমিয়ে আড্ডা দিতে, মন খুলে হাসি-ঠাট্টা করতে পছন্দ করতেন তিনি।

জাসদ যখন গঠিত হয় তখন অনেকেই ভেবেছিল তারুণ্য আর স্বপ্নের যুগলবন্দি আধুনিক রাজনীতি দেখা যাবে। কিন্তু গণবাহিনী, উদ্দেশ্যহীন বিরোধিতা, নেতাদের সুবিধামতো জায়গা বদল, মৌলবাদে বিশ্বাস আর হঠকারিতায় পুরো ব্যাপারটাই রহস্যময় আর ধোঁয়াসা হয়ে উঠল। তারপরও লোভ লালসার উর্ধে থেকে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে টিকে থাকা জাসদে তিনি আমৃত্যু রয়ে গেছেন।

বই পড়ে আমি যতটুকু জেনেছি, কার্ল মার্ক্সের জন্মের আগে থেকে সমাজতন্ত্রের যে-বিভিন্ন ধারণা ও তত্ত্ব ইউরোপে বিকশিত ও চর্চিত হয়েছিল, তাদেরকে বলা হয় ইউটোপিয়ান সমাজতন্ত্র। কারণ, সেগুলোর সূত্রায়ন ও বাস্তবায়নের কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও ভিত্তি ছিল না। বিপরীতে, কার্ল মার্ক্স ও ফেডরিখ এঙ্গেলসের সূত্রায়িত সমাজতন্ত্র ছিলো শ্রেণি সংগ্রাম নির্ভর মানবেতিহাসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী ব্যাখ্যার ভিত্তিতে সূত্রায়িত ও সমাজ বিকাশের অবশ্যম্ভাবী স্তর রূপে নির্দশিত। ইটোপিয়ান সমাজতন্ত্রের সাথে দ্বন্দ্বমূলক ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ভিত্তিক সমাজতন্ত্রের পার্থক্য নির্দশার্থে ফেডরিক এঙ্গেলস ‘Scientific Socialism’ বা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ কথাটির প্রবর্তন করেন। ইকবাল ভাই ছিলেন সর্বাংশে এই আদর্শের প্রতি আত্মনিবেদিত। তবে সবসময় তত্ত্ব ব্যাপারটিকে তিনি যে বেশি গুরুত্ব দিতেন তা নয়। ঢাকায় কর্নেল তাহের মিলনায়তনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইকবাল ভাই আর আমি একসাথে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে একাধিক বক্তা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রসংগে বলছিলেন। তাদের ব্যাখ্যা আমার পছন্দ হয় নি। ফেরার পথে ইকবাল ভাইকে বিষয়টি বললাম। তিনিও মানলেন আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে হলে তা করতে হবে ভিন্ন ধারায়। আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায়। পরবর্তী সময়ে লক্ষ্য করেছি সমাজ পরিবর্তনে, সমাজের দূষণ দূরীকরণে আমাদের সমাজের বাস্তবতাকে গ্রহণ করেই তিনি কাজ করতে পরিকল্পনা করতেন। এজন্য পার্টিকেই তিনি প্ল্যটফর্ম হিসেবে আকড়ে রেখেছিলেন। পার্টির জন্য তিনি সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন। জাসদ ছিল তার ধ্যানজ্ঞান ও সাধনার প্রধান কেন্দ্র। ইকবাল ভাই ও জাসদ ছিল এক নাড়িতে বাঁধা, অভিন্ন সত্তা। এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন জাতীয় নেতা। চাঁদের কলঙ্কের মতো কিছু ভুল তারও ছিল। ইকবাল হোসেন খান পরিণত বয়সে কী আশা বুকে ধারণ করে চলে গিয়েছেন জানি না। তবে এটুকু জানি, তার স্বপ্ন আদর্শ কিংবা চেতনার স্বদেশ এখনো অনেক দূরের তারার মতো। যদি পথ খুঁজে পাওয়া না যায়, যদি অন্ধকার ঘনীভ’ত হতে হতে সবকিছু ঢেকে দেয় তখন এরাই আমাদের আলোকবর্তিকা।

কঠিন বিপদের সময়ও ইকবাল ভাইকে আমি কখনো ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি। কিন্তু বছরখানেক আগে চিকিৎসার জন্য ভারত যাবেন। আমার স্ত্রী তাকে দেখতে বাসায় যায়। ওকে দেখেই অনেক কাঁদলেন তিনি। বললেন, ‘দোয়া করিস যাতে সুস্থ হয়ে তোদের মাঝে ফিরে আসতে পারি।’ সেবার ইকবাল ভাই ঠিকই ফিরেছিলেন। কিন্তু মরণ ব্যাধি তার পিছু ছাড়ে নি।

শুরুটা যেমন করেছিলাম মৃত্যু দিয়ে শেষটাও মৃত্যু নিয়ে লোর্কার একটা কবিতাংশ দিয়েই করি: ‘মৃত্যু যেন জীবনই, শুধু কেবল অন্য নামে ডাকা।’

সুরুয খানঃ সাংবাদিক

Facebook Comments Box
ভাগ